ফেসবুকে ফাঁস হওয়া একটি মোবাইল ফোনালাপ নিয়ে তোলপাড় চলছে। বলা হচ্ছে, নারী কণ্ঠটি ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ কামরুন নাহারের আর পুরুষ কণ্ঠটি অভিভাবক ফোরামের নেতা মীর সাহাবুদ্দিন টিপুর।
‘নাসির’ নামে যাকে উদ্দেশ করে আক্রমণাত্মক ভাষা প্রয়োগ করা হচ্ছিল, তিনি পরিচালনা পর্ষদে মাধ্যমিক স্কুল শাখার অভিভাবক প্রতিনিধি সিদ্দিকী নাসির উদ্দিন।
তবে অধ্যক্ষ নিউজবাংলাকে বলেছেন, এটি তার কণ্ঠ নয়, ‘সুপার এডিট’ করে এটি ছাড়া হয়েছে।
তবে এই ফোনালাপ ফাঁসের পর বিরোধের উৎস অনুসন্ধান করতে গিয়ে ভিকারুননিসায় অবৈধভাবে শিক্ষার্থী ভর্তিতে টাকা লেনদেন ও উন্নয়নকাজে আর্থিক সুবিধা নিয়ে দুটি পক্ষের মধ্যে বিরোধের তথ্য পাওয়া গেছে।
এই বিরোধের একটি পক্ষে আছেন অধ্যক্ষ কামরুন নাহার, অপর একটি পক্ষে আছেন অভিভাবক ফোরাম ও পরিচালনা পর্ষদের কয়েকজন সদস্য।
নিউজবাংলার অনুসন্ধান বলছে, গত ১৮ জুলাই ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে ভর্তিবাণিজ্য, উন্নয়নকাজে আর্থিক অনিয়ম ও শিক্ষকদের সঙ্গে পরিচালনা পর্ষদের কয়েকজন সদস্যের অশোভন আচরণের অভিযোগ তদন্ত করতে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠনের পর থেকেই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে দুই পক্ষের বিরোধ।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের এ-সংক্রান্ত চিঠি ১৯ জুলাই স্কুলে পাঠানো হয়। কলেজ পরিদর্শক অধ্যাপক আবু তালেব মো. মোয়াজ্জেম হোসেন স্বাক্ষরিত চিঠিতে শিক্ষকদের সঙ্গে অশোভন আচরণ, ভর্তিসহ কলেজের যাবতীয় কাজে অযাচিত হস্তক্ষেপ, ভর্তিবাণিজ্য ও কলেজের উন্নয়ন এবং সংস্কারমূলক কাজে আর্থিক অনিয়মের চেষ্টার কথা উল্লেখ আছে।
এসব অভিযোগ খতিয়ে দেখতে তিন সদস্যের কমিটিতে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের বিদ্যালয় পরিদর্শক আবুল মনছুর ভূঞাকে আহ্বায়ক করে উপপরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (সনদ) হেলাল উদ্দিন ও উপ-কলেজ পরিদর্শক রবিউল আলমকে সদস্য করা হয়। তাদের প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করে আগামী ১৫ কর্মদিবসের মধ্যে বোর্ডের কলেজ পরিদর্শকের কাছে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়।
‘স্কুলে গরুর হাট’
গত ১৯ জুলাই ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সংবাদ সম্মেলন করে অভিভাবক ফোরাম স্কুলে গরুর হাট বসানোর ঘটনায় অধ্যক্ষ কামরুন নাহারের অপসারণ দাবি করেন।
ফোরামের সাধারণ সম্পাদক আবদুল মজিদ সুজন বলেন, ‘স্কুলে ফখরুদ্দিন বিরিয়ানি হাউজ অ্যান্ড ডেকোরেটর অবৈধভাবে গরু-ছাগলের হাট বসায়। এ জন্য অধ্যক্ষকে ৫ লাখ টাকা দেয়া হয়। অভিভাবকদের নেতৃত্বে গত ১৬ জুলাই তা উচ্ছেদ করা হয়।’
তবে অধ্যক্ষ এই অভিযোগকে ভিত্তিহীন বলেছেন। তিনি দাবি করেছেন, স্কুলে গরুর হাট বসেনি। স্কুলের বাইরে ফখরুদ্দিন বাবুর্চি যে জায়গা ব্যবহার করেন, সেখানে বসেছে।
সেখানেইবা গরুর হাট কেন – এমন প্রশ্নে অধ্যক্ষ বলেন, ‘সেটা তো আমি দায়িত্ব নেয়ার আগে থেকেই হয়ে আসছে। আর আমি এটা না করতে তাদেরকে চিঠিও দিয়েছি। তাই এ জন্য কোনো ভাড়াও নেয়া হয় না।’
ফাঁকা আসনে ভর্তি নিয়ে দ্বন্দ্ব
