ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের এইচএসসি পরীক্ষার প্রথম দিনে বাংলা প্রথম পত্রে বিতর্কিত প্রশ্ন আসার ঘটনায় চলছে সমালোচনা। পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র তৈরির প্রক্রিয়া নিয়েও তৈরি হয়েছে উদ্বেগ।
নিউজবাংলার অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকাতে সরকার এমন একটি পদ্ধতি পরিচালনা করছে, যার ফলে প্রশ্ন তৈরির প্রাথমিক ধাপের পর থেকে পরীক্ষার হল পর্যন্ত নিরাপত্তার উন্নতি হয়েছে। তবে এই পদ্ধতিতে প্রাথমিক ধাপের পর পরীক্ষার্থীর হাতে প্রশ্ন পৌঁছানোর আগে মান যাচাইয়ের আর কোনো সুযোগ নেই।
এতে বিতর্কিত প্রশ্নও পরীক্ষা হলে পৌঁছে যাওয়ার ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে।
শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনিও সোমবার এক অনুষ্ঠানে বিষয়টি স্বীকার করেন।
তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘এখন প্রশ্ন ফাঁস রোধে প্রশ্ন তৈরির জন্য বিভিন্ন ধরনের ধাপ পার হতে হয়। সেখানে প্রশ্ন প্রণয়নকারী ও প্রশ্ন মডারেশনের সঙ্গে যারা জড়িত থাকেন তাদের নিজেদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক থাকে না।
‘প্রশ্ন প্রণয়নকারীর কাজ শেষে তা মডারেশন করেন আরেকজন। মডারেশনের শেষ হলে প্রশ্ন সরাসরি ছাপাখানায় চলে যায়। যার ফলে এমন বিতর্কিত বিষয় থাকলেও তা ঠিক করার কোনো উপায় থাকে না।’
উচ্চ মাধ্যমিক বা এইচএসসি পরীক্ষায় বাংলা প্রথম পত্রের পরীক্ষায় সাম্প্রদায়িক উসকানিমূলক প্রশ্নের সঙ্গে জড়িত পাঁচজনকে চিহ্নিত করেছে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড।
বিতর্কিত ওই প্রশ্নটি করেন ঝিনাইদহের মহেশপুরের ডা. সাইফুল ইসলাম ডিগ্রি কলেজের সহকারী অধ্যাপক প্রশান্ত কুমার পাল। প্রশ্নপত্রের মডারেশনে (যাচাইবাছাই) করেন নড়াইলের সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজের সহযোগী অধ্যাপক সৈয়দ তাজউদ্দীন শাওন, সাতক্ষীরা সরকারি মহিলা কলেজের সহযোগী অধ্যাপক মো. শফিকুর রহমান, মির্জাপুর ইউনাইটেড কলেজের সহকারী অধ্যাপক শ্যামল কুমার ঘোষ, কুষ্টিয়া ভেড়ামারা আদর্শ কলেজের সহকারী অধ্যাপক মো. রেজাউল করিম।
ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ও আন্তশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় সাব-কমিটির সভাপতি তপন কুমার সরকার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘চিহ্নিত ওই পাঁচ শিক্ষককে শোকজ করা হবে। এরপর তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার জন্য আন্তশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করবে। সে অনুযায়ী শিক্ষা মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।’
আলোচিত প্রশ্নপত্রটিতে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা দিলেও প্রকৃতপক্ষে এটি তৈরি ও যাচাই-বাছাই করেন যশোর শিক্ষা বোর্ডের আওতাধীন শিক্ষকেরা।
প্রশ্নপত্র তৈরি হচ্ছে কীভাবে
শিক্ষা বোর্ডসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, এসএসসি বা এইচএসসির প্রতিটি বিষয়ের প্রশ্নপত্র তৈরির জন্য নির্বাচিত শিক্ষকদের তালিকা রয়েছে।
এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার প্রতি বিষয়ের প্রশ্নপত্র তৈরিতে ৯টি শিক্ষা বোর্ডে নির্বাচিত শিক্ষক আছেন ৩৬ জন। অর্থাৎ প্রতি বিষয়ের জন্য প্রতিটি বোর্ডে প্রশ্নপত্র তৈরির দায়িত্ব পান চারজন শিক্ষক। একইভাবে প্রতিটি বোর্ডে প্রতি বিষয়ের প্রশ্নপত্র মডারেট করেন আলাদা চারজন শিক্ষক।
