শিক্ষা প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পাঁচ পদ দীর্ঘদিন ধরে ফাঁকা থাকায় প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজে স্থবিরতা দেখা গেছে। চলতি দায়িত্ব দিয়ে দায়সারাভাবে চালানো হচ্ছে দৈনন্দিন কাজ। এতে প্রতিষ্ঠানগুলোর শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
শিক্ষা প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলছেন, চলতি দায়িত্বে যারা আছেন তারা শুধু দৈনন্দিন কাজেই মনোযোগী হন। কারণ তাদের নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা থাকে না। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হন সেবাপ্রার্থীরা।
একটি প্রতিষ্ঠানের চলতি দায়িত্বে থাকা এক কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘চলতি দায়িত্বে থাকলে রুটিন কাজ ছাড়া নীতিনির্ধারণী কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব না। কারণ এর পরে কে আসবে, তিনি এই সিদ্ধান্ত পছন্দ করেন কি না, আর না করলে কোনো ঝামেলায় পড়তে হয় কি না, এসব বিষয় থাকে।
‘ফলে অনেক সিদ্ধান্ত আছে, যা কেবল পূর্ণ নিয়োগ পেলেই গ্রহণ করা সম্ভব। এর ফলে আদতে প্রতিষ্ঠানই ক্ষতিগ্রস্ত হয়।’
পদ ফাঁকা থাকার ঘটনায় প্রশাসনের কর্মদক্ষতা নিয়ে নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন শিক্ষাবিদরা। তারা বলছেন, এসব পদ থেকে অবসরে কেউ হুট করে চলে যায় না। অবসরের অন্তত এক বছর আগে থেকেই বিষয়টি জানা থাকে কোন কর্মকর্তা অবসরে যাচ্ছেন। আবার ছয় মাস আগে শুরু হয় অবসরকালীন ছুটি।
ফাঁকা পদের জন্য সময়মতো নতুন লোক বাছাই করতে না পারা একটি অদক্ষ শিক্ষা প্রশাসনের প্রমাণ হিসেবেই দেখছেন জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্য অধ্যাপক শেখ একরামুল কবির।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘একটি পদের মেয়াদ কবে শেষ হবে, তা অবশ্যই মন্ত্রণালয় জানে। তাই তাদের উচিত এর আগেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া, কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য শিক্ষা প্রশাসনের বেশ কিছু পদ এখনও ফাঁকা পড়ে আছে। এতে প্রতিষ্ঠানের কাজে স্থবিরতা নেমে আসছে।’
শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘একটি পদের মেয়াদ কখন শেষ হবে, তা নিশ্চয়ই মন্ত্রণালয় জানে। তাহলে তারা কেন যথাসময়ে নতুন লোক নিয়োগের উদ্যোগ নেয় না? আসলে এ বিষয়গুলো অনেকটা লাল ফিতার দৌরাত্ম্যও বলা যায়।’
তিনি বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষা প্রশাসনে পদ ফাঁকা রাখা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এতে প্রতিষ্ঠানের গতিশীলতা নষ্ট হয়। যার কোনো না কোনোভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিক্ষার্থীরাই।’
কত দিন ধরে ফাঁকা
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক হওয়ার পর গত ১৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব ছাড়েন অধ্যাপক নেহাল আহমেদ।
তিনি নতুন পদে নিয়োগ পান চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারি, কিন্তু তিনি তাতে যোগ দেয়ার আগে দুই সপ্তাহেও নতুন কোনো চেয়ারম্যানকে বেছে নেয়া হয়নি।
প্রায় তিন মাস ধরে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের সচিব তপন কুমার সরকার নিজের দায়িত্বের পাশাপাশি অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে বোর্ড প্রধানের ভূমিকা পালন করছেন।
এ প্রতিষ্ঠানটি ঢাকার মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ হিসেবে কাজ করে।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড বা এনসিটিবির চেয়ারম্যানের পদ থেকে ফরহাদুল ইসলাম অবসরে যান এপ্রিলে। এর পর থেকে চেয়ারম্যানের রুটিন দায়িত্ব পালন করছেন এনসিটিবি সদস্য (শিক্ষাক্রম) মো. মশিউজ্জামান।
এই সংস্থাটি প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের বিনা মূল্যের বইও দেয়া হয় এ সংস্থার মাধ্যমে।
চেয়ারম্যান পদ ছাড়াও এনসিটিবির আরও দুটি সদস্য পদ খালি এক বছরের বেশি সময় ধরে। সাংগঠনিক কাঠামো অনুযায়ী এ সংস্থায় চেয়ারম্যান ছাড়াও চারজন সদস্য দায়িত্ব পালন করেন। তারা অর্থ, পাঠ্যপুস্তক, শিক্ষাক্রম ও প্রাথমিক শিক্ষাক্রম বিভাগের দায়িত্ব পালন করবেন। চার সদস্যের মধ্যে এখন দুজন সদস্য দায়িত্ব পালন করছেন।
এর মধ্যে একজন মো. মশিউজ্জামান (শিক্ষাক্রম) ও অন্যজন এ কে এম রিয়াজুল হাসান (প্রাথমিক শিক্ষাক্রম)। অপর দুটি সদস্য পদ শূন্য থাকায় এ দুজন পদগুলোতে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন। অর্থাৎ চারজনের কাজের ভার এখন পড়েছে দুইজনের কাঁধে।
বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগে সনদ প্রদান ও সুপারিশ করে থাকে বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ এনটিআরসিএ। সংস্থাটির একটি সদস্য পদও এক বছরের বেশি সময় ধরে ফাঁকা।
সাংগঠনিক কাঠামো অনুযায়ী, এ প্রতিষ্ঠানে চেয়ারম্যানসহ তিনটি সদস্য পদ রয়েছে, কিন্তু এখন দুইজন মিলে পালন করছেন তিনজনের দায়িত্ব।
কেন পদগুলো পূরণ হচ্ছে না
কয়েকবার শিক্ষা প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো পূরণে উদ্যোগ নেয়া হলেও শেষ পর্যন্ত তা আলোর মুখ দেখেনি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নানা জটিলতার কারণে শূন্য পদগুলোতে নতুন নিয়োগ দেয়ার উদ্যোগ ভেস্তে যায়। এর মধ্যে তদবির, যোগ্য না হয়েও পছন্দের লোককে নিয়োগ দেয়ার চেষ্টা অন্যতম।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘পদগুলো পূরণে সরকারের নানা হিসাব-নিকাশ আছে। এ ছাড়া শিক্ষা প্রশাসনের শীর্ষ ব্যক্তিদের উদ্যোগ ও আগ্রহও এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।’
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব মো. আবু বকর ছিদ্দীক বলেন, ‘আমরা বিষয়টি সম্পর্কে অবগত। এ বিষয়ে কাজ চলছে।’