বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

জবিতে সম্প্রীতির ইফতার

  •    
  • ২৪ এপ্রিল, ২০২২ ১১:৩৪

সনাতন ধর্মাবলম্বী শিক্ষার্থী মিথিলা দেবনাথ ঝিলিক বলেন, ‘ভিন্ন ধর্মাবলম্বী হওয়ার পরেও সহপাঠী এবং সিনিয়র ভাই-বোনদের থেকে ইফতারের দাওয়াত পেয়ে খুব ভালো লাগে। একসঙ্গে বসে ইফতার করার মধ্য দিয়ে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের চিত্র ফুটে ওঠে।’

রাজধানীর পুরান ঢাকায় মাত্র সাড়ে সাত একরের ক্যাম্পাস জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি)। এই স্বল্প পরিসরের মধ্যে প্রায় ১৬ হাজার শিক্ষার্থী, ৭০০ শিক্ষক আর হাজারেরও বেশি কর্মকর্তা-কর্মচারীর নিয়মিত চলাচল। আয়তনে ছোট হলেও নিত্যদিন এখানে সৃষ্টি হয় নতুন স্মৃতির গল্প। যানজট, কোলাহল ও ব্যস্তময় এই শহরের ক্যাম্পাসে ভাই-বন্ধু-শিক্ষকের সাক্ষাতে মিলে দুদণ্ড শান্তি।

ক্যাম্পাস ছোট হওয়ায় প্রায় সবার সঙ্গেই প্রতিদিন সবার দেখা হয়৷ আর এভাবেই প্রাণোচ্ছল থাকে ক্যাম্পাস। তার মধ্যে আবার সংযুক্ত হয়েছে রমজানের ইফতার। রমজানে প্রতিদিন পশ্চিম আকাশে সূর্য ঢলে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় ইফতারির প্রস্তুতি। খোপে খোপে বসে ক্যাম্পাসে ইফতারের প্রস্তুতি নেন জবি শিক্ষার্থীরা।

অন্যবারের থেকে এবারের রমজান মাসটি জবি শিক্ষার্থীদের জন্য একটু ব্যতিক্রম। কারণ এবারেই প্রথম রমজানের মধ্যে একাডেমিক কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। ফলে প্রায় সব শিক্ষার্থীই অবস্থান করছেন ক্যাম্পাসে। আর সারা দিন রোজা রেখে ইফতারের আনন্দময় ক্ষণটি প্রিয় বন্ধুদের সঙ্গে কাটাতে ক্যাম্পাসে ইফতারের আসর বসান শিক্ষার্থীরা। আর এই ইফতারের ছোট বড় আসরে মুখরিত হয়ে উঠছে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থান।

ক্যাম্পাসের খোপে খোপে বসে ইফতারের প্রস্তুতি নেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ছবি: নিউজবাংলা

বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, শান্ত চত্বর, মুক্তমঞ্চ, কাঁঠালতলা, রফিক ভবনের প্রতিটি তলার বারান্দা, বিবিএ ভবনের নিচতলায় পুরোটাজুড়ে, বিজ্ঞান অনুষদ প্রাঙ্গণ, পোগোজ স্কুলের খেলার মাঠ ছাড়াও ক্যাম্পাসের বিভিন্ন আঙিনায় জমে উঠে ইফতারের মহোৎসব। তন্মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রাণোচ্ছল পরিবেশ দেখা যায় শহীদ মিনারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাশ ভবনের ওপর থেকে দেখলে মনে হয় এ যেন ভ্রাতৃত্বের এক অনন্য বন্ধন।

ক্যাম্পাসের জুনিয়র-সিনিয়র সবার সম্মিলিত অংশগ্রহণে সৌহার্দ্য সম্প্রীতির মেলবন্ধনে প্রাণচঞ্চল হয়ে ওঠে ইফতার আয়োজন। রোজা শুধু মুসলমানদের ইবাদত হলেও তাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে থাকেন অন্য ধর্মাবলম্বী বন্ধুরাও।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাশ ভবনের উপর থেকে দেখলে মনে হয় এ যেনো ভাতৃত্বের এক মেলবন্ধন। ছবি: নিউজবাংলা

