বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

জুনের আগে সব পাঠ্যবই পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা

  •    
  • ২ নভেম্বর, ২০২২ ২১:১৯

মুদ্রণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক জহুরুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘শিক্ষামন্ত্রীর দেয়া আল্টিমেটাম অনুযায়ী ডিসেম্বরের মধ্যে শতভাগ পাঠ্যবই দেয়া সম্ভব হবে না। তার বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যে বড়জোর ৩০ থেকে ৩৫ ভাগ বই সরবরাহ করা যাবে। বাকি বই পুরোপুরি সরবরাহ করতে জুন পর্যন্ত সময় লাগবে।’

উৎসবমুখর পরিবেশে নতুন বছরের প্রথম দিনে শিক্ষার্থীদের হাতে পাঠ্যবই তুলে দেয়ার যে রীতি তৈরি হয়েছে, সেটা আগামীতেও অব্যাহত রাখতে চায় সরকার। সে লক্ষ্যে ডিসেম্বরের মধ্যেই বই মুদ্রণ কাজ শেষ করতে সংশ্লিষ্টদের কড়া নির্দেশ দিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি।

অন্যদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে কাগজের দাম বেড়ে যাওয়া, সরবরাহে ঘাটতি এবং জ্বালানি সাশ্রয়ে বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের কারণে ডিসেম্বরের মধ্যে পাঠ্যবই মুদ্রণের কর্মযজ্ঞ শেষ করা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন মুদ্রণকারীরা।

মুদ্রণ ব্যবসায়ী মনে করছেন, ডিসেম্বরের মধ্যে ৩০ থেকে ৩৫ ভাগ বই ছাপানো সম্ভব হবে। আর অবশিষ্ট বই পেতে অপেক্ষায় থাকতে হবে অন্তত আরও ছয় মাস।

মুদ্রণ শিল্প-সংশ্লিষ্টদের এসব যুক্তিকে আমলে নিতে চান না জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। তাদের কথা, এটা অজুহাত। চুক্তি অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই মুদ্রণকারীদের পাঠ্যবই সরবরাহ করতে হবে। নইলে করোনাভাইরাসে শিখন ঘাটতির পর আরও একবার শিক্ষা খাত ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হবে।

আগামী বছরের জন্য প্রায় ৩৪ কোটি ৬১ লাখ ৬৩ হাজার পাঠ্যবই ছাপানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। এর মধ্যে প্রাক-প্রাথমিক থেকে প্রাথমিক স্তরের ৯ কোটি ৯ লাখ ৫৩ হাজার এবং মাধ্যমিক স্তরের জন্য ২৪ কোটি ৬৩ লাখ ১০ হাজার পাঠ্যবই ছাপানো হবে।

মুদ্রণ শিল্প সমিতি বলছে, কাগজের সংকট তো আছেই, বেড়েছে কালির দাম। এ ছাড়া বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকট, ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে এলসি করতে না পারায় কাগজ তৈরির মণ্ড (পাল্প) আমদানি করতে পারছেন না মিল মালিকরা। মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দেখা দিয়েছে বিদ্যুতের লোডশেডিং।

সমিতির সাধারণ সম্পাদক জহুরুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সম্প্রতি (২৯ অক্টোবর) এক অনুষ্ঠানে প্রাসঙ্গিক কারণে সংকটের কথা তুলে ধরলে সেখানে উপস্থিত শিক্ষামন্ত্রী তার জবাব দেন। তিনি জানিয়েছেন, পাঠ্যবই মুদ্রণ ডিসেম্বরের মধ্যেই শেষ করতে হবে।

‘মন্ত্রী মহোদয়ের আল্টিমেটাম অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ে শতভাগ বই দেয়া সম্ভব হবে না। বড়জোর ৩০ থেকে ৩৫ ভাগ বই সরবরাহ করা যাবে ডিসেম্বরের মধ্যে। বাকি বই পুরোপুরি সরবরাহ করতে জুন পর্যন্ত সময় লাগবে।’

কেন সম্ভব হবে না তা জানতে চাইলে মুদ্রণ শিল্পের এই প্রতিনিধি বলেন, ‘পাল্প (মণ্ড) নেই। এই শিল্প-সংশ্লিষ্ট সবই আমদানি করতে হয়। অথচ ডলারের দাম বেশি। আরেকটি বড় সমস্যা লোডশেডিং।’

শেষ পর্যন্ত ডিসেম্বরের মধ্যে ৩০/৩৫ ভাগ বই ছাপা হলেও সেগুলো কোন শ্রেণির জন্য হবে, এমন প্রশ্নও দেখা দিয়েছে।

মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘৩৫ ভাগ বই মানে এমন নয় যে বাকি ৭০ ভাগ শিক্ষার্থী বই পাবে না। সব মিলিয়ে ৩৫ ভাগ হবে। কোনো শ্রেণিতে সব বই যেতে পারে, আবার কোনো শ্রেণিতে বই নাও যেতে পারে।’

