বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

পরীক্ষায় ১১ পাওয়া রূপাকে মেডিক্যালে ভর্তির চেষ্টা

  •    
  • ১৪ জুলাই, ২০২২ ০০:০৩

তালিকায় থাকা ৯৯০৮৩৯২ রোল নম্বরের শিক্ষার্থীর নাম হুমাইরা বিনতে কবির রূপা। ১০০-তে তার প্রাপ্ত নম্বর ১১ দশমিক ৭৫। ফলাফল স্ট্যাটাসে উল্লেখ আছে ‘অনুত্তীর্ণ’। ১৯১৪৮৪৭ রোল নম্বরটি শিক্ষার্থী আফসানা মীমের। তার প্রাপ্ত নম্বর ১৮ দশমিক ২৫, ফলাফল স্ট্যাটাস ‘অনুত্তীর্ণ’।

রাজধানীর গুলশানে অবস্থিত বেসরকারি সাহাবউদ্দিন মেডিক্যাল কলেজে ২০২১-২২ সেশনে এমবিবিএস ভর্তিতে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। মেডিক্যালের ভর্তি পরীক্ষায় ফেল করা দুই শিক্ষার্থীকে অনৈতিকভাবে ভর্তির সুযোগ করে দিতে চেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। তাদের এ ভর্তি কেলেঙ্কারি নিয়ে বিস্তর সমালোচনা চলছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।

সমালোচনার মুখে মেধাতালিকা বদলে ফেলেছে সাহাবউদ্দিন মেডিক্যাল। ঘটনা ধামাচাপা দিতে গিয়ে করেছে তারা আরেক কারসাজি। নিউজবাংলার অনুসন্ধানে মিলেছে অনিয়মের ভয়ঙ্কর চিত্র।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, এ বছরের এমবিবিএস পরীক্ষার ন্যূনতম পাস মার্ক ৪০ হলেও সাহাবউদ্দিন মেডিক্যাল কলেজে ভর্তির সুযোগ পাওয়া দুই শিক্ষার্থীর একজন পেয়েছেন ১১ দশমিক ৭৫, অপরজন ১৮ দশমিক ২৫ নম্বর। দুজনেই ‘অকৃতকার্য’ হয়েছেন। অথচ সাহাবউদ্দিন মেডিক্যাল কলেজে ভর্তিতে যোগ্যদের তালিকায় আছে দুজনেরই রোল নম্বর। ভর্তিযোগ্য প্রথম ৪৩ জনের তালিকায় দুই শিক্ষার্থীকে জায়গা দিয়ে তাদের ভবিষ্যৎ ডাক্তার হওয়ার সুযোগ করে দিতে চেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

ফেল করা দুই শিক্ষার্থীকে ভর্তি করতে চেয়েছিল সাহাবউদ্দিন মেডিক্যাল কলেজ। ছবি: নিউজবাংলা

সরকারি ও বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষা হয় গত ১ এপ্রিল। মোট ১ লাখ ৪৩ হাজার ৯১৫ জন পরীক্ষার্থী আবেদন করেন। পরীক্ষায় পাস করেছেন ৭৯ হাজার ৩৩৯ জন। পাসের হার ৫৫ দশমিক ১৩ শতাংশ। সারা দেশে সরকারি ৩৭টি মেডিক্যাল কলেজে মোট আসনসংখ্যা ৪ হাজার ৩৫০টি। বেসরকারি ৭২টি মেডিক্যাল কলেজ মিলিয়ে মোট আসন ১০ হাজার ৮২৯টি।

হিসাব অনুযায়ী, ভর্তি পরীক্ষায় পাস করা ৭৯ হাজার ৩৩৯ জনের মধ্য থেকে মেধাতালিকার শীর্ষ ১১ হাজার শিক্ষার্থী ডাক্তার হওয়ার সুযোগ পাবেন। ফেল করা অথবা মেধাতালিকার শেষে থাকা শিক্ষার্থীদের সুযোগ নেই ভর্তির।

