চলমান এসএসসি পরীক্ষায় দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডে চারটি বিষয়ের পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে।
মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. কামরুল ইসলাম সই করা এক বিজ্ঞপ্তিতে বুধবার এ তথ্য জানানো হয়েছে।
স্থগিত করা বিষয়গুলো হলো গণিত, কৃষিবিজ্ঞান, রসায়ন বিজ্ঞান এবং পদার্থবিজ্ঞান।
কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী উপজেলায় চলতি এসএসসি পরীক্ষার ইংরেজি প্রথম এবং দ্বিতীয় পত্রের প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে কেন্দ্রসচিবসহ তিন শিক্ষককে আটকের পর দিনাজপুর বোর্ডের অধীনে এই ৪ বিষয়ের পরীক্ষা স্থগিত করা হলো।
যদিও অনিবার্য কারণে পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে বলে বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে।
তবে একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের অধীনে আগেই গণিত এবং বিজ্ঞান বিভাগের ৪টি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয়ে গেছে। তাই অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া এসব পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে।’
দুটি বিষয়ের ‘প্রশ্ন ফাঁস’
সোমবার ইংরেজি প্রথম পত্র এবং মঙ্গলবার ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। পরীক্ষার আগের রাতে এই দুই বিষয়ের হাতে লেখা দুটি প্রশ্নপত্র পরীক্ষার পর মূল প্রশ্নপত্রের সঙ্গে হুবহু মিলে যায়; যা মঙ্গলবার ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে।
বলা হচ্ছে, ভূরুঙ্গামারী নেহাল উদ্দিন পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্র থেকে প্রশ্ন দুটি ফাঁস হয়। হাতে লেখা এসব প্রশ্নপত্র পরীক্ষার আগের রাতেই হোয়াটসঅ্যাপসহ বিভিন্ন মাধ্যমে পরীক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের হাতে চলে যায়।
বিষয়টি নজরে এলে নড়েচড়ে বসেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। মঙ্গলবার মধ্যরাতে প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে ভূরুঙ্গামারী নেহাল উদ্দিন পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও কেন্দ্রসচিব লুৎফর রহমান, ইংরেজি বিষয়ের সহকারী শিক্ষক রাসেল আহমেদ এবং ইসলাম শিক্ষা বিষয়ের সহকারী শিক্ষক জোবায়েরকে আটক করে পুলিশ।
২০০ থেকে ৫০০ টাকায় মিলেছে প্রশ্ন
নেহাল উদ্দিন পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে আসন পড়েছে এমন একজন শিক্ষার্থীর বর্ণনায়, ‘আমি এই কেন্দ্র থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছি। হলরুমে অনেক শিক্ষার্থী আলোচনা করে, তারা ২০০ থেকে ৫০০ টাকায় প্রশ্নের উত্তরপত্র পেয়েছে। এভাবে যদি পরীক্ষার প্রশ্ন আউট হয়, তাহলে আমরা ভালো পরীক্ষা দিয়ে কী লাভ?’
বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে প্রশ্ন পত্র ফাঁসের আলাপ শুনেছেন চানাচুর বিক্রেতাও। তার ভাষ্য, ‘দুই দিন থেকে পরীক্ষার্থীদের অভিভাবকরা এখানে গল্প করেন, প্রশ্ন পত্র ফাঁস হয়েছে। তারা ২০০ হতে ৫০০ টাকায় প্রশ্ন কিনতে পাওয়া যায় বলেও গল্প করেছিলেন। তবে কেনা-বিক্রি করা আমি দেখিনি।’
কলেজের ইংরেজি প্রভাষক মাইদুল ইসলাম মুকুল বলেন, ‘আমি এইচএসসি ব্যাচের শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়াই। সেখানকার এবং কলেজের অনেক শিক্ষার্থী আমার কাছে হাতে লেখা প্রশ্ন নিয়ে আসে সমাধানের জন্য। পরে জানতে পারি কুড়িগ্রাম, রংপুর, ভূরুঙ্গামারী থেকে বিভিন্নজনের মাধ্যমে এগুলো পেয়েছে। বিষয়টি পরে স্থানীয় প্রেস ক্লাবসহ প্রশাসনকে অবহিত করি।’
মধ্যরাতে মামলা, গ্রেপ্তার ৩
ঘটনা জানতে পেরে মঙ্গলবার রাতেই দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান কামরুল ইসলাম, সচিব জহির উদ্দিন, জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রেজাউল করিম, পুলিশ সুপার আল আসাদ মো. মাহফুজুল ইসলাম, জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শামছুল আলমসহ সংশ্লিষ্টরা কয়েক দফায় বৈঠক করেন।
প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে ভূরুঙ্গামারী নেহাল উদ্দিন পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও কেন্দ্রসচিব লুৎফর রহমান, ইংরেজি বিষয়ের সহকারী শিক্ষক আমিনুর রহমান এবং ইসলাম শিক্ষা বিষয়ের সহকারী শিক্ষক জোবাইর হোসেনকে রাতে থানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এ সময় উপরোল্লিখিত কর্মকর্তারাও সেখানে ছিলেন।
জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তিনজনকে থানায় রেখে সেখান থেকে ইউএনওর কার্যালয়ে যান কর্মকর্তারা। রাতে সাড়ে ১২টার দিকে বেরিয়ে এলেও সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা না বলে দ্রুত চলে যান দিনাজপুর বোর্ডের চেয়ারম্যান কামরুল ইসলামসহ অন্যরা।
কিছু সময় পর ওই কেন্দ্রসচিবসহ তিনজনকে গ্রেপ্তারের কথা জানান অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মাহমুদুল হাসান।
জানা গেছে, এ ঘটনায় মঙ্গলবার মধ্য রাতেই মামলা হয়েছে। নেহাল উদ্দিন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা আদম মালিক চৌধুরীর করা মামলাটিতে মো. লুৎফর রহমান, জোবাইর হোসেন, মো. আবু হানিফ ও মো. আমিনুর রহমানসহ অজ্ঞাতপরিচয় ১০/১৫ জনকে আসামি করা হয়েছে।
তবে প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুর রহমান। নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি ভূরুঙ্গামারী থেকে কোনো প্রশ্ন পত্র ফাঁস হয়নি।’
এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘মিল-অমিল আছে কি না আমার দেখার বিষয় না। সরকারের অনেক বিভাগ আছে, পুলিশ আছে; এটা তাদের দায়িত্ব।’
ভূরুঙ্গামারী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আলমগীর হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের একটি মামলা হয়েছে। তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী আরও দুজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। ঘটনার সঙ্গে যারাই জড়িত থাকুক তাদেরকে ধরা হবে।’
এজাহারে যা বলা হয়েছে
মঙ্গলবার কেন্দ্র সচিব ও প্রধান শিক্ষক লুৎফর রহমানকে সঙ্গে নিয়ে আদম মালিক চৌধুরী ভূরুঙ্গামারী থানা থেকে সীলমোহর অক্ষত অবস্থায় ইংরেজি দ্বিতীয় পত্র প্রশ্নের দুটি প্যাকেট সংগ্রহ করেন। পরে তারা প্রশ্নপত্র নিয়ে নেহাল উদ্দিন বালিকা উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে আসেন। কেন্দ্রে পৌঁছানোর পর লুৎফর রহমান তার নিজ কক্ষের একটি বইয়ের তাকে প্রশ্নপত্রের প্যাকেট দুটি রাখেন। আনুমানিক সকাল ১০টা ৩৫ মিনিটের দিকে আদম মালিক চৌধুরী কেন্দ্র সচিবের কক্ষে যান। এ সময় কেন্দ্র সচিব প্যাকেট খুলে প্রশ্নপত্র বের করেন। পরে ১০টা ৫০ মিনিটে প্রশ্নপত্রগুলো কেন্দ্রের কক্ষভিত্তিক দায়িত্বরত শিক্ষকদের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
ওই দিন আনুমানিক বেলা দেড়টার দিকে তিনি ওই কেন্দ্র সচিবের মাধ্যমে প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ উঠেছে বলে জানতে পারেন। তাৎক্ষণিকভাবে তিনি বিষয়টি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) দীপক কুমার শর্মাকে জানান। পরীক্ষা শেষে ইউএনও দীপক কুমার শর্মার উপস্থিতিতে লুৎফর রহমানকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে লুৎফর কোনো সন্তোষজনক জবাব দিতে পারেননি।
এজাহারের নথি অনুযায়ী, জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে লুৎফর স্বীকার করেন, তার কাছে পরের একাধিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র আছে। এরপর লুৎফর রহমানের কক্ষের বইয়ের তাক থেকে একটি কাপড়ের ব্যাগ পাওয়া যায়। ওই ব্যাগের ভেতর থেকে গণিত, উচ্চতর গণিত, কৃষিশিক্ষা, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ও জীববিজ্ঞানের প্রশ্নপত্রের প্যাকেট উদ্ধার করা হয়। এর মধ্যে একটি প্যাকেট ছাড়া সব কটি প্যাকেটের মুখ খোলা ছিল।
এ সময় সেখানে উপস্থিত ভূরুঙ্গামারী থানার উপপরিদর্শক (এসআই) সাঈদ মো. আতিক নুর প্রশ্নপত্রগুলো জব্দ করেন এবং লুৎফর রহমানকে আটক করেন।
অধিকতর জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে লুৎফর বলেন, পূর্বপরিকল্পিতভাবে বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আবু হানিফের সহায়তায় কৌশলে প্রশ্নপত্রের প্যাকেটগুলো কেন্দ্রে নিয়ে আসা হয়। পরে প্রশ্নপত্রগুলো আবু হানিফ, অন্য দুই শিক্ষক জোবাইর হোসেন, আমিনুর রহমানসহ অজ্ঞাতনামা ১০ থেকে ১৫ জনের মাধ্যমে গোপনে প্রশ্নগুলো ফাঁস করে দেয়া হয়।
তদন্ত কমিটি
দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর মো. কামরুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় আমরা একটা তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। রিপোর্ট পেলে পরবর্তী সময়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।'
এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘যেসব বিষয়ে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে, সেসব বিষয়ে কোনো সমস্যা নাই।’
দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের সচিব প্রফেসর জহির উদ্দীন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কুড়িগ্রামে প্রশ্নপত্র ফাঁসের কারণে ৪টি পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’