বিভিন্ন বিষয়ে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে জড়িয়ে পড়েছেন শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের (ইইডি) কর্মকর্তারা। তাদের পরস্পরবিরোধী অভিযোগ এবং নিয়োগ কার্যক্রম পরিচালনায় যথাযথ বিধি অনুসরণ না করায় আটকে গেছে ১ হাজার ৪৫৬ পদে চলমান নিয়োগ কার্যক্রম।
এসব পদের মধ্যে ১ হাজার ২৬৫টি পদে নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়। বাকি পদগুলো সংরক্ষিত পদ, যা চলমান নিয়োগের সঙ্গে পূরণের কথা। কিন্তু দুই পক্ষের (প্রশাসন বিভাগের কর্মকর্তা ও প্রকৌশলীরা) অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও নিয়োগবিধি যথাযথ অনুসরণ না করায় পুরো নিয়োগ কার্যক্রমই আটকে গেছে। একই কারণে হঠাৎ করে স্থগিত করা হয়েছে বিভাগীয় পদোন্নতি (ডিপিসি) কমিটির সভাও।
শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা এসব তথ্য জানিয়েছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের এক নির্বাহী প্রকৌশলী নিউজবাংলাকে জানান, চলমান নিয়োগ কার্যক্রমে অনিয়মের অভিযোগ তদন্ত না হওয়ায় এবং নিয়োগবিধি যথাযথ অনুসরণ না করায় ক্ষুব্ধ হন শিক্ষাসচিব মো. আবু বকর ছিদ্দীক। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৬ মে তিনি শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর পরিদর্শনে এসে মৌখিকভাবে সব ধরনের নিয়োগ-পদোন্নতি কার্যক্রম স্থগিত করার নির্দেশ দেন।
ওই প্রকৌশলী বলেন, ‘শিক্ষাসচিব মহোদয় মৌখিকভাবে নির্দেশ দিয়েছেন চলমান নিয়োগের মৌখিক পরীক্ষা এবং বিভাগীয় পদোন্নতি কমিটির সভা স্থগিত রাখতে। যদিও এ নিয়ে কর্তৃপক্ষ কোনো অফিস আদেশ দেয়নি।’
তিনি আরও বলেন, ‘নিয়োগ কার্যক্রমে নানা অনিয়ম হয়েছে এমন অভিযোগ করেছে ডিপ্লোমা প্রকৌশলী সমিতি, যদিও তা মানতে নারাজ নিয়োগ কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত প্রশাসন বিভাগের কর্মকর্তারা। এ অভিযোগগুলোর সুষ্ঠু তদন্ত না হওয়ায় এর প্রভাব পড়েছে বিভাগীয় পদোন্নতিতেও। এর জেরে হঠাৎই স্থগিত করা হয়েছে বিভাগীয় পদোন্নতি কমিটির (ডিপিসি) সভাও।’
শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন, নতুন ভবন নির্মাণ, বিদ্যমান ভবনগুলোর সম্প্রসারণ ও রক্ষণাবেক্ষণ, মেরামত ও সংস্কার এবং আসবাবপত্র সরবরাহের কাজ করে থাকে। এ ছাড়া মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম, আইসিটি ল্যাব স্থাপন, ইন্টারনেট সংযোগ, আইসিটি সুবিধা সরবরাহের কাজও তারা করে।
নিয়োগবিধি অনুসরণ না করার অভিযোগ
অনুসন্ধানে জানা যায়, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের ১ হাজার ৪৫৬ পদের নিয়োগে লিখিত পরীক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে যথাযথভাবে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের নিয়োগবিধি-২০২১ অনুসরণ করা হয়নি।
বেশ কিছু পদে ৯০ মিনিটের সময়সীমায় লিখিত পরীক্ষা নেয়ার নির্দেশনা রয়েছে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের নিয়োগবিধিতে। ২০২১ সালের ২৩ আগস্ট যুগ্মসচিব সৈয়দা নওয়ারা জাহানের সই করা বিধিটি প্রকাশ করা হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ছয় ধাপে অনুষ্ঠিত লিখিত পরীক্ষার কোনোটিই ৯০ মিনিটে নেয়া হয়নি। নেয়া হয়েছে ৬০ মিনিটে, যা নিয়োগবিধির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইইডির এক কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘নির্বাচন/পদোন্নতি কমিটির সভাপতির দায়িত্বজ্ঞানহীনতা, অদক্ষতার কারণে যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয়নি নিয়োগবিধি। তিনি খেয়ালখুশিমতো একক কর্তৃত্বে সবকিছু করেছেন।’