যশোর শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক মাধব চন্দ্র রুদ্র নিউজবাংলাকে বলেন, ‘প্রতি বোর্ডে চারজন শিক্ষক আলাদা আলাদা প্রশ্ন তৈরি করেন। সেগুলো তারা সিলগালা খামে সংশ্লিষ্ট বোর্ডে পাঠান। এরপর চারজন মডারেটর বোর্ডে এসে একটি বদ্ধ কক্ষে প্রশ্নগুলো মডারেট করেন।
‘এক একটা প্রশ্ন খুলে তাতে ভুলভ্রান্তি বা দাড়ি-কমা ঠিক করেন। প্রশ্ন যথাযথ না হলে বাদ দেয়া হয়। কোনো উদ্দীপক পছন্দ না হলে বাতিল করে নতুন উদ্দীপক দেয়া বা সংযোজনের সমস্ত দায়দায়িত্ব তাদের।’
আরও পড়ুন: এইচএসসিতে বিতর্কিত প্রশ্নটি করেন ঝিনাইদহের শিক্ষক
এরপর পরিমার্জিত চারটি প্রশ্ন সিলগালা খামে পাঠানো হয় ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে। সেখানে সব বোর্ডের চেয়ারম্যানের উপস্থিতিতে লটারি হয়।
কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ড. মো. আসাদুজ্জামান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘দেশের সব বোর্ড থেকেই প্রতি পত্রের চারটি করে প্রশ্ন পাঠানো হয় ঢাকায়। সেগুলো জমা দেয়া হয় আন্তবোর্ড চেয়ারম্যানের কাছে।’
আসাদুজ্জামান জানান, এরপর লটারিপদ্ধতিতে প্রশ্নপত্রগুলো বোর্ডের মাঝে ভাগ করা হয়।
উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘কুমিল্লা বোর্ডের জন্য যখন লটারির সময় কুমিল্লা থেকে জমা দেয়া প্রশ্নপত্রের বাইরে বাকি ৩২টি প্রশ্নপত্র বিবেচনায় নেয়া হয়। সেখান থেকে লটারির মাধ্যমে বেছে নেয়া দুই সেট প্রশ্ন সর্বোচ্চ নিরাপত্তায় বিজি প্রেসে ছাপাতে পাঠানো হয়।’
বিষয়টির আরও ব্যাখ্যা দেন ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান মু. জিয়াউল হক। তিনি নিউজবাংলাকে জানান, প্রশ্নপত্র প্রণয়নের প্রক্রিয়া শুরু হয় পরীক্ষার পাঁচ থেকে ছয় মাস আগে। সংশ্লিষ্ট শিক্ষা বোর্ডের নির্দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষক বাছাইয়ের মধ্য দিয়ে শুরু হয় প্রাথমিক কার্যক্রম।
তিনি জানান, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাংলাদেশ পরীক্ষা উন্নয়ন ইউনিট (বেডু) থেকে শিক্ষকদের মান উন্নয়নের পরীক্ষা নেয়া হয় ও প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। পরীক্ষা ও প্রশিক্ষণে ভালো ফলে ভিত্তিতে প্রশ্নপত্র প্রণয়নকারী বা মডারেটর নিয়োগ দেয়া হয়।
মু. জিয়াউল হক বলেন, ‘প্রশ্নপত্র প্রণয়নের বিষয়টি খুব জটিল। আমাদের নয়টি শিক্ষা বোর্ড প্রতিটা পত্রের চার সেট করে প্রশ্ন তৈরি করে। এরপর চারজন করে মডারেটর প্রতি পত্রের প্রশ্নগুলো মডারেট করেন।
‘তাদের কাজ শেষে নয়টি বোর্ডের ৩৬টি প্রশ্ন (প্রতি পত্রের) ঢাকা বোর্ডে নিয়ে আসা হয় এবং এরপর লটারি করা হয়। লটারি করে প্রতি বোর্ডের জন্য দুটি করে প্রশ্ন নির্ধারিত হয়ে ছাপার জন্য সেগুলো বিজি প্রেসে যায়।’
বোর্ডে লটারির সময় ৩৬টি প্রশ্নপত্রের কোনোটি কারও পক্ষে দেখার সুযোগ নেই বলে তিনি জানান। এমনটি প্রতি বোর্ডের জন্য চূড়ান্তভাবে নির্ধারিত দুই সেট প্রশ্নও খামবদ্ধ অবস্থায় পাঠানো হয় বিজি প্রেসে। পরীক্ষার দিন সকালে ফের লটারি করে পরীক্ষার জন্য প্রশ্নপত্রের চূড়ান্ত সেট বাছাই করা হয়।
এই কয়েকটি ধাপের কারণে কোন শিক্ষক বা কোন বোর্ড থেকে আসা প্রশ্ন কোন বোর্ডের পরীক্ষায় আসবে সেটি আগে থেকে বোঝার সুযোগ এখন নেই।
মু. জিয়াউল হক বলেন, ‘এবার লটারিতে ঢাকা বোর্ডের ভাগ্যে পড়েছে যশোর বোর্ডের শিক্ষকের করা প্রশ্ন। সাধারণত মডারেটররা চার সেট প্রশ্ন মডারেট করার পর সিলগালা করে বোর্ডের বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কাছে হস্তান্তর করেন। সিলগালা অবস্থায়ই প্রশ্নপত্র পাঠানো হয় আন্তশিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানের কাছে।
