দেশের ২ দশমিক ৮০ শতাংশ মানুষ শারীরিক বা মানসিক প্রতিবন্ধী। এদের মধ্যে নারীর তুলনায় পুরুষের সংখ্যা বেশি। আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে বিশ্বের মোট জনগোষ্ঠীর ১৫ শতাংশ কোনো না কোনোভাবে প্রতিবন্ধী।
দেশে সরকারি সংজ্ঞা অনুযায়ী অন্তত একটি প্রতিবন্ধিতা রয়েছে এমন ব্যক্তিকে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি বলা হয়। শনিবার সারা বিশ্বে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস। একই সঙ্গে দেশেও এই দিনে জাতীয় প্রতিবন্ধী দিবস পালন করা হয়। এ বছর এই দিবসটি হবে আন্তর্জাতিকভাবে ৩১তম ও জাতীয়ভাবে ২৪তম।
এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের জন্য পরিবর্তনমুখী পদক্ষেপ, প্রবেশগম্য ও সমতাভিত্তিক বিশ্ব বিনির্মাণে উদ্ভাবনের ভূমিকা।’
পূর্ণ পরিসংখ্যান না থাকলেও বেসরকারি হিসাবে বাংলাদেশে প্রতিবন্ধীদের সংখ্যা প্রায় দেড় কোটি বলে ধারণা করা হয়। দেশটিতে এই বিপুল পরিমাণ প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশই শিক্ষার সুযোগ পায় না। আর উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে এই সংখ্যা খুবই নগণ্য।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, দেশে ১২ ধরনের প্রতিবন্ধিতার শিকার ব্যক্তির সংখ্যা ২১ লাখ ৭৭ হাজার ৯৮১ জন। এর মধ্যে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তি ৩ লাখ ৬৪৯ জন। বিবিএসের জরিপের তথ্য মতে, দেশে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তির সংখ্যা মোট প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সংখ্যার শূন্য দশমিক ৩৯ শতাংশ।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী। ফাইল ছবি
বাংলাদেশে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের পড়াশোনার একমাত্র সহায়ক হচ্ছে ব্রেইল পদ্ধতি। মূলত কাগজের ওপর ছয়টি বিন্দুকে ফুটিয়ে তুলে লিখবার একটি পদ্ধতি। দৃষ্টিহীন ব্যক্তিরা এই উন্নীত বা উত্তল বিন্দুগুলোর ওপর আঙুল বুলিয়ে ছয়টি বিন্দুর নকশা অনুযায়ী কোনটি কোন অক্ষর তা অনুধাবন করতে সক্ষম হন এবং লেখার অর্থ বুঝতে পারেন।
দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা বলছেন, ডিজিটাল সুবিধা অনেক বাড়লেও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য ব্রেইল পদ্ধতির কোনো বিকল্প নেই। ব্রেইল পদ্ধতির নানা উপকরণ আরও সহজলভ্য হলে তাদের জন্য শিক্ষাগ্রহণ আরও সুবিধার হবে।
কীভাবে চলছে পড়াশোনা ও পরীক্ষা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট ৭১ জন প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী রয়েছেন। এর মধ্যে ৩১ জন রয়েছেন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। ভলান্টিয়ার শিক্ষার্থীরা এখানে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের শিখন কাজে সাহায্য করে থাকেন।
এই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের সংগঠন ফিজিক্যালি চ্যালেঞ্জড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন বা পিডিএফের সভাপতি তানভীর আহমেদ তন্ময় নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ব্রেইল পদ্ধতিতে কিছু সমস্যা আছে, তাই বিশ্ববিদ্যালয় ডিজিটাল পদ্ধতির কথা ভাবছে। আমরা কয়েকবার এই বিষয়ে উপাচার্যের সঙ্গে কথাও বলেছি। আমাদের এই বিষয়ে আশ্বস্ত করা হয়েছে।’
