টাকার বিনিময়ে বেসরকারি শিক্ষায় আগ্রহী হয়ে উঠা মধ্যবিত্ত শ্রেণির শিশুদেরকে আবার সরকারি প্রাথমিক শিক্ষায় নিয়ে আসার চেষ্টা করতে চাইছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়।
এই চেষ্টার অংশ হিসেবে ঢাকা মহানগরীর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে ব্যাপক অবকাঠামোগত পরিবর্তন আনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তৈরি করা হবে দৃষ্টিনন্দন অবকাঠামো।
এভাবে সব শ্রেণি-পেশার অভিভাবকরা সন্তানদেরকে প্রাথমিকে ভর্তিতে আগ্রহী করে তুলতে চাইছে সরকার।
শিক্ষাবিদরা এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে সারা দেশের স্কুলগুলোকেই ঢেলে সাজানোর পরামর্শ দিয়েছেন। তারা অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি পাঠ্যক্রম পাল্টানো ও শিক্ষকদের প্রশিক্ষণেও জোর দেয়ার তাগিদ দিয়েছেন। বলেছেন, একটি দেশে সব শিশুর একই মানের শিক্ষা লাভের যে অধিকার, সেটি নিশ্চিত করতে না পারলে শিক্ষায় বৈষম্য দূর করা যাবে না।
সরকারি প্রাথমিক শিক্ষা বিনা মূল্যের হলেও এর মান নিয়ে আছে প্রশ্ন। তবে অর্থকরির সংকট নেই, এমন পরিবারগুলো এখন সরকারের স্কুলগুলোতে সন্তান ভর্তি করে না বললেই চলে। তারা বেসরকারি কিন্ডারগার্টেন এবং হাল আমলে ইংরেজি মাধ্যমেই সন্তানদেরকে ভর্তি করছেন।
এই পরিস্থিতিতে শিক্ষা ব্যবস্থায় শুরু থেকেই এক ধরনের বৈষম্য তৈরি হচ্ছে। বিষয়টি এমন হয়ে গেছে যে, গরিবের সন্তান পড়বে সরকারি প্রাথমিকে আর সম্পদশালীর শিশু পড়বে বেসরকারি স্কুলে।
রাজধানীতে এই বিভাজন আরও বেশি। এখানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো সাধারণত ঘিঞ্জি, দুর্গন্ধময় এলাকায় অবস্থিত। স্কুলগুলোর অবকাঠামোর মানও বেশ দুর্বল। সেখানে নিম্ন আয়ের পরিবারের শিশুরাই সাধারণত ভর্তি হয়।
এতে শৈশব থেকেই শিশুরা সমাজের সামগ্রিক চিত্র দেখে বড় হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বলে শিক্ষাবিদরা আক্ষেপ করেন। অর্থাৎ নিম্ন আয়ের শিশুরা কেবল মিশছে তাদের শ্রেণির সঙ্গে, মধ্যবিত্ত শ্রেণির শিশুদের বন্ধুত্ব হচ্ছে কেবল তাদের শ্রেণিভুক্তদের মধ্যে, আর উচ্চবিত্ত শ্রেণির শিশুরা মিশছে অন্য উচ্চবিত্ত শ্রেণির শিশুর সঙ্গে।
এতে একটি শ্রেণি অন্য শ্রেণির জীবন সম্পর্কে কিছুই জানছে না। আর প্রাথমিকে যেহেতু কেবল নিম্ন আয়ের শিশুরা ভর্তি হচ্ছে, সেহেতু এসব স্কুলে শিক্ষার মান বজায় রাখা নিয়ে চেষ্টা কম।
এই পরিস্থিতি পাল্টে দেয়ার লক্ষ্য নিয়ে সব শ্রেণি-পেশার অভিভাবকের সন্তানদের বিদ্যালয়ে পড়তে আগ্রহী করার উদ্যোগের অংশ হিসেবে ঢাকা মহানগরী ও পূর্বাচলে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন ও অবকাঠামো উন্নয়নসহ দৃষ্টিনন্দনকরণ নামে একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে।
এ প্রকল্পের আওতায় ঢাকা মহানগরীর ৩৪২টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ১৫৪টি বিদ্যালয়ের দুই হাজার ৯৭৫টি কক্ষ নতুনভাবে নির্মাণ করা হবে। এ ছাড়া ১৭৭টি বিদ্যালয়ের ১ হাজার ১৬৭টি কক্ষের অবকাঠামো উন্নয়নসহ দৃষ্টিনন্দন করা হবে।
