বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

ঢাবিতে ‘আদব-কায়দা’র তালিকা: দায় এড়াচ্ছে ছাত্রলীগ

  •    
  • ২২ আগস্ট, ২০২২ ১৯:৫৩

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন বলেন, ‘সাম্প্রদায়িক মৌলবাদীদের পৃষ্ঠপোষক ছাত্র অধিকার পরিষদ এই ভুয়া লিফলেট ছড়িয়েছে। তথ্য-সন্ত্রাসের আশ্রয় নিয়ে তারা এই লিফলেট তৈরি করে ছাত্রলীগের নামে চালিয়ে দিয়েছে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলে শিক্ষার্থীদের ‘আদব-কায়দা’ শেখানোর তালিকাটির সঙ্গে ছাত্র অধিকার পরিষদ জড়িত বলে দাবি করেছে ছাত্রলীগ। যদিও তালিকার নির্দেশনার অধিকাংশই ছাত্রলীগের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট।

‘জিয়া হলে থাকতে হলে…’ শিরোনামে ১৪টি নির্দেশনা সংবলিত একটি তালিকা দরজায় সাঁটানোর ঘটনাটি সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এসব নির্দেশনার একটি হলো ছাত্রলীগের প্রোগ্রামে বাধ্যতামূলক অংশগ্রহণ।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন বলেন, ‘ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে এ ধরনের লিফলেট কখনোই দেয়া হয়নি। সাম্প্রদায়িক মৌলবাদীদের পৃষ্ঠপোষক ছাত্র অধিকার পরিষদ এই ভুয়া লিফলেট ছড়িয়েছে। সুস্পষ্টভাবে তথ্য-সন্ত্রাসের আশ্রয় নিয়ে তারা এই লিফলেট তৈরি করে ছাত্রলীগের নামে চালিয়ে দিয়েছে।’

সাদ্দাম হোসেনের এমন অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে ছাত্র অধিকার পরিষদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক আকরাম হোসেন বলেন, ‘ওনার এই অভিযোগ হাস্যকর। ছাত্র অধিকার পরিষদ নয়, লিস্টটি ছাত্রলীগেরই বানানো। আর ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরাই এই লিস্ট ছড়িয়েছে।

‘গুজব ছড়ানো এবং মিথ্যা বলার ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে ছাত্রনেতাদের মধ্যে উনি রেকর্ড করে ফেলেছেন। হলগুলোতে ম্যানার শেখানোর নামে কারা ছাত্রদের নির্যাতন করে সেটা সবাই জানে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলে কক্ষের সামনে টানানো তালিকা। ছবি: সংগৃহীত

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হলের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের কক্ষের দরোজায় দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রলীগের কর্মীরা এই নির্দেশনার তালিকা সেঁটে দেন। শিক্ষার্থীদের ম্যানার শেখানোর নামে ছাত্রলীগ কর্মীরা এসব নিয়ম তৈরি করেন।

হলটির প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরাও বলছেন, তারা যখন হলে উঠেছেন তখন থেকে কয়েকদিন আগ পর্যন্ত তাদের রুমের দরজার সামনে তালিকাটি সাঁটানো ছিল। তবে এখন দ্বিতীয় বর্ষে উঠে যাওয়ায় কয়েকদিন আগে তারাই সেটি ছিঁড়ে ফেলেছেন।

শুধু জিয়া হল নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ছাত্রহলের চিত্র একইরকম। অন্যান্য হলে এসব নির্দেশনা মৌখিকভাবে জানানো হতো আর জিয়া হলে লিখিত আকারে সাঁটানো হয়েছে, পার্থক্য এতটুকুই।

এসব নির্দেশনা অমান্যের শাস্তিও সব হলে একইরকম। এসব নির্দেশনার একটিও প্রথম বর্ষের কোনো শিক্ষার্থী লঙ্ঘন করলে রাত হলেই গেস্টরুমে তার ওপর নেমে আসে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন।

মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলে বর্তমানে প্রথম বর্ষের জন্য পাঁচটি রুম আছে। এর তিনটি নিয়ন্ত্রণ করেন হল ছাত্রলীগের সভাপতি আজহারুল ইসলাম মামুন। অন্য দুটি নিয়ন্ত্রণ করেন সাধারণ সম্পাদক হাসিবুল হোসেন শান্ত।