ঢাকার অদূরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে চলমান সব শিক্ষাবর্ষে সব মিলিয়ে শারীরিক প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৭৫ জন। এর মধ্যে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী রয়েছেন ৩৪ জন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করা পিডিএফ জানাচ্ছে, আবাসিক এই বিশ্ববিদ্যালয়ে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য এখনও কোনো কারিকুলাম তৈরি হয়নি। এমনকি তাদের শিক্ষার জন্য অপরিহার্য ব্রেইল পদ্ধতিও নেই বিশ্ববিদ্যালয়টিতে। শিক্ষার্থীরা শ্রুতি লেখকের সহায়তা নিয়ে বিভিন্ন অ্যাকাডেমিক পরীক্ষায় অংশ নেন।
সংগঠনের সভাপতি ৪৭তম আবর্তনের শিক্ষার্থী আব্দুল গাফফার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের এখানে আমাদের সংগঠন থেকেই এই ৩৪ জনকে পড়াশোনা করার জন্য সাহায্য করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এখনও তাদের জন্য কোনো বিশেষ সুবিধা চালু হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘ক্লাসের সব লেকচার রেকর্ড করে দেওয়া হয় তাদের। এরপর যখন পরীক্ষা শুরু হয়, তখন আমাদের একজন ভলান্টিয়ার তাদের পরীক্ষা দেওয়ার জন্য রেডি থাকেন। তবে এটা খুবই উদ্বেগজনক হয়ে পড়ে যখন আমাদের কোনো ভলান্টিয়ারের নিজের পরীক্ষা থাকে। তখন তিনি হয়তো দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীকে সাহায্য করতে পারেন না।’
গাফফার বলেন, ‘আমরা অনেক দিন ধরেই তাদের পরিপূর্ণ কারিকুলামের জন্য আন্দোলন করছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে একটা ডিজ্যাবিলিটি কর্নার করা হবে। দুই মাস আগেও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে (ইউজিসি) একটা সভায় আমরা কারিকুলামের কথা বলেছি। ইউজিসি জানত না এত শিক্ষার্থী (দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী) পড়াশোনা করছে। তারা কারিকুলামের জন্য উদ্যোগ নিবে এমন আশ্বাস দিয়েছেন।’
শুধু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় নয়, দেশের কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য আলাদা করে কোনো সুযোগ চালু হয়নি।
সারা দেশে কী অবস্থা
মৌলভীবাজারের সমন্বিত দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষা কার্যক্রমের রিসোর্স শিক্ষক স্বপন চন্দ্র কর্মকার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি নিজেও দৃষ্টিহীন। আর আমাদের জন্য ব্রেইল পদ্ধতি ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই।’
তিনি বলনে, ‘একজন শিশু যদি জন্মগতভাবেই দৃষ্টিহীন হয়ে থাকে, তবে তার শিক্ষার একমাত্র উপায় ব্রেইল। আগে আমাদের বইপত্র নিয়ে সমস্যা হলেও এখন চাহিদা অনুযায়ী জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) থেকে ব্রেইল বইপত্র সরবরাহ করা হচ্ছে।’
তবে ব্রেইল লেখার সামগ্রী পাচ্ছেন না বলে জানান স্বপন চন্দ্র। তিনি বলেন, ‘লেখার জন্য রাইটিং ফ্রেইম, বোর্ড এইগুলো পাচ্ছি না ঠিকমতো।’
দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা হাতের সাহায্য ছাড়া পড়তে পারবে না। তাই ছোটবেলা থেকেই তাদের ব্রেইল পদ্ধতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। একটা সময় পর্যন্ত ব্রেইল পদ্ধতিতে শিক্ষাগ্রহণ করলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পর সঠিক কারিকুলাম বা ব্রেইল সরঞ্জাম পান না তারা। এ ক্ষেত্রে নিতে হয় শ্রুতি লেখকের সাহায্য।
দৃষ্টিহীন এই শিক্ষক বলেন, ‘ব্রেইল পদ্ধতি থাকলে উচ্চশিক্ষার জন্য অবশ্যই ভালো হবে। তবে শ্রতিলেখকও লাগবে।’
তিনি বলেন, ‘স্কুলে টেস্ট বা নির্বাচনি পরীক্ষা পর্যন্ত ব্রেইল পদ্ধতি থাকছে। কিন্তু যখন পাবলিক পরীক্ষা দিচ্ছে, তখন তো খাতা আমার এখানে থাকবে না। বোর্ডে তো ব্রেইলের প্রতিকার নেই। তার জন্য শ্রুতি লেখকের সাহায্য লাগবেই।’