অভিযোগের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে ইইডির বিভাগীয় নির্বাচন/পদোন্নতি কমিটির সভাপতি ও পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) রাহেদ হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এ বিষয়ে (নিয়োগবিধি অনুসরণ করা) প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যা মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে। আর সবকিছুই করা হয়েছে নিয়োগ বোর্ডের সম্মিলিত সিদ্ধান্তে।’
দুই পক্ষের অভ্যন্তরীণ কোন্দল সর্ম্পকে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি অভ্যন্তরীণ কোন্দল হয়তো নয়, আমার মনে হয় এটা স্রেফ ভুল-বোঝাবুঝি।’
অভ্যন্তরীণ কোন্দল প্রকট ইইডিতে
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চলমান নিয়োগ কার্যক্রমে নানা অনিয়ম হয়েছে- এমন অভিযোগ তুলে গত ৭ এপ্রিল শিক্ষাসচিব বরাবর চিঠি দেয় শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের ডিপ্লোমা প্রকৌশলী সমিতি। চিঠিতে বিভাগীয় নির্বাচন/পদোন্নতি কমিটির বিরুদ্ধে নিয়োগসংক্রান্ত নানা অভিযোগ উত্থাপন করা হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বিভাগীয় নির্বাচন/পদোন্নতি কমিটির সদস্যসচিব আসাদুজ্জামান গত ৬ এপ্রিল সভাপতি বরাবর পদত্যাগের চিঠি দেন। যদিও সেই চিঠি গ্রহণ করা হয়নি। মূলত এ ঘটনার পর থেকেই প্রশাসন বিভাগের কর্মকর্তা ও প্রকৌশলীদের পরস্পরবিরোধী অবস্থান নেয়ার বিষয়টি সামনে আসে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের ডিপ্লোমা প্রকৌশলী সমিতির সভাপতি সিরাজুল ইসলাম কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কোনো কথা বলতে চাই না।’
হঠাৎ কেন মুখোমুখি অবস্থান নিল দুই পক্ষ– এমন প্রশ্নে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘দুই নির্বাহী প্রকৌশলী ইইডিতে নিজস্ব বলয় গড়ে তুলেছেন। তাদের ইন্ধনেই মূলত সাম্প্রতিক সময়ে মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছেন দুই পক্ষ। তারা নিজেদের সরকারের দুই প্রভাবশালী মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ বলে পরিচয় দেন।’
জানা যায়, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের লোকবল নিয়োগ দিতে দুই দফায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়। এর একটি ২০১৫ সালের ১৩ ডিসেম্বর। ওই বিজ্ঞপ্তিতে ১১ ধরনের পদে মোট ৭১ জনকে নিয়োগের কথা উল্লেখ করা হয়। আর ২০২০ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর ১২ ধরনের পদে ১ হাজার ২৬৫ জনকে নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়।
এরপর গত বছরের ২৯ অক্টোবর, ৫ নভেম্বর, ১২ নভেম্বর, ১৯ নভেম্বর, ২৬ নভেম্বর ও ৩ ডিসেম্বর মোট ছয় ধাপে এসব পদে নিয়োগের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়, যার লিখিত পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয় গত ২৪ মার্চ। এরপর কিছু পদের ব্যবহারিক পরীক্ষা নিয়ে এর ফলও প্রকাশ করা হয়।
আর বিভিন্ন পদের মৌখিক পরীক্ষা শুরু হয় ২৯ মার্চ। এখন শুধু বাকি রয়েছে অফিস সহায়ক পদের মৌখিক পরীক্ষা। কিন্তু এরই মধ্যে শিক্ষাসচিবের মৌখিক নির্দেশে আটকে গেছে নিয়োগ কার্যক্রম।
এ বিষয়ে জানতে একাধিকবার শিক্ষাসচিব মো. আবু বকর ছিদ্দীক ও ইইডির প্রধান প্রকৌশলী শাহ্ নইমুল কাদেরকে ফোন ও এসএমএস করা হলেও তারা সাড়া দেননি।