বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

ভিকারুননিসায় ‘ব্যয় মানেই অনিয়ম’

  •    
  • ৪ আগস্ট, ২০২১ ১০:০৩

ছোট ছোট ব্যয় হলেও সবই নিয়মের বাইরে। খরচ হলেও নথিপত্র নেই। মালামাল কেনার দাবি করা হলেও আদৌ পণ্য এসেছে কি না, তার নিশ্চয়তা নেই। ২০১৫ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত রাজধানীর স্বনামধন্য স্কুলটিতে কী কী অনিয়ম হয়েছে, তা উঠে এসেছে নিরীক্ষা প্রতিবেদনে।

ফেসবুকে ফাঁস হওয়া একটি ফোনালাপকে কেন্দ্রকে ফের আলোচনায় রাজধানীর নামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ। এর মধ্যে নিউজবাংলার হাতে এলো নানা কাজের অজুহাতে প্রতিষ্ঠানটির যাচ্ছেতাই অর্থ খরচের নথি।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর ২০১৫-১৬ অর্থবছর থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছর পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির খরচের ৫ কোটি টাকা নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে।

অনিয়মগুলো একেকটি টাকার অঙ্কে খুব বেশি নয়। তবে ছোট ছোট বেশ কিছু অনিয়ম এক হয়ে টাকার পরিমাণ বেশ বড় হয়ে দাঁড়ায়।

অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে দেখা যায়, আসবাবপত্র না পেয়েই বিল পরিশোধ, দরপত্রের বাইরে বিল পরিশোধ, বিল ভাউচার ছাড়াই টাকা খরচ, সরকারি কোষাগারে করের টাকা জমা না দেয়াসহ নানা অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে স্কুলটিতে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, গত পাঁচ বছরে ভিকারুননিসার পরিচালনা পর্ষদের সদস্য, অধ্যক্ষ ও শিক্ষক-কর্মচারীরা আয়কর বাবদ ২ কোটি ১৮ লাখ টাকা পরিশোধ করেননি।

এ অনিয়মগুলো যখন হয়েছে, তখন অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন বেশ কয়েকজন। তারা হলেন ফেরদৌসী বেগম, কেকা রায় চৌধুরী, নাজনীন ফেরদৌস, হাসিনা বেগম, সুফিয়া বেগম ও ফৌজিয়া রেজওয়ান।

এদের মধ্যে কয়েকজন দুই থেকে ৬ মাস আর সবচেয়ে বেশি সোয়া এক বছর দায়িত্ব পালন করেছেন ফৌজিয়া। তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২১ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত।

অডিট আপত্তিতে উঠে আসা অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে ফৌজিয়া নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাকে অফিশিয়ালি বিষয়টি জানানো হয়নি। যদি জানানো হয়, তাহলে আমি জবাব দেব।’

অন্য দুই সাবেক অধ্যক্ষ ফেরদৌসী বেগম ও কেকা রায় চৌধুরীও মন্তব্য করতে রাজি হননি।

ফেরদৌসী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি দায়িত্ব ছেড়েছি অনেক আগে। এসব বিষয়ে কথা বলতে চাই না।’

কেকা বলেন, ‘এখন এসব বিষয়ে কথা বলার সময় না।’

বর্তমান অধ্যক্ষ যা বলছেন

বর্তমান অধ্যক্ষ কামরুন নাহার জানালেন, এসব অনিয়মগুলো তার জানা আছে। তিনি বলেন, এগুলো হয়েছে তিনি অধ্যক্ষের দায়িত্ব গ্রহণের আগে। আর তিনি এগুলোর সমাধান চান।

নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আমাদের স্কুলের গভর্নিং বডির (পরিচালনা পর্ষদ) সভাপতির হাতে তারা প্রতিবেদনটি দিয়েছেন। আমি এখনও প্রতিবেদনটি দেখিনি। আমি দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে নিয়ম-নীতি মেনে কাজ করার জন্য চেষ্টা করছি।

‘প্রতিবেদনটি দেখে খুব সহসাই এর জবাব দেয়া হবে এবং নিয়ম অনুযায়ী আপত্তিগুলো নিষ্পত্তি করার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।’