প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য প্রাথমিকের শিক্ষা সহজতর হলেও উচ্চপর্যায়ের শিক্ষা কঠিন হয়ে পড়ছে। বাংলাদেশে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের অধিকাংশ স্কুলই শুধু প্রাথমিক পর্যায়ে। মাধ্যমিকে এই শিক্ষার্থীদের জন্য মূলধারার প্রতিষ্ঠান ছাড়া বিকল্প নেই। আবার থাকলেও নেই উপযুক্ত শিক্ষা উপকরণ।
২০২১ শিক্ষাবর্ষে প্রথম থেকে নবম শ্রেণির ৯ হাজার ১৯৬ জন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর জন্য সরকার ব্রেইল পদ্ধতির বই ছেপেছে।
সফটওয়্যার ও শ্রুতি লেখক প্যানেল
গত আগস্টে দৃষ্টিহীনদের হাতে লেখা ব্রেইল লিপি বাংলায় রূপান্তর করার একটি সফটওয়্যারের প্রোটোটাইপ তৈরি করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষক দল। প্রাথমিকভাবে এ সফটওয়্যারে ৯৭ শতাংশ নির্ভুল ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে বলেও জানিয়েছেন গবেষকরা।
এই গবেষণায় যুক্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক আহমেদুল কবীর নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী আছেন, তাদের কথা ভেবেই আমরা এই সফটওয়্যার তৈরি করেছি।’
তিনি বলেন, ‘সাধারণত মাধ্যমিক ও প্রাথমিক পর্যায়ে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের পড়াশোনায় ব্রেইল থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে সেটি নেই। তারা ব্রেইলে যদি লিখেও থাকেন, সেটি পড়ার সক্ষমতা নেই। আমরা যে সফটওয়্যার বানিয়েছি, সেটি ব্রেইল লেখাকে বাংলায় রূপান্তর করতে পারবে। এটার মোবাইল স্ক্যান পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা চলছে।’
আহমেদুল কবীর বলেন, ‘ব্রেইলে লেখা কাগজ স্ক্যান করে সেটা সফটওয়্যারের মাধ্যমে দিলে ৯৭ ভাগ নির্ভুল এডিট করা যাবে এমন ওয়ার্ড ফাইল বা পিডিএফ লেখা আসবে। নেক্সট সেমিস্টারে শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাহায্যে একটা পরীক্ষা নেওয়া হবে। সেখানে আমরা আরও কিছু বিষয় পর্যবেক্ষণ করব।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তারিক আহসান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি যখন বুঝব আমার এখানে এই ধরনের শিক্ষার্থী আছেন, তখন আমি পরীক্ষা পদ্ধতি পরিবর্তনের কথা ভাবতে পারি। শুধু লিখে পরীক্ষা দেওয়ার বাইরেও অন্য কিছু পদ্ধতি যোগ করলে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের সুবিধা হবে।’
এই অধ্যাপক শ্রুতি লেখকের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে বলেন, ‘যদি এমন কোনো উপায় থাকে যে লিখতেই হবে, সে ক্ষেত্রে শ্রুতি লেখকের জন্য একটা প্যানেল করা উচিত। এই প্যানেল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তৈরি করবে। এটা অবশ্যই একটা রি-এনফোর্সমেন্ট ভিত্তিতে হতে হবে। যারা এখানে কাজ করবে, তাদের একটা সার্টিফিকেট দিতে হবে। অথবা সময় দেওয়ার জন্য সম্মানী দিতে হবে। যখন কোনো দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়কে তার পরীক্ষার সময় জানাবে, তখন বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সেই সহযোগিতা দেবে।’
শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের এই অধ্যাপক ব্রেইল পদ্ধতিরও উন্নতির কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘আমাদের গ্রন্থাগারে ব্রেইল প্রিন্টার আছে, কিন্তু সেটা সবার জন্য উন্মুক্ত নয়। কারণ অনেকেই জানেন না এটা কীভাবে কাজ করে। সেখানে অভিজ্ঞ লোক নিয়োগ দিতে হবে। তাতে উচ্চশিক্ষার পথ সুগম হবে।’