অফিস যাওয়ার জন্য বের হচ্ছিলেন অনির্বাণ বসু। হালকা শীতের সময় শরীর টানছিল বলে টেবিলে রাখা লোশন হাতে মাখছিলেন তিনি। এ সময় তার ছোট ভাই সাত বছরের ঈশান বলে বসল, ‘তুমি এই লোশন ব্যবহার করছ কেন? এটা তো বেবি লোশন। এটা কি তোমার ব্যবহার করার কথা?’
হতভম্ব অনির্বাণ তার ভাইকে বলেন, ‘বেবি লোশন তাতে সমস্যা নেই কোনো।’ জবাবে ঈশান বলে, ‘বেবি লোশন তো ১৮ বছর পর্যন্ত ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু তুমি তো তারও চেয়েও বড়।’
ঈশানের মতো এখনকার শিশুরা শুধু লোশন নয়, অনেক কিছুই জানে। এক দশক আগেও ঈশানের বয়সী শিশুদের কাছে এসব বিষয় ছিল কল্পনারও বাইরে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, তথ্যপ্রযুক্তি সহজলভ্য হওয়ার কারণে এই গুণগত পরিবর্তনটি এসেছে।
প্রযুক্তির এই সময়ে এসে শিশুদের ডিজিটাল ডিভাইসে আসক্ত হওয়া নিয়ে উদ্বিগ্ন অধিকাংশ বাবা-মা। সন্তানকে সামলে রাখতে পারেন না ভেবে অপরাধবোধেও ভোগেন অনেকে।
সম্প্রতি আন্তর্জাতিক গবেষণা জার্নাল সায়েন্টিফিক রিপোর্টসের গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, শিশুদের মনে ভিডিও গেমের ইতিবাচক প্রভাব অনেক বেশি। ভিডিও গেম বুদ্ধি শানিয়ে তোলে শিশুদের।
জার্নাল অফ নিউরোসায়েন্সে প্রকাশিত গবেষণায় দেখা গেছে, মস্তিষ্কের স্বাভাবিক বিকাশ প্রক্রিয়ায় টিনএজ শিশুরা অন্যদের কণ্ঠস্বরকে আমলে নিতে শুরু করে বলেই মায়ের কণ্ঠ বাড়তি গুরুত্ব হারাতে শুরু করে। এতে করে অনেক পিতা-মাতা মনে করেন শিশু অবাধ্য হয়ে উঠেছে।
বর্তমান প্রজন্মে শিশুদের জানার ইতিবাচক ও নেতিবাচক বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা রয়েছে। অন্যান্য বছরের মতোই এ বছর রোববার পালিত হচ্ছে বিশ্ব শিশু দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘সব শিশুর সুন্দর ভবিষ্যৎ’।
শিক্ষণের ক্ষেত্রে শিশুরা এখন আগের চেয়ে বেশি অগ্রসর হয়ে উঠছে। অনেক অভিভাবক মনে করেন, ডিজিটাল ডিভাইস মূলত শিশুদের অগ্রসরমান করে তুলেছে, আবার অনেকেই এটার নেতিবাচক দিক খুঁজে পান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ও সমাজ এবং অপরাধ বিশ্লেষক তৌহিদুল হক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের দেশে শিশুরা যেভাবে বড় হচ্ছে, বিশেষ করে বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে প্রযুক্তির ব্যবহার বা প্রযুক্তির সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততা মূলত সময়ের বৈশিষ্ট্য। এখান থেকে বের হয়ে আসা বা প্রযুক্তি পরিহার করলে সেখানে পিছিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হবে।’
তিনি বলেন, ‘যে সময় যে ধরনের সুযোগ-সুবিধা বা বৈশিষ্ট্য তৈরি হয়, তার ইতিবাচকতা গ্রহণ করেই সামনের দিকে অগ্রসর হওয়া উচিত। বর্তমান সময়ে আমাদের দেশে শিশুদের পরিবারের বাইরে একটা বড় বিষয় হচ্ছে প্রযুক্তি।’
প্রযুক্তি ব্যবহার করলে মনস্তাত্ত্বিক পরিপক্বতার জায়গাটি আগে থেকেই সংগঠিত হয় বলে মনে করেন এই অপরাধ বিশ্লেষক। তিনি বলনে, ‘শিশুরা তাদের নির্দিষ্ট বয়সের আগেই অর্থাৎ প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে ওঠার আগেই মানসিক বয়সের দিক থেকে এগিয়ে থাকে। ৩০ বছর আগে যে শিশু বড় হয়েছে আর এখন যে শিশু বড় হচ্ছে, দুটোর মধ্যে তারতম্য থাকবে। আগামী ৩০ বছর পরেও যে শিশু জন্ম গ্রহণ করবে, সে আরও বেশি ফাস্ট হবে চিন্তায় বা উপলব্ধিতে।’
তিনি বলেন, ‘একটা শিশুকে আগে পৃথিবী সম্পর্কে, সমাজ সম্পর্কে, তার আচরণ সম্পর্কে জানতে হলে একটা নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতো। বই পড়া, বড়দের কাছ থেকে বোঝা বা শিক্ষকদের কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা পর্যন্ত সে অপেক্ষা করত। সেই সুযোগ সবার আছে কী নেই সেটা একটা ব্যাপার ছিল, কিন্তু এখন প্রযুক্তির কারণে সেটা উন্মুক্ত হয়েছে।
‘প্রযুক্তিতে নেতিবাচক বিষয় থাকলেও আমরা কিন্তু ইতিবাচক বিষয়গুলোকে সামনে আনার কথা বলি।’