শ্রেণি ধরে পরিষ্কার হিসাব দিতে না পারলেও জহুরুলের দাবি, অষ্টম ও নবম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ের মুদ্রণ যথা সময়ে শেষ হবে।

তিনি বলেন, ‘বিষয়টি নির্ভর করে মুদ্রণকারীদের ওপর। যে আগে অর্ডার পাবে সে সেটি আগে দেবে। এখন পর্যন্ত ক্লাস সেভেনের ডামিও হাতে আসেনি মুদ্রণে। আবার প্রাইমারির ডামিও এখনও সব পাস হয়নি। যে বই আগে পাস হবে সেটিই আগে যাবে। অষ্টম ও নবম শ্রেণির ডামি আগে পাস হয়েছে বিধায় এই শ্রেণির বই শতভাগ সরবরাহ হবে।’

মুদ্রণ-সংশ্লিষ্টদের এসব কথা আমলে নিতে চায় না এনসিটিবি। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মো. ফরহাদুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আপনি (মুদ্রণ মালিক) যাবতীয় শর্ত মেনে আমাদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন। তাহলে কেন আপনি জুনের কথা বলবেন? আমরা উনাদের ওইসব শর্ত মানি না। আমরা এখন অনেক ভালো অবস্থানে আছি। মুদ্রণ শিল্প সমিতি প্রত্যেক বছর শেষদিকে এসে এক-একটা অজুহাত দাঁড় করিয়ে সুবিধা নিতে চায়।’

তিনি বলেন, ‘তারা এখন কেন বলবে যে মণ্ড পাচ্ছে না। আমরা সেদিন যখন বসলাম তখন মন্ত্রী মহোদয় কাগজ আমদানির কথা বললে তারা জানিয়েছিল লাগবে না। তারা তো সম্মত হয়েছিল। নইলে আমরা তখনই কাগজ আমদানির উদ্যোগ নিতাম।’

এনসিটিবির অনড় অবস্থানে অসন্তুষ্ট মুদ্রণ মালিকরা। এ নিয়ে জহুরুল বলেন, ‘উনারা (এনসিটিবি) তো বাস্তবতা বুঝতে চান না। দায়িত্বশীল পোস্টে যারা আছেন তারা গা বাঁচানোর জন্য সব হয়ে যাবে, সব ঠিক আছে, এ ধরনের কথা বলেন।

‘এবার ৩০ ভাগ দিয়েই শুরু করবে বই উৎসব। বাকি বই আস্তে আস্তে যাবে। এ ছাড়া আমার কাছে কোনো সমাধান নেই। বাকিটা চেয়ারম্যান (এনসিটিবি) সাহেব বলতে পারবেন।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক মুদ্রণ ব্যবসায়ী বলেন, ‘এটা একটা জটিল বিষয়। অনেকেই ভাসা ভাসা কথা বলেন। যেখানে কাগজ নেই সেখানে মন্ত্রী বা এনসিটিবি কী বলেন সেটা তো ইস্যু হতে পারে না আমাদের জন্য।’

জহুরুল বলেন, ‘পাঠ্যবই মুদ্রণে প্রয়োজনীয় কাগজ উৎপাদনের দায়িত্ব পেয়েছে সাতটি পেপার মিল। এর মধ্যে ওয়েস্টেজ পেপার দিয়ে যে মিলগুলো বানাচ্ছে তারা হয়তো কিছু উৎপাদনে আসবে, কিন্তু পাল্পে যারা আছে, সেখানে আমরা ছাড়া কেউ নেই। আর লিপি কিছু বানাচ্ছে। এ ছাড়া সব ওয়েস্টেজ থেকে বানাচ্ছে। আবার দেখা যাচ্ছে ওয়েস্টেজও নেই।

‘কার্যাদেশ অনুযায়ী বই ছাপাতে হলে কাগজের প্রয়োজন হবে এক লাখ ২০ হাজার টন, কিন্তু ৩০ হাজার টনের বেশি কাগজ মিলগুলোর কাছে জোগাড় নেই।’

এমন সমস্যা কী এবারই হয়েছে, নাকি অন্য বছরগুলোতেও এসব সমস্যা থাকে, এমন প্রশ্নের জবাবে জহুরুল বলেন, ‘পাল্পের এমন আকাশচুম্বী দাম ছিল না।’

প্রাথমিকের কোনো বই এখনও ছাপাই শুরু হয়নি। মাধ্যমিকের বই ছাপানোর কাজ অবশ্য চলছে। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত প্রায় ৩ কোটি বই ছাপানোর কাজ শেষ হয়েছে, কিন্তু চাহিদা প্রায় ২৫ কোটি। অন্যদিকে প্রাথমিকের চাহিদা ৯ কোটির বেশি।

