জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৬তম শাহাদৎবার্ষিকী উপলক্ষে বিশেষ আলোচনা অনুষ্ঠান করেছে কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অফ বাংলাদেশ।
রোববার বিকেলে ভার্চুয়াল সভায় প্রধান আলোচক ছিলেন বঙ্গবন্ধু চেয়ার প্রফেসর ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান। উদ্বোধনী বক্তব্য দেন কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অফ বাংলাদেশ-এর প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, বোর্ড অফ ট্রাস্টিজ ড. চৌধুরী নাফিজ সরাফাত।
সভায় উপস্থিত ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. মুহাম্মদ মাহফুজুল ইসলাম, বিভিন্ন ফ্যাকাল্টির প্রধান, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা।
অনুষ্ঠান সার্বিকভাবে পরিচালনা করেন কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অফ বাংলাদেশ-এর বোর্ড অফ ট্রাস্টিজের সিনিয়র অ্যাডভাইজার প্রফেসর ড. এইচ এম জহিরুল হক।
প্রধান আলোচক বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, “বঙ্গবন্ধু ছিলেন সোনার বাংলার স্বপ্নদ্রষ্টা। তিনি আজিমপুর বালিকা বিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘বাংলার মানুষ আমাকে যে ভালোবাসা দিয়েছে সে ভালোবাসা থেকে যদি এতটুকু দূরে সরে যাই, সেদিন আমি আপনাদের প্রধানমন্ত্রী থাকব না। প্রধানমন্ত্রিত্বের জন্য আমি স্বাধীনতার সংগ্রাম করি নাই।”
ড. আতিউর রহমান বলেন, ‘হত্যাকারীরা মনে করেছিল, বঙ্গবন্ধুর মতো একজন মানুষকে হত্যার মধ্য দিয়ে হয়তো বাংলাদেশের কনসেপ্ট শেষ করে দেয়া যাবে। তাদের আক্রোশ ছিল, তিনি পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ সৃষ্টি করেছিলেন, কিন্তু তারা জানত না বঙ্গবন্ধুকে শারীরিকভাবে আলাদা করলেও জনগণের প্রতি তার যে ভালোবাসা তা কেউ কেড়ে নিতে পারবে না। ৭৫ সালের পর দেশ যখন অদ্ভুত উটের পিঠে পাকিস্তানের দিকে চলছিল, তখন বিশ্বাসঘাতকেরা বলেছিল, তিনি (বঙ্গবন্ধু) নাকি এ দেশের ইতিহাসে বিশেষ কেউ নন।’
সদ্য স্বাধীন দেশ গড়ায় জাতির পিতার অবদানের কথা স্মরণ করে ড. আতিউর রহমান বলেন, ‘৭২ সালে ডলার ও তেলের দাম হঠাৎ বেড়ে গেল। এর প্রভাবে বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়তে থাকল। বঙ্গবন্ধু দেখলেন, চোরাকারবারিরা খুব সক্রিয় হয়ে উঠল। সমাজের ভেতর দুর্নীতি মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। বঙ্গবন্ধু তখন সমাজ গড়ায় মনোযোগ দিলেন।
‘বঙ্গবন্ধু তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। এক, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার জন্য কৃষিকে আধুনিক করা। দুই, অধিক জনসংখ্যার বিষয়ে সামাজিক সচেতনতা বাড়ানো। এ ছাড়া দেশের আনাচকানাচে তিনি প্রথমিক শিক্ষা পৌঁছে দিতে প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণ করেছিলেন। জ্বালানি খাতকে আত্মনির্ভরশীল করতে তিনি গ্যাস উত্তোলনের উদ্যোগ নিলেন। তিনি প্রথম পঞ্চম বার্ষিক পরিকল্পনা হাতে নিলেন।’
‘বঙ্গবন্ধু ছিলেন বাংলাদেশের হৃদয়’ উল্লেখ করে ড. আতিউর রহমান বলেন, ‘তার পদক্ষেপে সব সূচকে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু এ সময়ে ৭৫ সালের আগস্টের ঘটনা ছিল বাংলাদেশের হৃদয়ের ওপর আক্রমণ। সে আঘাত দেশকে বিপন্ন করেছিল। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ছিল ২৭৩ ডলার। তার অনুপস্থিতিতে ৭৬ সালে তা ১৩৮ ডলারে, ৭৭ সালে ১২৮ ডলারে নেমে আসে।’
বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার প্রশংসা করে ড. আতিউর রহমান বলেন, ‘আমাদের সৌভাগ্য, নানা চড়াই-উতরাইয়ের পর শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। তারই নেতৃত্বে বাংলাদেশ আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে।’
কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অফ বাংলাদেশ-এর প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, বোর্ড অফ ট্রাস্টিজ ড. চৌধুরী নাফিজ সরাফাত সাংবাদিক এ এল খতিবের লেখা ‘হু কিলড মুজিব’ বইয়ের উদ্ধৃতি দিয়ে আলোচনা শুরু করেন।
তিনি বলেন, ‘৭৫-এর ১৫ আগস্ট রেডিও স্টেশনে খোন্দকার মোশতাক ও তিন বাহিনীর প্রধান সবাই অপেক্ষমাণ। জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন মোশতাক। উপস্থিত সবাইকে ভাষণের একটি কপি দেয়া হয়। তৎকালীন সেনাবাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল শফিউল্লাহ ভাষণের কপিটি পড়ে মোশতাকের সামনেই এর প্রশংসা করেন। জবাবে খোন্দকার মোশতাক বলেন, আপনারা কি মনে করেন এ ভাষণটি এক দিনে লেখা হয়েছে?’
