পহেলা বৈশাখের দিন মঙ্গল শোভাযাত্রা শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ প্রাঙ্গণে বুয়েটের এক শিক্ষার্থীকে এবং এর আগের রাতে মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রস্তুতি পর্বে অনুষদের আরও তিন শিক্ষার্থীকে ইভ টিজিং ও যৌন হেনস্তার অভিযোগ উঠেছে। অভিযুক্ত ব্যক্তিটি হলেন চারুকলা অনুষদের শিল্পকলার ইতিহাস বিভাগের প্রভাষক আক্তারুজ্জামান সিনবাদ।
এ দুই ঘটনায় গত ১৮ এপ্রিল শিল্পকলার ইতিহাস বিভাগের চেয়ারম্যান সঞ্জয় চক্রবর্তী ও অনুষদের ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেনের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী এবং ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী তাদের বন্ধুরা।
ভুক্তভোগীদের এক বন্ধু নিউজবাংলাকে জানান, মঙ্গল শোভাযাত্রার পরের ঘটনায় শুধু প্রভাষক আক্তারুজ্জামান সিনবাদ জড়িত থাকলেও আগের রাতের ঘটনায় তার সঙ্গে অনুষদের আরও দুই শিক্ষার্থী জড়িত ছিলেন। লিখিত অভিযোগে তাদের নামও উল্লেখ করেছেন ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীর সহপাঠীরা।
এই শিক্ষার্থী জানান, অভিযুক্ত দুই শিক্ষার্থীর মধ্যে একজন অনুষদের প্রাক্তন ছাত্র শুভ্র বাড়ৈই। অন্যজন পুলক বাড়ৈই ভাষ্কর্য বিভাগের ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী।
তবে তার বিভাগ এবং সেশন জানাতে পারেননি তিনি।
ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা অনীহা প্রকাশ করায় তাদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলা সম্ভব হয়নি। তবে ভুক্তভোগী ও ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী শিক্ষার্থীদের লিখিত অভিযোগ পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেন।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘লিখিত একটি অভিযোগ আমাকে ও সংশ্লিষ্ট বিভাগের চেয়ারম্যানের কাছে শিক্ষার্থীরা জমা দিয়েছে। এরপর ঘটনাটা কী ঘটেছে সেটি জানার জন্য আমরা একটি ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি গঠন করেছি।
‘কমিটি অভিযোগকারীদের সঙ্গে কথা বলেছে। পৃথকভাবে কথা বলা হলেও তাদের বক্তব্যে মিল আছে। এ জন্য আমরা মনে করেছি, অভিযুক্ত শিক্ষকেরও বক্তব্য নেয়া প্রয়োজন। তাই আজ (সোমবার) আমরা সেই শিক্ষককে বক্তব্য দেয়ার জন্য চিঠি ইস্যু করেছি। আগামী ৮ মে’র মধ্যে তাকে লিখিত উত্তর দিতে বলা হয়েছে।
‘লিখিত বক্তব্য একবার দিলে আর উইথড্র করা যায় না। তাই ভেবেচিন্তে বক্তব্য দেয়ার জন্য ওই শিক্ষককে বেশি সময় দেয়া হয়েছে।’
নিসার হোসেন বলেন, ‘অভিযোগপত্রে শিক্ষক ছাড়াও আরও দুই শিক্ষার্থীকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। তাদের মধ্যে প্রাক্তন শিক্ষার্থীর বিভাগের শিক্ষকের মাধ্যমে তাকে ডেকে আমরা তার বক্তব্য নেয়ার চেষ্টা করছি। আর রানিং যে শিক্ষার্থী সে বাড়ি চলে যাওয়ায় আজ জুমে তার বক্তব্য নেয়া হয়েছে।’
ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটির সদস্য কারা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের অনুষদে সাধারণত দুটি কমিটি আছে। একটি গ্রিবেঞ্জ কমিটি আরেকটি অ্যান্টি র্যাগিং কমিটি। দুই কমিটি থেকে চারজনকে নিয়ে একটা কমিটি হয়েছে। এটাতে আমিও আছি।