নিরীক্ষা প্রতিবেদনে যত টাকার আপত্তি জানানো হয়েছে, তার সবগুলো সে সময়ের দায়িত্বে থাকা কর্তাব্যক্তিদের কাছ থেকে আদায়ের সুপারিশ করা হয়েছে।

এ বিষয়ে অধ্যক্ষ কামরুন নাহার বলেন, ‘সরকারের যদি পাওনা থাকে, অবশ্যই তা সরকারি কোষাগারে জমা দেয়ার ব্যবস্থা করা হবে।’

কবে নিরীক্ষা

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর গত ১৮ থেকে ২০ ফেব্রুয়ারি ভিকারুননিসার আর্থিক লেনদেন সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে নিরীক্ষা চালায়। দলটি ২০১৫-২০১৬ অর্থবছর থেকে ২০১৯-২০২০ অর্থবছর পর্যন্ত ৫ বছরের আর্থিক লেনদেন পরীক্ষা করে।

তাদের প্রতিবেদন গত মাসের শেষে জমা দেয়া হয় পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরে। এর একটি কপি স্কুল পরিচালনা পর্ষদের সভাপতিকেও দেয়া হয়েছে।

নিরীক্ষা দলের এক সদস্য নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ভিকারুননিসায় গত পাঁচ বছরের আর্থিক লেনদেন নিরীক্ষা করে ব্যাপক আর্থিক অনিয়ম পাওয়া গেছে, যা আমাদের অডিট প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।’

তিনি বলেন, ‘আমরা এই প্রতিবেদন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছি। স্কুলের গভর্নিং বডিকেও দিয়েছি জবাব দেয়ার জন্য।’

প্রতিবেদনটি জমা দেয়া হয়েছে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডেও। এখন কী ব্যবস্থা নেয়া হবে জানতে চাইলে বোর্ডের চেয়ারম্যান নেহাল আহমেদ কোনো মন্তব্য করতে চাননি।

তিনি বলেন, ‘অডিট আপত্তির বিষয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষ জবাব দেবে।’

নিরীক্ষা প্রতিবেদনে যত আপত্তি

ভ্যাট জমা না দেয়া

২০১৫-২০১৬ অর্থবছর থেকে ২০১৯-২০২০ অর্থবছর পর্যন্ত ভ্যাট বাবদ মোট ১ কোটি ৩৯ লাখ ৯৪ হাজার ১৬২ টাকা আদায় করে ভিকারুননিসা স্কুল কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে সরকারি কোষাগারে জমা দেয়া হয় ১ কোটি ৭১ হাজার ৬১৫ টাকা। আর বাকি ৩৯ লাখ ২২ হাজার ৫৪৭ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেয়া হয়নি।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে এ অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা দিয়ে চালানের কপি মন্ত্রণালয়ে জমা দিতে বলা হয়েছে।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির সম্পত্তি থেকে ভাড়া বাবদ প্রাপ্ত আয়ের ওপর ৪৫ লাখ ২৮ হাজার ৩০০ টাকার ভ্যাট সরকারি কোষাগারে জমা পড়েনি। এ অর্থ ফেরত দেয়ার দিতে নির্দেশ দেয়া হয় প্রতিবেদনে।

আয়কর ফাঁকি

প্রতিবেদনে বলা হয়, গত পাঁচ অর্থবছরে ভিকারুননিসার পরিচালনা পর্ষদের সদস্য, অধ্যক্ষ ও শিক্ষক-কর্মচারীরা মোট ২১ কোটি ৮৭ লাখ ৩৮ হাজার ২৩২ টাকা সম্মানি বাবদ নিয়েছেন। এর বিপরীতে আয়কর বাবদ ২ কোটি ১৮ লাখ ৭৩ হাজার ৮২২ টাকা পরিশোধ করা হয়নি।

প্রতিবেদনে এটি রাজস্ব ফাঁকি হিসেবে উল্লেখ করে তা শিক্ষক-কর্মচারীদের কাছ থেকে আদায় করতে বলা হয়।