চৌধুরী নাফিজ সরাফাত বলেন, ‘খোন্দকার মোশতাকের এ উক্তি থেকে বিষয়টি দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে, সপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার ঘটনাটি কিছু সেনা কর্মকর্তার উশৃঙ্খল আচরণের ফসলই শুধু নয়, এটির শিকড় অনেক গভীরে। দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের অংশ ছিল ইতিহাসের এ নির্মম ও জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড।’
তিনি বলেন, ‘কিছু প্রশ্ন ঘুরপাক খায় সারাক্ষণ। সেনাবাহিনীর চাকরিচ্যুত মেজর ডালিম ও মেজর নুর সেনা শৃঙ্খলা লঙ্ঘন করে নিয়মিত উপপ্রধান জিয়াউর রহমানের সঙ্গে দেখা করতে ক্যান্টনমেন্টে যেতেন কেন? জুনিয়র অফিসার হয়েও কর্নেল রশিদ, ফারুক প্রোটোকল না মেনে যখন তখন জিয়াউর রহমানের সঙ্গে সলাপরামর্শ করতেন কেন? চাকরিচ্যুত হওয়ার পরও কেন তারা সেনাবাহিনীর টেনিস কোর্টে খেলতে যেতেন?
‘বঙ্গবন্ধু হত্যার পেছনে কুশীলব কারা ছিলেন তা মোটামুটি চিহ্নিত। ওই সময়ের সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের কী ভূমিকা ছিল? কী করেছেন বুদ্ধিজীবীরা? রাজনীতিবিদদের ভূমিকা কী ছিল- সবই তদন্ত করে বের করে আনতে হবে। তা না হলে ওইসব খুনির প্রেতাত্মারা, যারা এখনও রাজনীতি, প্রশাসন, সাংবাদিকতা, সামরিক, বেসামরিক প্রশাসনসহ সর্বত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে, তারা আবারও বিষাক্ত ছোবল মারতে পারে। আবারও সর্বনাশ হয়ে যেতে পারে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার, বঙ্গবন্ধুর উত্তরসূরি ও দেশের একমাত্র আশা-ভরসাস্থল শেখ হাসিনার হাত ধরে তরতর করে অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে যাওয়া প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের।’
চৌধুরী নাফিজ সরাফাত বলেন, ‘আগামী প্রজন্ম জানতে চায়, কেন বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছিল? বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর কারা বঙ্গবন্ধুর খুনিদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছিল? কারা তাদের পুরস্কৃত করেছে? হত্যার বিচার যাতে না হয় এমন ব্যবস্থা কারা করেছিল? হত্যার বিচারের জন্য কেন ২১ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে? কেন নেপথ্যের মানুষদের এখন পর্যন্ত বিচার হয়নি? জিয়া-মোশতাক ছাড়াও কারা এ হত্যার নেপথ্যে ছিল? জাতির সামনে তাদের মুখোশ উন্মোচন করে দিতে হবে। যাতে ভবিষ্যতে আর কেউ এমন জঘন্য কাজ করার কথা চিন্তাও করতে না পারে।’
জাতির পিতাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে চৌধুরী নাফিজ সরাফাত বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতীক ছিলেন, গণতন্ত্রের প্রতীক ছিলেন। শোষিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত মানুষের বন্ধু ছিলেন। বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়েও প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে আমরা যে নতুন বাংলাদেশ দেখছি, সেই বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু।
‘স্বাধীনতার পরে দেশের ৮০ ভাগ মানুষ গ্রামে বাস করত। অর্থনীতি ছিল কৃষিনির্ভর। তাদের উন্নয়নে বঙ্গবন্ধু সরকার গ্রামোন্নয়নের এক সামষ্টিক কর্মসূচি গ্রহণ করেছিল। এর মধ্যে ছিল চাষাবাদ পদ্ধতির আধুনিকায়ন, গ্রাম-সমবায়, ২৫ বিঘা পর্যন্ত কৃষিজমির খাজনা মওকুফ, গ্রামীণ অবকাঠামো নির্মাণ, কুটির শিল্প স্থাপন ইত্যাদি।’
চৌধুরী নাফিজ সরাফাত বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু সরকার শিল্প খাতের উন্নতির জন্য বড় বড় শিল্প-কারখানা, ব্যাংক, বিমা ও বৈদেশিক বাণিজ্যের একাংশ জাতীয়করণ করে। তবে পরিচালনাগত অদক্ষতা ও শ্রমিক অসন্তোষের কারণে সে পদক্ষেপ সফল হয়নি।
‘দক্ষভাবে রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালনার উদ্দেশ্যে তিনি প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের উদ্যোগ নেন। কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে স্থানীয় সরকার এবং গ্রাম সরকারের ব্যবধান কমিয়ে আনতে চেয়েছেন। চেয়েছিলেন সোনার বাংলা গড়তে।’
বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টার তাগিদ দেন ড. চৌধুরী নাফিজ সরাফাত।