এই হলের ১১১ নম্বর কক্ষের এক শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘ফেসবুকে লিস্টটা আমি পড়েছি। আমাদের রুমের সামনে যেটা সাঁটানো ছিল সেটা আর এটার মধ্যে ভাষাগত কিছু পার্থক্য আছে। তবে মোটামুটি একই। এগুলোর একটিও কেউ লঙ্ঘন করলে সেদিন তার কপালে খারাবি আছে।

‘বিশেষ করে ছাত্রলীগের প্রোগ্রামে অংশগ্রহণের ব্যাপারে কোনো ছাড় নেই। বড় ভাইদের কাছ থেকে ছুটি না নিয়ে কেউ ছাত্রলীগের প্রোগ্রামে অনুপস্থিত থাকলে তাকে এক রাতের জন্য হল থেকে বের করে দেয়া হয়। আমাকেও একদিন হল থেকে বের করা দেয়া হয়েছে।’

জিয়া হলের দ্বিতীয় বর্ষের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘প্রথম বর্ষে আমি হল ছাত্রলীগের এক ক্যান্ডিডেট সোবাইল ভাইয়ের গ্রুপে ছিলাম। ২২৮ নম্বর কক্ষে থাকতাম। তখন আমাদের কক্ষের দরজার সামনে এটি সাঁটানো ছিল। কয়েকদিন আগেও সেটি দেখেছি। এখন দেখছি সেটি নেই। ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ার পর হয়তো কেউ এটি সরিয়ে ফেলেছে।’

হল ছাত্রলীগের সভাপতি আজহারুল ইসলাম মামুন বলেন, ‘আমি লিস্টটা দেখেছি। এটি একটি ভুয়া লিস্ট। হল ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে অফিসিয়ালি তাদেরকে এ ধরনের কোনো নির্দেশনা দেয়া হয়নি। আর সেই লিস্টে জিয়া হল লেখা ছিল। আমরা সাংগঠনিকভাবে এটি বলি না। আমরা মুক্তিযোদ্ধা হল ছাত্রলীগ বলি। এটা হয়ত কেউ বানিয়েছে।’

ছাত্রলীগের প্রোগ্রাম করেই প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের হলে থাকতে হয়- এমন অভিযোগের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ, তবে হলে থাকতে হলে ছাত্রলীগের প্রোগ্রামে যেতেই হয় এমনটা নয়। যাদের ইচ্ছা রাজনীতি করবে তারা প্রোগ্রাম করে।’

প্রোগ্রাম না করলে সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হয় কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কিছুদিন আগে তিনটি ছেলের সমস্যা ছিল। তারা নিজেদের মধ্যে ঝামেলা করেছে। পরে আমি তাদেরকে ডেকে হলে তুলে দিয়েছি।’

‘আদব-কায়দা’র তালিকার যতো নির্দেশনা

হলের ভেতরে ও বাইরে সব বড় ভাইকে সালাম দিতে হবে। সালাম দেয়ার সময় ডান হাত দিয়ে হ্যান্ডশেক করতে হবে। হ্যান্ডশেকের সময় বাম হাত পেছনে রাখতে হবে। হাতে ঝাঁকি বা চাপ দেয়া যাবে না। হাত বুকে রাখা যাবে না। মসজিদ, টিভিরুম, রিডিংরুম, বাথরুম, ক্যানটিন, মেস, ওয়াফাই জোন ও সেলুন দোকানে সালাম দেয়া যাবে না। একসঙ্গে অনেক বড় ভাই থাকলে চেইন অব কমান্ড অনুযায়ী সালাম দিতে হবে।

‘প্রত্যেক বড় ভাই ও ইয়ারমেটের নম্বর রাখতে হবে। ছাত্রলীগের সব প্রোগ্রামে নিয়মিত অংশগ্রহণ করতে হবে। সমস্যা থাকলে ইমেডিয়েট বড় ভাইদের বলতে হবে। লুঙ্গি, ট্রাউজার, টি-শার্ট ও মোবাইল প্যান্ট পরে গেস্টরুমে আসা যাবে না। এমনকি রাত ১২টার পর এগুলো পরে রুমের বাইরে আসা যাবে না। ক্যান্টিনে প্রথম ৪টি সারিতে বসা যাবে না এবং ক্যান্টিন বয়দের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করা যাবে না। টিভিরুমের প্রথম সারির চেয়ারগুলোতে বসা যাবে না এবং রিমোট হাতে নেয়া যাবে না।