প্রকল্পের আওতায় উত্তরায় তিনটি ও পূর্বাচলে ১১টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ও স্থাপন করা হবে।
চার বছর মেয়াদি এ প্রকল্প শেষ হবে ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে। এর জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ১৫৯ কোটি ২ লাখ ৫৩ হাজার টাকা।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রকিউরমেন্ট) ও প্রকল্প পরিচালক মিজানুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘দেশের অন্যান্য জায়গার তুলনায় ঢাকা মহানগরীর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর অবকাঠামো নাজুক। এ কারণে সব শ্রেণি-পেশার অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের এসব বিদ্যালয়ে পড়াতে আগ্রহী হন না। আমরা অভিভাবকদের এসব বিদ্যালয়ে সন্তানদের পাঠাতে উৎসাহী করতে চাই। বিদ্যালয়গুলো দৃষ্টিনন্দন করার উদ্যোগ এর অন্যতম পদক্ষেপ।’
প্রকল্পের মেয়াদ ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে শুরু হলেও করোনা মহামারির কারণে যথাসময়ে কাজ শুরু করা যায়নি। তবে সব প্রস্তুতি শেষ হয়েছে। বুধবার প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন মোহাম্মদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের উন্নয়নকাজ উদ্বোধন করে প্রকল্পের মূল কাজ শুরু করবেন।
মন্ত্রণালয়ের এই উদ্যোগকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন শিক্ষাবিদরাও।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বিষয়টি অবশ্যই ইতিবাচক। প্রাথমিক শিক্ষা অবশ্যই আনন্দদায়ক করতে হবে। শিশুদের আকৃষ্ট করতে বিদ্যালয় দৃষ্টিনন্দন হওয়া উচিত।’
এই উদ্যোগ কেবল ঢাকায় না রেখে সারা দেশেই নেয়া উচিত বলেও মনে করেন তিনি। বলেন, ‘দেশের শিক্ষাব্যবস্থার ভিত গড়ে দেয় প্রাথমিক শিক্ষা। আমাদের প্রাথমিক শিক্ষায় আরও বেশি নজর দিতে হবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক তাহমিনা আক্তার বলেন, ‘ঢাকা মহানগরীর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে সব শ্রেণি-পেশার সন্তানরা পড়াশোনা করে না- এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। আমি এ উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। একই সঙ্গে পড়াশোনার মান উন্নয়নে শিক্ষকদের যথাযথ ট্রেনিং দেয়ার উদ্যোগ গ্রহণের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানাই।’
বাংলাদেশ শিক্ষা, তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) ২০২০ সালের জরিপ অনুযায়ী দেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে ৬৫ হাজার ৫৬৬টি। এসব বিদ্যালয়ে কর্মরত শিক্ষকের সংখ্যা ৩ লাখ ৬৭ হাজার ৪৮০ জন। আর শিক্ষার্থী সংখ্যা ১ কোটি ৭৬ লাখ ৭২৬৫ জন।
কিন্ডারগার্টেন স্কুলদের সমিতি বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব সেকেন্দার আলী জানিয়েছেন, তাদের সমিতিভুক্ত স্কুলের সংখ্যা সাড়া দেশে ৬৫ হাজারের বেশি। তবে ছাত্র সংখ্যা কত, সেই হিসাব তাদের কাছে নেই।