‘কমিটিতে অন্যদের মধ্যে আছেন অংকন ও চিত্রায়ণ বিভাগের অধ্যাপক শিশির কুমার ভট্টাচার্য, ভাষ্কর্য বিভাগের অধ্যাপক লালারুখ সেলিম এবং দুটি বিভাগের চেয়ারম্যান।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অভিযুক্ত শিক্ষক আখতারুজ্জামান সিনবাদ তার বিরুদ্ধে আসা এই অভিযোগ অস্বীকার করেন।
তিনি বলেন, 'আমার সঙ্গে এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেনি। এটি সম্পূর্ণই মিথ্যা ও বানোয়াট এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অভিযোগ। হয়তো তাদের কেউ উসকে দিচ্ছে। তবে এমনও হতে পারে, আমার শিক্ষকতা ও ক্যারিয়ারকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য এরকম ষড়যন্ত্র হচ্ছে।’
এদিকে অভিযোগ দেয়ার কিছুদিন পেরিয়ে গেলেও এই ঘটনার কোনো তদন্ত রিপোর্ট জমা না হওয়ায় অভিযুক্ত শিক্ষকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চেয়ে একটি প্রতিবাদলিপি ছাপিয়েছেন অনুষদের শিক্ষার্থীরা। প্রতিবাদলিপিতে দুই ঘটনার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেয়া হয়েছে।
প্রথম ঘটনার বর্ণনা দিয়ে প্রতিবাদলিপিতে বলা হয়, ‘মঙ্গল শোভাযাত্রার পরবর্তী মুহূর্তে চারুকলা অনুষদের অন্যান্য বন্ধু শিক্ষার্থীর সঙ্গেই অনুষদ প্রাঙ্গণে বসে ছিলেন ভুক্তভোগী বুয়েট শিক্ষার্থী। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়টির ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষের ছাত্রী।
‘এমন সময় শিক্ষক সিনবাদ বুয়েট শিক্ষার্থীকে দেখে ক্রমাগত শিস দিতে থাকেন। একপর্যায়ে নিপীড়িত শিক্ষার্থী তার দিকে সরাসরি তাকালে তিনি অশ্লীল মুখভঙ্গি ও চোখ দিয়ে আপত্তিকর ইঙ্গিত করতে থাকেন।’
‘উপস্থিত শিক্ষার্থীরা এ ঘটনার প্রতিবাদ করলে তিনি (সিনবাদ) প্রথমে অস্বীকার করার চেষ্টা করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি হুমকি-ধমকি দিয়ে কৃতকর্মের কথা স্বীকার করেন এবং নারী শিক্ষার্থীর সঙ্গে থাকা বন্ধুকে আবাসিক হলে থাকে কি না সে বিষয়ে জিজ্ঞাসাপূর্বক দমনমূলক আচরণ করেন এবং তিনি যে শিক্ষক সেটা স্মরণ করিয়ে তার এহেন আচরণের বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করেন।’
আগের রাতের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে প্রতিবাদলিপিতে বলা হয়, ‘মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রস্তুতি পর্বে অনুষদের জয়নুল শিশুকলা নিকেতন কক্ষে একই শিক্ষক (সিনবাদ) চারুকলা অনুষদের তিন নারী শিক্ষার্থীর সঙ্গে বিকৃত ও অপ্রীতিকর আচরণ করেন। তারা তিনজনই বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের ছাত্রী। এ ঘটনায় সেই শিক্ষকের সঙ্গে অনুষদের আরও দুই শিক্ষার্থী জড়িত।’
প্রতিবাদলিপিতে আরও বলা হয়, ‘তার (আক্তারুজ্জামান সিনবাদ) অনিয়ন্ত্রিত ও বিকৃত যৌন হেনস্তায় শিক্ষার্থীরা ক্ষুব্ধ ও শঙ্কিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের কাছ থেকে এ ধরনের আচরণ কখনোই কাম্য নয় এবং শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশের জন্য অপ্রীতিকর।’
সবশেষে প্রতিবাদলিপিতে বলা হয়, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ বজায় রাখার জন্য এই ঘটনার জন্য দায়ীদের শাস্তি প্রদান করে দৃষ্টান্ত স্থাপনের দাবি জানাচ্ছেন চারুকলা অনুষদের সাধারণ শিক্ষার্থীরা।’