এখন সন্তানের সঙ্গে অভিভাবকদের আচরণের ধরনে পরিবর্তন এসেছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আগে একটা রক্ষণাত্মক বিষয় ছিল। সেই জায়গায় এখন পরিবর্তন এসেছে। এখন শাসনের পরিবর্তে বুঝিয়ে বলার প্রবণতা বাড়ছে। বাবাদের সহজাত যে আচরণ আমরা জেনেছি, যে বাবারা একটু মেজাজি হবেন, তা কিন্তু এখন দেখা যায় না। তারা নমনীয়ভাবে কথা বলেন। আর এখন পিতা-মাতারাও প্রযুক্তি থেকে শিক্ষা নিয়ে সেটার তাগিদ অনুভব করেন।’
সেভ দ্য চিলড্রেনের চাইল্ড প্রোটেকশন অ্যান্ড চাইল্ড রাইটস গভারনেন্স বিষয়ক পরিচালক আবদুল্লাহ আল মামুন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আগের শিশুদের তুলনায় এখনকার শিশুরা অনেক এগিয়ে আছে। আর এটার বড় কারণ তথ্য ও প্রযুক্তির ব্যবহার। আগে অফলাইন কানেকটিভিটি বেশি ছিল, যেটি এখন অনলাইনকেন্দ্রিক হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘এখন বড়দের সঙ্গে শিশুদের যোগাযোগ বেড়েছে। আগে ভয় পেলেও এখন তাদের মধ্যে সেই ভয় কাজ করে না। অন্যদিকে বিশ্বায়নের কারণে ভিন্ন মতাদর্শের মানুষের সঙ্গে ওঠাবসাতেও অভ্যস্ত হচ্ছে তারা।’
এগুলোর নেতিবাচক দিক থাকলেও মামুন মনে করেন, ইতিবাচক দিকগুলোর দিকে তাদের গাইড করা উচিত।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মোহিত কামাল বলেন, ‘বর্তমান সময়ে শিশুদের জ্ঞানের পরিধি বেড়েছে। তারা এখন আগের চেয়ে বেশি জানে, তবে এটার ইতিবাচকতার সঙ্গে নেতিবাচক প্রভাবও অনেক বেশি।’
তিনি বলনে, ‘উন্নত বিশ্বে শিশুদের আমাদের মতোই প্রযুক্তি দেওয়া হচ্ছে, তবে সেটাকে ফিল্টার করা হয়। এমন কিছু অ্যাপ্লিকেশন থাকে যা তাদের ইতিবাচক বিষয়গুলো শেখাতে পারে। আমাদের দেশেও সেটা করা উচিত। আকাশসীমার পরিধি নিয়ন্ত্রণ করা উচিত। মা-বাবাকেও প্রযুক্তি সম্পর্কে জানতে হবে। সেটার ওপর নির্ভর করে শিশুদের প্রযুক্তি ব্যবহার করতে দিতে হবে। এ ছাড়া শিশুদের বই পড়ানোর অভ্যাস তৈরি করতে হবে।’
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ও শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ নিয়াজ মোহাম্মদ খান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা যখন একটা প্রজন্ম থেকে আর একটা প্রজন্মে যাই, তখন কিছু পরিবর্তন আসে। আর এটাকে সব সময় ইতিবাচকভাবে দেখা হয় না।’
উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি বলনে, ’৯০-এর দশকে আমরা যারা বড় হয়েছি, তখন প্রথম টেলিভিশন পেলে আমরা কিন্তু সেখানে সময় দিয়েছি। তখন কিন্তু অভিভাবকরা বলতেন টেলিভিশনের কারণে আমাদের পড়াশোনার ক্ষতি হচ্ছে বা চোখের সমস্যা হচ্ছে। তবে তখন বিতর্ক প্রতিযোগিতা বা খেলাধুলাতে অথবা সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতাতে অংশগ্রহণ বেড়েছিল। এটা শিশুদের মেধা ও মননের বিকাশে সাহায্য করেছে।
‘এখন ইন্টারনেট প্রযুক্তি এসেছে। আমরা যদি এখন শিশুদের দূরে রাখি, তাতে সে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে পিছিয়ে পড়বে। তারা এখন আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ও প্রোগ্রামিংয়ের মতো বিষয়ে দক্ষ হয়ে উঠছে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা এখন দেখি বাবা-মায়েরা বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করেন শিশুদের সঙ্গে। আমরা শিশুদের বলতে পারব কোনটা আমরা গ্রহণ করব বা বর্জন করব। ফেসবুক বা ইউটিউবের কনটেন্ট অনেক ক্ষেত্রে লার্নিংয়ের ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে।’
শিশু বয়সে বিকাশমান মস্তিষ্ক থাকে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এর ফলে মোবাইলে অনেক কিছু আমার বুঝতে কষ্ট হলেও আমার সন্তানের ক্ষেত্রে সেটা হবে না। আর এই সময়টা শিক্ষণের বয়স। এমন অনেক দেখা গেছে যে শিক্ষক বা পিতা-মাতা সন্তানের সহযোগিতা নিয়ে জুম বা অনলাইন সফটওয়্যারগুলো ব্যবহার করছেন। আর এটা সম্ভব হয়েছে কারণ, এই প্রজন্ম এগিয়ে আছে বলে।’