দরপত্র ছাড়াই নির্মাণকাজ

ভিকারুননিসার বসুন্ধরা শাখার সিভিল, স্যানিটারি, বৈদ্যুতিক কাজের ১ কোটি ৫৯ লাখ ১১ হাজার ৬৩৯ টাকার কাজ পায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এনএইচ-কেটিএ (জেভি)। এ কাজ দেয়ার ক্ষেত্রে দরপত্র আহ্বান করার কথা থাকলে তা করা হয়নি।

নিরীক্ষা অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ কাজের বিল পরিশোধে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব প্যাডে কোনো বিল পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া পাওয়া যায়নি কাজের গুণগত মানের কোনো সনদ।

আসবাবপত্র না পেয়েও বিল পরিশোধ

আসবাব প্রতিষ্ঠান জুটো ফাইবার গ্লাসকে (তারাবো, নারায়ণগঞ্জ) ১৯০ জোড়া ফাইবার গ্লাস (হাই-লো বেঞ্চ) সরবরাহের জন্য বলা হয়। তবে ১৩০ জোড়া হাই লো বেঞ্চ সরবরাহের চালান পাওয়া যায়। আর বাকি ৬০ জোড়ার কোনো চালান পায়নি নিরীক্ষা দল। অথচ ১৯০ জোড়ার বেঞ্চেরই বিল সররবাহ করা হয়। এতে মোট ৩ লাখ ৬৬ হাজার টাকা অতিরিক্ত পরিশোধ করা হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

জুটো ফাইবার গ্লাসকে বেইলি রোড শাখায় লো বেঞ্চ এবং হাই বেঞ্চ কিনতে ১২ লাখ ৫৮ হাজার এবং বসুন্ধরা কলেজ শাখার জন্য ১১ লাখ ১৬ হাজার টাকা অনিয়মিতভাবে পরিশোধ করা হয়েছে বলেও মনে করে নিরীক্ষা দল।

এসব মালামাল আদৌ কেনা হয়েছে কি না, তাও নিশ্চিত করা যায়নি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

এ টাকা যিনি বা যারা দিয়েছেন, তার বা তাদের কাছ থেকে আদায় করার সুপারিশও করা হয়েছে।

দরপত্রের বাইরেও কাজ, টাকা পরিশোধ নিয়ে আপত্তি

গত বছর বেইলি রোডের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিতে স্কুল শাখার সীমানা প্রাচীর সংস্কারে ৪ লাখ ৬৫ হাজার ৬৭৮ টাকার দরপত্র আহ্বান করা হয়। কাজ পায় মেসার্স আদিবা কনস্ট্রাকশন। তবে দরপত্রের বাইরেও তাদের দিয়ে কাজ করানো হয়। আর সেই কাজে অতিরিক্ত বিল দেয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

ঠিকাদারকে অতিরিক্ত পরিশোধ করা হয় ১ লাখ ৭১ হাজার ৭২৭ টাকা। কিন্তু বিল পরিশোধের স্বপক্ষে কোনো নথি পায়নি নিরীক্ষা দল।

প্রাচীর নির্মাণের কাজটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ৩০ টাকা বর্গমিটার দরে করবে বলে দরপত্র দাখিল করলেও অতিরিক্ত কাজের বিল পরিশোধের সময় ২২৮ টাকা দরে বিল পরিশোধ করে কলেজ কর্তৃপক্ষ।

বিল ছাড়াই টাকা পরিশোধ

প্রতিবেদনে বলা হয়, খেলাধুলার জন্য বিভিন্ন সরঞ্জাম বিভিন্ন দোকান থেকে কেরা হয়েছে। অথচ একটি প্রতিষ্ঠানের নামে চেক ইস্যু করা হয়েছে। এর পরিমাণ ২ লাখ ৫৬ হাজার টাকা। এই অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে মনে করছে নিরীক্ষা দল।

পুরস্কারেও অনিয়ম

২০১৯ সালের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় (যা অনুষ্ঠিত হয় ২০২০ সালে) নিয়ম না মেনেই ৪৭ জন শিক্ষককে সাধারণ পুরস্কার হিসেবে ফ্রাইপ্যান দেয়া হয়। সেখানে খরচ করা হয় ৩২ হাজার ৭০০ টাকা, যা প্রতিবেদনে অপচয় হিসেবে উল্লেখ করে সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে আদায়ের সুপারিশ করা হয়েছে।

এ বিভাগের আরো খবর