ধারাবাহিকভাবে সরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলোতে ভর্তি প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে। পরে গত ৭ জুলাই দেশের বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলো তাদের আসনসংখ্যা অনুযায়ী ভর্তিযোগ্য শিক্ষার্থীদের তালিকা প্রকাশ করে। এদিন ৭০টি আসনের বিপরীতে ৪৩ জন ভর্তিযোগ্য শিক্ষার্থীর তালিকা প্রকাশ করে সাহাবউদ্দিন মেডিক্যাল কলেজ। তাদের বাকি আসন বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য বরাদ্দ।

শিক্ষার্থীদের ভর্তির জন্য ১৪ থেকে ১৭ জুলাই সময় নির্ধারণ করে দেয় কলেজ কর্তৃপক্ষ। কিন্তু এরই মধ্যে ভর্তিচ্ছু কয়েকজন শিক্ষার্থী ও দেশের স্বনামধন্য একাধিক চিকিৎসক নিউজবাংলার কাছে অভিযোগ করে জানান, ভর্তিতে দুর্নীতি করছে প্রতিষ্ঠানটি। প্রতিষ্ঠানটি যে মেধাতালিকা প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, অন্তত এমন দুজন শিক্ষার্থীর রোল নম্বর আছে যারা পরীক্ষায় পাসই করেননি।

অভিযোগের সত্যতা জানতে অনুসন্ধানে নামে নিউজবাংলা। মেডিক্যাল কলেজটি যে তালিকা ক্যাম্পাসের নোটিশ বোর্ডে ঝুলিয়েছিল সেটির একটি ছবি সংগ্রহ করা হয়। তাতে দেখা যায়, ৪৩ জনের রোল নম্বর উল্লেখ করা হয়েছে। তাদের ১৪ থেকে ১৭ জুলাইয়ের মধ্যে ভর্তি হতে বলা হয়েছে।

ওই তালিকায় থাকা সন্দেহভাজন দুই শিক্ষার্থীর রোল নম্বর ৯৯০৮৩৯২ ও ১৯১৪৮৪৭। মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল যে সরকারি ওয়েবসাইটে আছে সেখানে এই দুই রোল নম্বরের তথ্য যাচাই করে পাওয়া যায় ভয়ঙ্কর তথ্য। দেখা যায়, দুই শিক্ষার্থীর কেউই ভর্তি পরীক্ষায় পাস করেননি।

তালিকায় থাকা ৯৯০৮৩৯২ রোল নম্বরের শিক্ষার্থীর নাম হুমাইরা বিনতে কবির রূপা। ১০০-তে তার প্রাপ্ত নম্বর ১১ দশমিক ৭৫। ফলাফল স্ট্যাটাসে উল্লেখ আছে ‘অনুত্তীর্ণ’। ১৯১৪৮৪৭ রোল নম্বরটি শিক্ষার্থী আফসানা মীমের। তার প্রাপ্ত নম্বর ১৮ দশমিক ২৫, ফলাফল স্ট্যাটাস ‘অনুত্তীর্ণ’।

কলেজ কর্তৃপক্ষের লুকোচুরি

দুই শিক্ষার্থী পরীক্ষায় পাস না করেও কীভাবে ভর্তির যোগ্যতা অর্জন করেছেন, তা জানতে নিউজবাংলার প্রতিবেদক মঙ্গলবার দুপুরে যান গুলশানের সাহাবউদ্দিন মেডিক্যাল কলেজ ভবনে। সেখানে প্রথমেই নোটিশ বোর্ডের তালিকা যাচাই করতে গেলে দেখা যায় বোর্ডটি এখন ফাঁকা।

দুই শিক্ষার্থীর মধ্যে এক শিক্ষার্থীর তথ্য প্রকাশ পাওয়ায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাহাবউদ্দিন মেডিক্যালের দুর্নীতি নিয়ে সমালোচনা শুরু হলে নোটিশ বোর্ড থেকে ওই তালিকাটি সরিয়ে নেয় কর্তৃপক্ষ। শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে এ তথ্য জানা যায়।

