১৯৭১ সালে প্রাথমিক স্কুল ছিল প্রায় ৩৬ হাজার। এখন দেশজুড়ে জালের মতো ছড়িয়ে আছে ৬৫ হাজার ৫৬৬টি প্রাথমিক স্কুল। একাত্তরের ৫ হাজার ১৭০টি হাইস্কুলের জায়গায় এখন প্রায় ১৯ হাজার হাইস্কুল।
মাত্র ছয়টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল দেশ। এখন দেশে ১৫৩টি বিশ্ববিদ্যালয়। যার মধ্যে পাবলিক ৪৬টি আর বেসরকারি ১০৫টি। দুটি বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক।
শুধু অবকাঠামোর দিকে তাকালে গত ৫০ বছরে শিক্ষার বিস্তার ঘটেছে বিস্ময়করভাবে।
প্রতি বছর শুরুর দিনটিতে সারা দেশে সাড়ে ৪ কোটি শিক্ষার্থীর হাতে ৩৫ কোটি পাঠ্যবই বিনামূল্যে তুলে দিচ্ছে সরকার, যা শুরু হয়েছিল ২০১০ সাল থেকে।
সবচেয়ে বড় অগ্রগতি ঘটেছে নারী শিক্ষায়। ১৯৭০-৭১ সালে দেশের মোট শিক্ষার্থীর ২৮ শতাংশের কিছু বেশি ছিল নারী শিক্ষার্থী। শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) ২০২০ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী বর্তমানে এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫২ শতাংশ, যা মাধ্যমিকে প্রায় ৫৬ শতাংশ। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও নারী শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণ ক্রমাগত বাড়ছে।
ইউনেসকো ইনস্টিটিউট ফর স্ট্যাটিসটিক্সের (ইউআইএস) ২০২০ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে প্রাথমিকে শিক্ষার্থী ভর্তির হার প্রায় শতভাগ। এক দশক আগেও যা ছিল ৬১ শতাংশ। এ ছাড়া দেশে সাক্ষরতার হার এখন প্রায় ৭৩ শতাংশ, যা ২০০৮ সালে ছিল ৪৭ শতাংশ।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রতিনিয়ত কমছে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা। বর্তমানে এ সংখ্যা প্রায় ১৮ শতাংশ, যা ২০১০ সালে ছিল ৩৯ দশমিক ৫ শতাংশ।
প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে উন্নত ও আধুনিক করা হচ্ছে। বর্তমানে ৬৫ হাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মাধ্যমিক পর্যায়ের ২৩ হাজারের অধিক স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় স্থাপন করা হয়েছে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম।
শিক্ষাবিদরা বলছেন, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশেও এসব অর্জন উল্লেখ করার মতো সাফল্য।
একই সঙ্গে তারা বলছেন, স্বাধীনতার ৫০ বছরেও কাঙ্ক্ষিত ও মানসম্পন্ন শিক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যায়নি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ‘প্রাথমিকে শতভাগ ভর্তি, নারী শিক্ষায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি, বিনা মূল্যে বই বিতরণের মতো সাফল্য আমরা গত ৫০ বছরে অর্জন করেছি। তবে এর বাইরেও বেশ কিছু ঘাটতি রয়েছে।’
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শিক্ষা-দর্শন বোঝার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন এই শিক্ষাবিদ। তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু প্রজাতন্ত্রের সব শিশুকে একমুখী শিক্ষার আওতায় এনেছিলেন এবং শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করেছিলেন। এর মধ্য দিয়ে দেশে শিক্ষার ভিত রচনা করতে চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তাকে হত্যার মধ্য দিয়ে এই দর্শন থেকে বাংলাদেশ অনেক দূরে সরে যায়। এর মাধ্যমে শিক্ষা ক্ষেত্রে সৃষ্টি হয় বৈষম্য। এই বৈষম্য নিয়েই আমাদের ছেলেমেয়েরা উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত যায়।
‘এ কথা বলতে আমার দ্বিধা নেই, দেশে শিক্ষা ক্ষেত্রে অবকাঠামোগত অনেক উন্নয়ন হয়েছে, কিন্তু মানসিকভাবে যে উন্নয়ন হওয়ার কথা ছিল, সেই জায়গায় আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। এখন প্রয়োজন পাঠ্যক্রম এবং শিক্ষা পদ্ধতির ব্যাপক পরিবর্তনের মাধ্যমে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করা।’
শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘স্বাধীনতার ৫০ বছরে অন্যান্য খাতের মতো শিক্ষা খাতেও অনেক অর্জন রয়েছে। তবে এ কথা ঠিক, এ সময়ে আমাদের যতটা শিক্ষার বিস্তার ঘটেছে, ততটা মান উন্নয়ন হয়নি। এ জন্য আমাদের শিক্ষার মান বৃদ্ধির দিকে নজর দিতে হবে।’
বাজেটে শিক্ষায় বরাদ্দ বৃদ্ধির ওপর জোর দেন এই শিক্ষাবিদ। তিনি বলেন, ‘স্বাধীনতার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ড. কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন গঠন করেছিলেন। সেই কমিশন যে শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেছিল, সেখানে বলা হয়েছিল জিডিপির ৫ থেকে ৭ শতাংশ অর্থ শিক্ষায় বরাদ্দের কথা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, আমরা এখনও এই কাজটি করতে পারিনি।’
মানসম্মত শিক্ষা বিস্তারে জোর দেয়ার কথা বললেন হারম্যান মেইনার কলেজের অধ্যক্ষ রাফিয়া আক্তার। তিনি বলেন, ‘গত ৫০ বছরের দেশের শিক্ষা ক্ষেত্রে অনেকগুলো লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে। এখন আমাদের উচিত মানসম্মত শিক্ষা বিস্তারে জোর দেয়া।’
তিনি আরও বলেন, ‘কেউ যেন শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত না হয় সেদিকে আমাদের সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে এবং যে বিষয়েই সে পড়াশোনা করুক না কেন, সে যেন বিশ্বায়নের উপযোগী হিসেবে গড়ে উঠতে পারে সে অনুযায়ী কারিকুলাম ও দক্ষ শিক্ষক গড়ে তুলতে হবে।’