চাকরি, পরিবার আর সংসার সামলাতে গিয়ে বারবার লেখাপড়া পড়েছে বাধার মুখে। তবুও কি থেমে থাকা চলে? বয়স তো নয়-ই, বরং ইচ্ছা থাকলে কোনো জটিলতাই যে লেখাপড়া থামাতে পারে না তাই প্রমাণ করলেন ঠাকুরগাঁওয়ের আরেফা হোসেন। স্বপ্ন জয় করেছেন তিনি।
বুধবার উত্তরায় বেসরকারি অতীশ দীপঙ্কর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কনভোকেশনে ৬২ বছর বয়সে পাবলিক হেলথ বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রির সার্টিফিকেট গ্রহণ করেন এই অদম্য নারী। ২০১৭ সালে ৫৭ বছর বয়সে মাস্টার্স পাস করা আরেফা ২০১৯ সালে সরকারি চাকরি থেকে অবসরে যান।
স্বামীর মৃত্যুর পর এই নারীর সংসার এখন দুই ছেলে নিয়ে। বড় ছেলে আশিক হোসেন নিউজবাংলার প্রতিবেদক হিসেব কর্মরত। ছোট ছেলে আদিব হোসেন অনল পড়ছেন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের টেলিকমিউনিকেশন বিভাগে।
দীর্ঘ পথ পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স পাস করা যে আরেফার জন্য কতটা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তা বোঝা যায় তার কথাতেই।
তিনি জানান, বয়স যখন চার তখন মাকে আর আট বছর বয়সে বাবাকে হারান। এরপর শুরু হয় তার জীবন সংগ্রাম। ঠাঁই হয় নাটোরের একটি অনাথ আশ্রমে। সেখান থেকেই স্থানীয় একটি স্কুল থেকে ১৯৭৬ সালে মাধ্যমিক পাস করেন তিনি।
১৯৮০ সালে নার্সিংয়ে ডিপ্লোমা শেষ করে নার্সিং পেশায় যোগ দেন আরেফা। একসময় বিয়ে করেন, হন সন্তানের জননী। কিন্তু তার পরও পড়াশোনা করার একটি ইচ্ছা মনে রয়েই গিয়েছিল। বড় ছেলের বয়স যখন ১০ বছর, তখন স্বামীর অনুপ্রেরণায় নিজের বিএসসি শেষ করার একটি সুযোগ পান।
শিক্ষাছুটি নিয়ে সে সময় তিনি ভর্তি হন মহাখালীর সেবা মহাবিদ্যালয়ে। ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত দুই বছরের জন্য পরিবার ছেড়ে চলে আসেন ঢাকার মহাখালীতে। সেখান থেকেই স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি।
তবে সংসার-পরিবার সামলাতে গিয়ে এর বেশি সেবার এগোতে পারেননি। ফিরে যান কর্মক্ষেত্র ঠাকুরগাঁওয়ে। সেখানেই চাকরি করতে থাকেন। এরই মধ্যে তার ছোট ছেলের জন্ম হয়। বড় ছেলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট চুকিয়ে চাকরিতে যোগ দেন।
আরেফা আবার চিন্তা করলেন মাস্টার্স শেষ করার কথা। এ নিয়ে নিজের মধ্যেই নানা দোটানা তৈরি হয়। কিন্তু স্বামীর অনুপ্রেরণায় আবারও সিদ্ধান্ত নেন পড়াশোনাটা শুরু করবেন। একপর্যায়ে তিনি ভর্তি হন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাবলিক হেলথ বিষয়ে।
এ যেন এক নতুন চ্যালেঞ্জ। প্রতি সপ্তাহে সাপ্তাহিক ছুটির দিন ঠাকুরগাঁও থেকে প্রায় সাড়ে ৪০০ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে রাজধানী ঢাকায় আসতেন মাস্টার্সের ক্লাস ধরতে। দিনভর ক্লাস শেষে আবার রাতেই ফিরতেন সেই সাড়ে ৪০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে। পরদিন ফিরতে হতো কর্মক্ষেত্রে। এভাবেই পার করেছেন দুটি বছর।
কেন মাস্টার্সের কথা চিন্তা করলেন জানতে চাইলে আরেফা হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সরকারিভাবে এমপিএইচ করার সুযোগ সে সময় ছিল না। আগে এক জায়গা থেকেই এটা হতো, নিপসম বাংলাদেশ থেকে। পরে সরকার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও মাস্টার্স করার সুযোগ তৈরি করে আমাদের জন্য।
‘তাই চিন্তা করলাম লেখাপড়া করা তো আর ভুল না, যদি উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারি তাহলে হয়তো ভালো লাগবে। নিজেরও একটা ইচ্ছা ছিল পড়াশোনা করব, সে থেকেই আরকি।’
আরেফা বলেন, ‘আমার স্বামী আমাকে পড়াশোনার বিষয়ে অনেক সমর্থন দিয়েছে। তার উৎসাহও এ ক্ষেত্রে অনেকটা কাজে দিয়েছে। তার অনেক ইচ্ছা ছিল আমি যেন কনভোকেশনটাতে অংশ নিই। তারও ইচ্ছা ছিল এটাতে থাকার। কিন্তু সে সেটা দেখে যেতে পারল না।’
তিনি বলেন, ‘ঠাকুরগাঁও থেকে আসা-যাওয়া খুবই কষ্টকর, যেহেতু অনেক দূরের পথ। অনেক লম্বা সময় লাগে। প্রতি সপ্তাহে আমাকে ছুটির দিনগুলোতে আসতে হয়েছে। সারা রাত জার্নি করে সকালে পৌঁছাতাম, ক্লাস করে আবার সারা রাতের জার্নি শেষে বাড়িতে পৌঁছাতাম। পরের দিন অফিসও করতে হতো।
‘কিন্তু সেই কষ্ট এখন আর মনে হচ্ছে না। এখন মনে হচ্ছে কষ্ট কাজে লেগেছে। আর আমার এই ডিগ্রির জন্য কিন্তু চাকরির শেষ পর্যায়ে আমি প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা হিসেবে অবসরে যাওয়ার সুযোগ পাই। এখন একটি বেসরকারি নার্সিং কলেজের অধ্যাপক হিসেবে কাজ করার সুযোগও পাচ্ছি। আমি বলব, এটা আমার ৬২ বছর জীবনের একটি বড় অর্জন।’
আরেফা মনে করেন, শিক্ষার জন্য কোনো নির্দিষ্ট বয়স নেই। ইচ্ছা থাকলে যেকোনো বয়সেই পড়শোনা করে নিজের লক্ষ্যে পৌঁছানো যায়।