সমালোচনার মুখে নোটিশ বদলে ফেলেছে সাহাবউদ্দিন মেডিক্যাল কলেজ। ছবি: নিউজবাংলা

কলেজে ঈদের ছুটি থাকলেও মঙ্গলবার ব্যস্ততা দেখা যায় প্রশাসনিক ব্লকে। দফায় দফায় বৈঠকে ব্যস্ত কলেজ পরিচালনা পর্ষদ।

অন্যরা ব্যস্ত থাকায় প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলেন কলেজটির হিসাবরক্ষণ বিভাগের কর্মকর্তা মহিউদ্দীন।

তিনি বলেন, ‘সাহাবউদ্দিন মেডিক্যাল কলেজে ২০২১-২২ সেশনে আসনসংখ্যা ৭০। নিয়ম অনুযায়ী ৫ শতাংশ অর্থাৎ চারটি আসন দরিদ্র মেধাবী কোটার, আর ২৮টি বিদেশি শিক্ষার্থীর কোটা। সে জন্য ৭০টি আসনের মধ্যে ৪৩টি আসনে মেধাতালিকা অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের ভর্তির জন্য তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে।’

তালিকাটি দেখতে চাইলে মহিউদ্দীন প্রতিবেদককে অপেক্ষা করতে বলেন। কিছু সময়ের জন্য তিনি রুমের বাইরে চলে যান৷ ফিরে তিনি জানান, গত ৭ তারিখ থেকে তালিকাটি নোটিশ বোর্ডে ঝোলানো আছে।

এরপর নোটিশ বোর্ডের সামনে গিয়ে দেখা যায়, কিছুক্ষণ আগেও যে নোটিশ বোর্ড ফাঁকা ছিল সেখানে কয়েক মিনিটের ব্যবধানে ঝুলছে ঝকঝকে নতুন একটি মেধাতালিকা। সেটি যাচাই করে দেখা গেল, নিউজবাংলার কাছে থাকা আগের তালিকার সঙ্গে এই তালিকার কয়েকটি পার্থক্য আছে।

মেধাতালিকায় অন্যসব রোল নম্বর থাকলেও নতুন তালিকায় অনুত্তীর্ণ দুই শিক্ষার্থীর রোল নম্বর নেই। পাশাপাশি যোগ হয়েছে অন্য একজন উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীর রোল নম্বর।

আগের তালিকায় মোট ৪৩ জন শিক্ষার্থীর রোল নম্বর উল্লেখ ছিল। এবারের তালিকায় পাওয়া যায় ৪২ জন শিক্ষার্থীর রোল নম্বর।

তালিকা সংশোধন করা হয়েছে কি না জানতে চাইলে মহিউদ্দীন বলেন, ‘তালিকা সংশোধন করা হয়নি। এই তালিকা গত ৭ তারিখে যেভাবে প্রকাশ করা হয়েছে, এখনও একইভাবে তা ঝুলছে।’

এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘৪৩ জনের তালিকায় ৪২ জন কেন, সেটা আমি বলতে পারছি না। স্যাররা মিটিংয়ে আছেন, একটা ছোট্ট সমস্যা আছে, সেটা সমাধান করার জন্য। মিটিং শেষ হলে আমি তালিকার বিষয়ে নিশ্চিত তথ্য জানাতে পারব।’

অনুত্তীর্ণ দুই শিক্ষার্থীর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আসলে এই বিষয় নিয়েই স্যাররা মিটিং করছেন। আমাদের রেজাল্ট শিটটা এডিট করে, টেম্পারিং করা হয়েছে। কলেজের ইমেজ নষ্ট করার জন্য এ কাজ। স্যাররা এখন মিটিংয়ে যাচাই করে দেখছেন আমাদের পক্ষ থেকে কোলো ভুল ছিল কি না। এ জন্য তালিকাটা নোটিশ বোর্ড থেকে কিছুক্ষণের জন্য সরিয়ে নেয়া হয়েছিল, যাচাই-বাছাই শেষে আবার তা ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে।’

মেডিক্যাল কলেজের ভর্তির তালিকা এডিট করে সুনাম ধ্বংসের পাঁয়তারা চলছে বলে দাবি করা হলেও কেন আইনি পদক্ষেপ নেয়া হয়নি সে বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি হিসাবরক্ষণ বিভাগের এই কর্মকর্তা।