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা যতই কাছাকাছি আসে আস্তে আস্তে ততই জড়ো হতে শুরু করে শিক্ষার্থীরা। এরপর বন্ধুরা মিলে বাহারি পদের খাবার নিয়ে সাজানো হয় ইফতারের আসর। সবার উদ্দেশ্য, বন্ধুদের সঙ্গে আনন্দঘন পরিবেশে ইফতার করা। তাই ইফতারের আয়োজনে কী থাকছে সেটা এখানে গৌণ। সবাই আন্তরিকতার সঙ্গে নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত।

ক্যাম্পাসে ছোট ছোট দলে ছড়িয়ে আড্ডা-গল্পের পাশাপাশি তারা ইফতারের আয়োজনে ব্যস্ত। মাগরিবের আজানের আগ পর্যন্ত প্রতিটি দল তাদের সামনে ইফতারি নিয়ে বসে থাকে। সচরাচর তাদের ইফতারির মধ্যে থাকে মুড়ি, আলুর চপ, পিঁয়াজু, ডিমের চপ, জুস, বেগুনি, জিলাপি, শরবত, খেজুর, বুন্দিয়া, নানা রকম মৌসুমি ফল-ফলাদি। এ ছাড়া থাকে পুরান ঢাকার খাবারের কোনো বিখ্যাত পদ।

বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, শান্ত চত্বর, মুক্তমঞ্চ, কাঁঠালতলাসহ ক্যাম্পাসের বিভিন্ন আঙিনায় জমে ওঠে ইফতারের মহোৎসব। ছবি: নিউজবাংলা

বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা বন্ধুদের সঙ্গে আয়োজন করছেন এসব আসরের। অনেক সময় সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে করা হয়েছে ইফতারের এ আয়োজন। আর ইফতারের পর সারা দিনের ক্লান্তি আর অবসাদ কাটাতে আড্ডায় মুখর হয়ে ওঠে আসরগুলো। শিক্ষার্থীদের ছোট-বড় অসংখ্য ইফতারের আসরে প্রতিদিন আনন্দমুখর হয়ে ওঠে জবি ক্যাম্পাস। এ যেন এক আত্মিক মিলনমেলা।

ক্যাম্পাসে ইফতারের অনুভূতি জানিয়ে লোকপ্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী ইউছুব ওসমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘করোনার কারণে গত বছর বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় সবাই বাড়িতে ছিল। আর আমরা যারা ঢাকায় ছিলাম রুমেই ইফতার করতাম। এ বছর ক্যাম্পাস খোলা থাকায় সব বন্ধুরা মিলে একত্রে ইফতার করতে পারতেছি। এতে পরিবার থেকে দূরে থাকার বিষাদ কিছুটা হলেও কম হচ্ছে।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের নবীন শিক্ষার্থী সাকিবুল ইসলাম বলেন, ‘রমজানের মর্যাদা সমুন্নত রাখতে সম্প্রীতি প্রয়োজন। সব শ্রেণি-ধর্ম-বর্ণ-জাত বিভেদ ভুলে গিয়ে পারস্পরিক সৌহার্দ্য সম্প্রীতি মেলবন্ধনের মধ্য দিয়ে ইফতারে প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে প্রাণের জবি ক্যাম্পাসে। সাম্প্রদায়িক শক্তির মুখে একমুঠো ছাই ফেলে দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয় ক্যাফেটেরিয়া থেকে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন প্রাঙ্গণে, চোখ বুলিয়ে যাওয়ার মতো অনাবিল দৃশ্য ভুলবার নয়। এভাবেই জমকালো ইফতারের মাধ্যমেই বন্ধুত্বের বন্ধন হোক অটুট, সেই প্রত্যাশা।’

পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষার্থী মেহরাব হোসেন অপি জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থী পরিবার ছাড়া ঢাকায় থাকে। ক্যাম্পাস খোলা থাকায় পরিবারের সঙ্গে একত্রে ইফতার করাটাও হচ্ছে না। এ জন্য আমরা যারা বন্ধু-বান্ধব আছি, তারা সব সময় একসঙ্গে আমাদের পরিবারের মতো ক্যাম্পাসে ইফতার করার চেষ্টা করি।

রসায়ন বিভাগের শিক্ষার্থী ছামিরা ইসলাম ছনি বলেন, ‘ইফতারের সময়ে ক্যাম্পাসে উপস্থিত হয়ে পরিবেশ দেখে বিমোহিত হয়ে গেলাম। সবাই দলে দলে ইফতার নিয়ে বসে আছে। এ সৌন্দর্য অন্য রকম। আমরাও ব্যস্ত হয়ে পড়লাম ইফতার তৈরি করা নিয়ে। ইফতার পরিবেশন ও শরবত বানানোর সময় বারবার মনে হচ্ছিল যেন নিজের পরিবারের সঙ্গেই আছি। বাড়ির বাইরে রোজা ও ইফতারের এই প্রথম অভিজ্ঞতা।

‘বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে ইফতারের এই সুন্দর আয়োজন সত্যি মনোমুগ্ধকর ও আনন্দের। পরিবারের সঙ্গে ইফতার খুব মিস করছি, তবে বন্ধুদের সঙ্গে ইফতারও খুব উপভোগ করছি। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষে বন্ধুরা মিলে ইফতার করার এই মুহূর্তটা খুব মিস করব।’

সনাতন ধর্মাবলম্বী শিক্ষার্থী মিথিলা দেবনাথ ঝিলিক বলেন, ‘ভিন্ন ধর্মাবলম্বী হওয়ার পরও সহপাঠী এবং সিনিয়র ভাই-বোনদের থেকে ইফতারের দাওয়াত পেয়ে খুব ভালো লাগে। একসঙ্গে বসে ইফতার করার মধ্য দিয়ে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের চিত্র ফুটে ওঠে।’

আরেক সনাতন ধর্মের শিক্ষার্থী অমিত পাল বলেন, ‘রমজান মাসে বিশ্ববিদ্যালয় খোলা থাকায় ক্যাম্পাসে সময় কাটছে। অন্য ধর্মের হওয়া সত্ত্বেও সহপাঠী, সিনিয়র বড় ভাই-বোনদের থেকে প্রতিদিনই ইফতারের দাওয়াত পাই। এ যেন ভ্রাতৃত্বের এক বন্ধন। অসাম্প্রদায়িকতার এক দৃষ্টান্তমূলক প্রতিফলন। এবারের রমজানে অনেক ইফতারের দাওয়াত পেয়েছি।

‘প্রতিদিনই ক্যাম্পাসে একেক দিন কোনো না কোনো ইফতার আয়োজন লেগেই থাকে। বিভাগের সিনিয়র-জুনিয়র, ব্যাচমেট, জেলা ছাত্র কল্যাণ ছাড়াও অনেক মাধ্যমে ইফতার আয়োজন করা হয়ে থাকে৷ এভাবে পুরো রমজান মাসই একের পর এক সংগঠনের ইফতার আয়োজন চলতেই থাকে। এতে সবার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে পুরো ক্যাম্পাস৷ ইফতারের সময় ক্যাম্পাসে ইফতারের মাধ্যমে যেন নিজের পরিবারের অভাবটা পূরণ হয়।’

এ ছাড়া প্রথম রোজা থেকেই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাফেটেরিয়ায় ইফতার আয়োজন করা হচ্ছে৷ শিক্ষার্থীদের জন্য একটি শরবত ও সাতটি আইটেমের সমন্বয়ে ৪০ টাকা মূল্যের ইফতার প্যাকেজ রমজান মাসব্যাপী চালু থাকবে। শিক্ষার্থীদের সুবিধার্থে ক্যাফেটেরিয়ার মধ্যেই ইফতার আয়োজন করা হয়েছে বলে জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

এ বিভাগের আরো খবর