চেইন অফ কমান্ড মানতে হবে। বড় ভাইদের অনুমতি ব্যতীত কোনো রুমে যাওয়া যাবে না। বড় রিডিং রুম ব্যবহার করতে হবে, কোনোভাবেই ছোট রিডিং রুমে প্রবেশ করা যাবে না। হলে ধূমপান করা যাবে না। তবে রুমে পরিবেশ থাকলে ধূমপান করা যাবে। হলে থেকে ছাত্রলীগ ব্যতীত অন্য কোনো সংগঠন করা যাবে না। যেমন- ছাত্রদল, ছাত্রশিবির ও বাম সংগঠন করা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। ছাত্রলীগ ব্যতীত অন্য কোনো সংগঠন করলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। হলের যেকোনো ব্যাপারে ইমেডিয়েট বড় ভাইদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে।

হল প্রাধ্যক্ষের ছাত্রলীগ-প্রীতির অভিযোগ

মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলের শিক্ষার্থীদের অনেকের অভিযোগ, হল প্রশাসন ছাত্রলীগকে তোয়াজ করে চলেন। হলে কার্যত প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ নেই বললেই চলে। শিক্ষার্থীরা বলছেন, হল প্রশাসন এখানে ঠুঁটো জগন্নাথ। তারা বরং ছাত্রলীগের সঙ্গে লিয়াজোঁ করে চলেন। প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের ম্যানার শেখানোর নামে গেস্টরুমে প্রতিদিন নির্যাতন চললেও তা দেখেও না দেখার ভান ধরেন হল প্রাধ্যক্ষ।

প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের ছাত্রলীগের নিয়ম মেনে হলে থাকতে হয়- এমন অভিযোগের ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করেন হল প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক বিল্লাল হোসেন। তিনি বলেন, ‘সেই লিস্টটা সম্পর্কে আমি অবগত নই। হল প্রাঙ্গণের কোথাও আমি এই লিস্ট দেখিনি। দেখলে আমি অবশ্যই প্রশাসনিকভাবে ব্যবস্থা নিতাম। কে বিজ্ঞপ্তিটা দিল আর কোথা থেকে বিজ্ঞপ্তিটা এলো সে বিষয়েও খোঁজ নিতাম।‘

শিক্ষার্থীরা তালিকা থাকার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন জানালে তিনি বলেন, ‘আমি মাঝে মাঝে ভিজিটে যাই। ভিজিটে গেলেও দরজায় কী লেখা আছে সেটি আমি জানি না। মূলত পাবলিক প্লেসে এটি আমি দেখিনি।’

হলের গেস্টরুমে শিক্ষার্থীদের মানসিক নির্যাতন করার অভিযোগের বিষয়ে প্রাধ্যক্ষ বলেন, ‘আমার হলে গেস্টরুমের সামনে সিসিটিভি আছে। প্রতিটি ফ্লোরে দুটি করে সিসিটিভি আছে। আমি কখনো এরকম কিছু দেখিনি।’

হল প্রশাসন ঠুঁটো জগন্নাথ- শিক্ষার্থীদের এই অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক বিল্লাল বলেন, ‘সবাই আসলে চিলে কান নিয়ে গেছে শুনেই তা বিশ্বাস করে। আসলে কানটা আছে কি না সেটি খুঁজে দেখে না। কোন ছাত্র আমার কাছে অভিযোগ দেয়ার পর আমি তার কোনো ক্ষতির কারণ হয়েছি বা ব্যবস্থা নেইনি এরকম কোনো এভিডেন্স নেই।

‘ঠুঁটো জগন্নাথ শব্দটি আমি গ্রহণ করতে পারব না। আমার কাছে কেউ এলে বিষয়গুলো সমাধান করার চেষ্টা করি। আমার চেষ্টার ঘাটতি নেই।’

এ বিভাগের আরো খবর