রাজধানীর মাতুয়াইলে গিয়ে দেখা যায়, প্রেসগুলোতে চলছে পাঠ্যবই ছাপানোর কাজ, কিন্তু বিদ্যুতের ঘনঘন লোডশেডিংয়ে ছাপায় ব্যাঘাত ঘটছে। এ নিয়ে খুব বিরক্ত মুদ্রণ-সংশ্লিষ্টরা।

কাগজের দাম বেড়ে যাওয়া নিয়েও চিন্তিত তারা। মুদ্রণকারীদের দাবি, জিরো জিএসএম কাগজের দাম বেড়েছে প্রতি টনে প্রায় ২৫ হাজার টাকা। আর ৬০ জিএসএম কাগজের দাম বেড়েছে কয়েক গুণ।

মাতুয়াইলের এক ব্যবসায়ী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ডিসেম্বরের মধ্যে বই সরবরাহ করার। আমরা চেষ্টা করছি, তবে এই সময়ের মধ্যে শতভাগ বই সরবরাহ করা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। সর্বোচ্চ ৬০ ভাগ দেয়া সম্ভব হতে পারে। অন্তত বিদ্যুতের লোডশেডিংটা কমলেও ছাপা কিছুটা বাড়ানো সম্ভব হতো।’

চাহিদামতো কাগজ পাওয়া যায়নি জানিয়ে এই ব্যবসায়ী বলেন, ‘আমরা যোগাযোগ করেছি। আমাদের আশ্বাস দিয়েছেন। আর মিলগুলো বিদ্যুতের জন্য কাগজ তৈরি করতে পারছে না। আমাদের কাগজের চাহিদা ছিল এক হাজার টন। অথচ পেয়েছি তার অর্ধেক।’

বই সময়মতো না পাওয়ার জন্য মুদ্রণ-সংশ্লিষ্টরা দরপত্র আহ্বান প্র্রক্রিয়ায় দেরি হওয়াকেও কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তারা বলছেন, অন্য সময়ে নভেম্বরের মধ্যে অর্ধেকের বেশি বই ছাপা হয়ে যায়।

এবার দরপত্রের কাজ শেষ হয়েছে মে মাসে। আর এ কারণে এবার মাধ্যমিকের বই ছাপানো অক্টোবরে শুরু হলেও প্রাথমিকের বই ছাপানো শুরুই হয়নি। আবার ওয়েস্টেজ কাগজ ব্যবহারের ফলে বইয়ের মান নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে।

প্রাথমিকের বই ছাপানো বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হবে জানিয়ে এনসিটিবি চেয়ারম্যান বলেন, ‘ইতিমধ্যে কাগজের ছাড় শুরু হচ্ছে। এই সংকট থাকবে না। টেন্ডার মে মাসে হোক আর জুন মাসে হোক এটার সঙ্গে মিল মালিকের সম্পর্ক নেই। তারা কাগজ উৎপাদন করবে। আর আমি টেন্ডারে সময় কম দিয়েছি। সেটা তো বিবেচনা করেছি সময়স্বল্পতা বিবেচনা করেই।’

পেপার মিলগুলো এটাকে সুযোগ হিসেবে নিয়ে কাগজের দাম বাড়াতে চায় বলে মনে করেন ফরহাদুল ইসলাম।

তিনি বলেন, ‘প্রত্যেকবার তারা এমন বলে। প্রেস মালিকরা জানেন বই দিতে হবে। তারা জানেন এটা রাজনৈতিক একটি ইস্যু। সরকার বই দিতে চাইবে।

‘আমরা সেই সুবিধা নিতে চাই। এই ধরনের চালাকি তারা প্রতি বছর করে আসছে। এবার দেখি আমরা, আগামীবার তো আবার অনেক রকম সিদ্ধান্ত মন্ত্রণালয় নেবে, তখন দেখা যাবে।’

শেষ পর্যন্ত ৫০ ভাগ বই সরবরাহ পেলেও ১ জানুয়ারির বই উৎসব ভালোভাবেই সম্পন্ন হবে বলে আশাবাদী এনসিটিবি চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, ‘কোনো স্কুলেই শতভাগ বই দেয়া হয় না। ৪০ ভাগ বই দেয়া হয়। নবম ও দশম শ্রেণিতে তো আরও পরে বই পায়, তবে শেষ পর্যন্ত আমরা ভালো অবস্থানে থাকব। জানুয়ারির ১০ বা ১২ তারিখের মধ্যে শত ভাগ বই দিতে পারব।’

মুদ্রণ সমিতি জানিয়েছে, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির জন্য চুক্তি হওয়ার কথা ৪ নভেম্বর। নিয়ম অনুযায়ী, চুক্তির মেয়াদ থাকবে আগামী বছরের ১৩ জানুয়ারি পর্যন্ত। তাহলে ডিসেম্বরে সব বইয়ের দাবি কীভাবে করা হয়, তা নিয়েও সমিতি বিস্ময় প্রকাশ করেছে।

এ বিভাগের আরো খবর