দেশের ২৯ বিশিষ্ট নাগরিক নতুন করে শুরু করা প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন। সোমবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে তারা জানিয়েছেন, হঠাৎ করে প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা ও নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন।
১৩ বছর পরে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় পঞ্চম শ্রেণিতে বৃত্তি পরীক্ষা এ বছর থেকে আবার চালু করতে যাচ্ছে। ৩০ ডিসেম্বর একই দিনে চার বিষয়ে অনুষ্ঠিত হবে এই পরীক্ষা।
এর আগে ২০০৯ সালে থেকে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিএসসি) শুরু হলে বাদ হয়ে যায় বৃত্তি পরীক্ষা। পিএসসির ফলাফলের উপর ভিত্তি করে তখন শিক্ষার্থীদের বৃত্তি দেওয়া হত। গত তিন বছর করোনার কারণে পিএসসি পরীক্ষা হয়নি।
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে চালু হচ্ছে নতুন শিক্ষাক্রম, যে শিক্ষাক্রমে প্রাথমিক পর্যায়ে পাবলিক পরীক্ষাকে কম গুরুত্ব দিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই ধারাবাহিক মূল্যায়নের ওপর অধিকতর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে, তা পর্যায়ক্রমে অন্যান্য শ্রেণিতেও বাস্তবায়ন করার পরিকল্পনা রয়েছে। এ অবস্থায় বছরের একেবারে শেষ সময়ে আকস্মিকভাবে পুরানো ব্যবস্থার মতো প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা ও নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন।’
২৯ জন নাগরিকের মধ্যে আছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ প্রণয়ন কমিটির কো-চেয়ার ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ, প্রখ্যাত অভিনেতা ও নাট্যকার রামেন্দু মজুমদার, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে. চৌধূরী, নিরাপদ সড়ক চাই-এর চেয়ারম্যান ও অভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চনসহ অন্যান্যরা।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘নতুন শিক্ষাক্রমের রূপরেখা অনুযায়ী শিক্ষায় পরিবর্তনের যে ইতিবাচক ধারা তৈরি হচ্ছে, সেখানে এভাবে হুট করে বৃত্তি পরীক্ষা চালু করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হলে শিক্ষার্থীদের ওপর নানামুখী মানসিক ও শারীরিক চাপ পড়বে বলে আমাদের বিশ্বাস। এ ছাড়াও নতুন শিক্ষাক্রমে যেখানে সব শিক্ষার্থীর মেধার সম্পূর্ণ বিকাশের নানা দিককে উৎসাহিত করা হচ্ছে, সেখানে মাত্র ২০ শতাংশ শিক্ষার্থীকে বাছাই করে একটি বৃত্তি কার্যক্রম শুরু করলে সুবিধাভোগী ও সুবিধাবঞ্চিতদের মধ্যে বৈষম্য আরও বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এটি আমাদের সংবিধানের মূলনীতির পরিপন্থি।
‘দ্রত পরিবর্তনশীল পৃথিবীর সঙ্গে খাপ-খাওয়ানোর লক্ষ্যে বর্তমানে প্রচলিত সনাতন শিখনকালীন মূল্যায়ন পদ্ধতি এবং পরীক্ষা-নির্ভর, সনদসর্বস্ব শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে সাম্প্রতিককালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিভিন্ন সময়ে দেওয়া বক্তব্য আমাদের অনুপ্রাণিত করেছে। কিন্তু শুধুমাত্র ২০ শতাংশ শিক্ষার্থীর জন্য প্রাথমিক পর্যায়ে একটি বৃত্তি পরীক্ষা চালুর ঘোষণা আমাদের হতাশ করেছে। শিক্ষা নিয়ে প্রায়শ এত পরীক্ষা-নিরীক্ষা শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের বিভ্রান্ত করে থাকে, যা মোটেই বাঞ্ছনীয় নয়।
‘তাছাড়া, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে এবং আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে প্রতি বছর “সৃজনশীল মেধা অন্বেষণ” প্রতিযোগিতার মাধ্যমে যেভাবে আমাদের বিভিন্ন স্তরের ও নানা ধরনের আর্থ-সামাজিক অবস্থানে থাকা, এমনকি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদেরও বাছাই করা হয়ে থাকে, তা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। সব শিক্ষার্থীর মেধা যাচাইয়ের এরকম একটি সুন্দর ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বে কেন শুধুমাত্র ২০ শতাংশ শিক্ষার্থীর জন্য হঠাৎ করে বৃত্তি পরীক্ষা চালু করা হচ্ছে তা আমাদের বোধগম্য নয়।’
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘এই পরীক্ষা চালুর মাধ্যমে কোচিং বাণিজ্য ও গাইড বইয়ের দৌরাত্ম্য বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে, যা ইতোপূর্বে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা নিয়ে পরিচালিত বিভিন্ন গবেষণায় সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। এ কারণে অভিভাবকদের বাড়তি খরচেরও সম্মুখীন হতে হবে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো অসুস্থ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হবে।’
বিবৃতিদাতারা সব শিক্ষার্থীর জন্য উপজেলাভিত্তিক বাছাইয়ের মাধ্যমে মেধাবৃত্তি প্রদানের বিষয়টিকে বিবেচনা করার আহ্বান জানান। এর মাধ্যমে শিক্ষা ব্যবস্থাপনা বিকেন্দ্রীকরণের পথে এগিয়ে যাবে বলে তারা মন্তব্য করেন।