‘আন্তশিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অন্যান্য বোর্ডের চেয়ারম্যানদের নিয়ে লটারির আয়োজন করেন। এক বোর্ডের চেয়ারম্যান অন্য বোর্ডের প্রশ্নপত্র নির্বাচন করেন লটারিতে। সিলগালা অবস্থায় চারটি সেট থেকে লটারিতে নির্বাচন করা হয় দুটি সেট। তবে কোন সেটে কোন প্রশ্ন আছে, কোন বোর্ডে বিতরণ করা হবে বা কোন প্রশ্ন কোন বোর্ডের তত্ত্বাবধানে করা তা কারও জানা থাকে না।’
মানহীন প্রশ্ন শনাক্ত করার সুযোগ নেই
প্রশ্নফাঁস ঠেকাতে পুরো প্রক্রিয়ায় অনেক ধরনের নিরাপত্তা ধাপ যুক্ত হলেও এতে মানহীন বা বিতর্কিত প্রশ্ন থেকে যাওয়ার ঝুঁকি বেড়েছে।
এ অবস্থা দূর করতে হলে প্রশ্নপত্র প্রণয়নকারী শিক্ষক ও মডারেটরদের মানোন্নয়নের বিকল্প নেই বলে মনে করছেন ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান মু. জিয়াউল হক।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ঢাকা বোর্ডের বিতর্কিত প্রশ্নপত্রটি যিনি তৈরি করেছেন তিনি অবিবেচকের মতো কাজ করেছেন। আবার যারা মডারেট করেছেন তারাও অবিবেচকের মতো কাজ করেছেন। যদিও কারও সঙ্গে কারও দেখাসাক্ষাৎ হয়নি।
‘শিক্ষা বোর্ডের দায়িত্ব এমন শিক্ষদের নিয়োগ দেয়া বা বাছাই করা যারা অবশ্যই ভালো প্রশ্ন প্রণয়ন করতে পারেন।’
এ জন্য প্রশিক্ষণের বিকল্পও দেখছেন না মু. জিয়াউল হক। তিনি বলেন, ‘স্কুল ও কলেজ লেভেল থেকেই পরীক্ষার প্রশ্ন করানোর অভ্যাস থাকার দরকার। যারা বেডুতে ভালো প্রশিক্ষণ পাচ্ছেন তারাই যে ভালো প্রশ্ন করবেন এমন নয়। দেখা গেল প্রশিক্ষণে কারও ভালো নম্বর আছে, তবে আগে প্রশ্ন করার অভিজ্ঞতা নেই- এমন ক্ষেত্রে বিতর্কিত বিষয় উঠে আসতে পারে।’
তবে মানহীন বা বিতর্কিত প্রশ্ন ঠেকাতে শাস্তির বিকল্প দেখছেন না ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ও আন্তশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় সাব-কমিটির সভাপতি তপন কুমার সরকার।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের সেটার (প্রশ্ন তৈরিকারী শিক্ষক) ও মডারেটরদের বিশেষ নির্দেশনা দেয়া হয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয় অনুমোদিত কী কী বিষয় আছে, সেগুলো তাদের দেখতে হবে। কী কী বিষয় দেয়া যাবে না তা-ও জানানো হয়। আমরা তাদের ওরিয়েন্টেশনও করিয়েছি। বুঝিয়ে দেয়া হয়, ট্রেনিং দেয়া হয়।’
তিনি বলেন, ‘এর পরেও যার মাইন্ড সেটআপ যেমন তিনি তেমন করবেন। তাকে বুঝিয়ে পারা যাবে না। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিলে তারা সতর্ক হবেন। এ ছাড়া উত্তরণের কোনো উপায় নেই। এ ছাড়া নিয়োগের ক্ষেত্রেও আমাদের আরও সতর্ক হতে হবে।’
এ বিষয়ে দিনাজপুর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. কামরুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা এখন সেটার (প্রশ্ন প্রণয়নকারী) ও মডারেটরদের নিয়েও ভাবছি। তাদের এমন কাজের কারণে এগুলো হচ্ছে। সেগুলো আমরা ট্রেস আউট করে ব্যবস্থা নিচ্ছি।
‘প্রশ্ন প্রণয়নকারী ও মডারেটরদের নিয়ে আমাদের এখন চিন্তা করতে হবে। বিজি প্রেসে যে প্রশ্ন দেয়া হচ্ছে সেটা নিয়েও আমাদের আরও ভাবতে হবে। কোনো বোর্ডের প্রশ্ন যেন অন্য বোর্ডে না যায় তা নিয়েও আমরা সিদ্ধান্ত নিচ্ছি। ১২ নভেম্বর আমাদের একটি মিটিং আছে। সেখানে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।’