দুটি তালিকাতেই সই ছিল কলেজ অধ্যক্ষ ডা. মো. রুহুল আমিনের। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের তালিকায় অনুত্তীর্ণ শিক্ষার্থীর রোল নম্বর নেই। আমাদের তালিকার ৪৩ জনই উত্তীর্ণ এবং মেধাতালিকায় তাদের অবস্থান আছে।’

তালিকার বিষয়ে তিনি দাবি করেন, ‘৪৩ জনের একটি তালিকা প্রণয়ন ও প্রকাশ করা হয়েছে, এখানে কোনো ধরনের সংশোধন করা হয়নি।’ তালিকায় ৪২ জনের রোল নম্বর আছে জানালে তিনি বলেন, ‘এমনটা হওয়ার কথা নয়, আমি খবর নিয়ে দেখব।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অধীনে থাকা মেডিক্যাল অনুষদের ডিন ডা. শাহরীয়ার নবী শাকিল। অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বিষয়টা আমাদের কানে আসার পর আমরা সাহাবউদ্দিন মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে এর কারণ জানতে চেয়েছি। তারা জানিয়েছেন, এটা একটা ভুল হয়েছে। তাদের যাচাই কমিটি ঠিকমতো আবেদন ফরমগুলো যাচাই করেনি। তবে এটা ইতোমধ্যেই সংশোধন করা হয়েছে।’

নিউজবাংলার অনুসন্ধানে জানা যায়, দুই অনুত্তীর্ণ শিক্ষার্থীর ভর্তির সুযোগ দেয়া নিছক ভুল নয়। আর্থিক সুবিধার বিনিময়ে ফেল করা শিক্ষার্থীদের চিকিৎসক হওয়ার সুযোগ করে দিতে চেয়েছিল সাহাবউদ্দিন মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষ। এমন ঘটনা এর আগেও একাধিকবার ঘটেছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে হাসপাতালটির একজন চিকিৎসক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘প্রতি বছরই এখানে অনিয়মের ঘটনা ঘটে। কলেজে দরিদ্র মেধাবী কোটায় যে চারজন শিক্ষার্থী নেয়ার সুযোগ আছে, তা পরিচালকরা নিজেরা ভাগ করে নেন। এই চার আসনে ৭ থেকে ১০ লাখ টাকার বিনিময়ে একেক জন শিক্ষার্থীর ভর্তির ব্যবস্থা হয়।

‘টাকার বিনিময়ে ভর্তিতে ফেল-পাস বিবেচনা করা হয় না। বিদেশি কোটা নিয়েও চলে রমরমা ব্যবসা। ২৮ জনের কোটায় বড় একটি অংশ ফাঁকা থাকে। তখন সেই সিটগুলো পরিচালকসহ কলেজের ঊর্ধ্বতনরা ভাগ করে নেন। সেসব সিটে ১৫ লাখ থেকে ২০ লাখ টাকায় ভর্তি চলে। মোটা অঙ্কের টাকা ঘুষ দিয়ে যারা ভর্তি হতে আসেন, তাদের অধিকাংশই ফেল করা।’

তালিকা সংশোধনের বিষয়েও তথ্য-প্রমাণ পেয়েছে নিউজবাংলা। ভর্তিচ্ছু একাধিক শিক্ষার্থী কলেজের নোটিশ বোর্ড থেকে তাদের মুঠোফোনে প্রথম তালিকার ছবি তুলে তা সংরক্ষণ করেছিলেন।

তারা জানান, দুই শিক্ষার্থীর একজনের ভর্তি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়লে কলেজ কর্তৃপক্ষ আগের তালিকা নামিয়ে ফেলে। তালিকার ৪৩ জন থেকে দুই শিক্ষার্থীর রোল নম্বর সরিয়ে ফেলার পাশাপাশি উত্তীর্ণ একজন শিক্ষার্থীর রোল নম্বর যোগ করে দেয়। ফলে ৪৩ জনের তালিকা রূপ নেয় ৪২ জনে।

এ বিভাগের আরো খবর