এবারের ভর্তি লটারির সময়ে ১২০টি আসন খালি রাখা হয়। এ ছাড়া আরও কিছু আসনে শিক্ষার্থী ভর্তি হয়নি। সব মিলিয়ে প্রায় ১৫০টি আসন খালি ছিল। এগুলোতে ভর্তির জন্য চাপ দিতে থাকে ব্যবস্থাপনা কমিটির কয়েকজন সদস্য।
অধ্যক্ষ বলছেন, তিনি এতে রাজি হননি বলে তার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ আনা হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘অভিভাবক ফোরাম চায়, আমি যেন কিছু আসন ফাঁকা রাখি, যাতে ভর্তিবাণিজ্য করা সম্ভব হয়, যা আমার দ্বারা সম্ভব নয়। আমার ইতিহাসে অন্যায়ের কোনো দাগ নেই।’
তবে ভিকারুননিসা পরিচালনা পর্ষদের সদস্য (কলেজ শাখা) মনিরুজ্জামান মিয়া এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘স্কুলে অনেকগুলো আসন ফাঁকা আছে। আমরা প্রতিষ্ঠানের স্বার্থেই ফাঁকা আসনগুলো পূরণ করতে বলেছি। এটাকে চাপ বলা যায় না।’
ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ কামরুন নাহার ও স্কুল শাখার অভিভাবক প্রতিনিধি সিদ্দিকী নাসির উদ্দিন
অধ্যক্ষ বলেন, ‘শুধু ভর্তিবাণিজ্যই নয়, তারা (ম্যানেজিং কমিটির অভিভাবক প্রতিনিধিরা) কলেজ ফান্ডের টাকা লুটপাট করতে চাচ্ছে। কিছুদিন আগে তারা পৌনে ২ কোটি টাকার ভুয়া বিল দিয়েছে। আমি এই টাকা না দেয়াতে তারা আমার রুমে তালা পর্যন্ত দিয়েছে। আমি অন্যায়ের বিরুদ্ধে কখনও মাথা নত করিনি, ভবিষ্যতেও করব না।’
পরিচালনা পর্ষদের সদস্য (কলেজ শাখা) মনিরুজ্জামান মিয়া এই বিষয়ে বলেন, ‘অনৈতিকভাবে আর্থিক সুবিধা নেয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। যদি আমরা এমন কাজ করে থাকি, তাহলে উনি অবশ্যই সুনির্দিষ্ট ফোরামে বলতে পারেন। যদি কেউ অর্থ তছরুপ করে থাকে, তাহলে তার বিরুদ্ধে মামলা হবে।’
অনিয়ম তদন্তে তদন্ত কমিটি
ভর্তিবাণিজ্য, উন্নয়নকাজে আর্থিক অনিয়ম ও শিক্ষকদের সঙ্গে অশোভন আচরণ করার অভিযোগ মোট সাতজনের বিরুদ্ধে। তারা হচ্ছেন পরিচালনা পর্ষদে মাধ্যমিক স্কুল শাখার অভিভাবক প্রতিনিধি সিদ্দিকী নাসির উদ্দিন ও ওয়াহেদুজ্জামান মন্টু, কলেজ স্তরের অভিভাবক প্রতিনিধি মনিরুজ্জামান খোকন, বাদরুল আলম, মোর্শেদা আক্তার এবং পরিচালনা পর্ষদের সংরক্ষিত নারী আসনের রীনা পারভিন ও জান্নাতুল ফেরদৌস।
এরই মধ্যে তদন্ত কমিটি স্কুল পরিদর্শন করেছে। তবে সব পক্ষের সঙ্গে কথা বলতে পারেনি।
কমিটির প্রধান আবুল মনসুর ভুঁইয়া নিউজবাংলাকে বলেন, ‘করোনায় সরকার আরোপিত কঠোর বিধিনিষেধের কারণে তদন্তকাজ আপাতত বন্ধ আছে। শাটডাউন উঠে গেলে আমরা পুরোদমে কাজ শুরু করব।’
ফাঁস হওয়া কল রেকর্ড নিয়ে যা বলছে দুই পক্ষ
ফেসবুকে ফাঁস হওয়া কল রেকর্ডে যে নারীকণ্ঠকে ভিকারুননিসার অধ্যক্ষ বলা হচ্ছে, তাকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করতে শোনা যায়। এমনও বলতে শোনা যায়, তিনি একজনকে বিবস্ত্র করে পেটানোর ইচ্ছার কথা বলছেন। এমনও বলেছেন, তিনি অস্ত্র সঙ্গে নিয়ে ঘুমান। আর তিনি রাজনীতি করে এসেছেন, তিনি ভদ্র কেউ নন।
তবে অধ্যক্ষ কামরুন নাহার দাবি করেছেন, ওটা তার কণ্ঠ নয়। তাহলে হুবহু মিল কেন?- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘ম্যানেজিং কমিটির অভিভাবক প্রতিনিধিরা ও অভিভাবক ফোরাম এই দুই গ্রুপ এক হয়ে আমার বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্র করছে, যার প্রতিফলনই এই অডিও ক্লিপ। এটি সুপার এডিট করা।’
তিনি বলেন, ‘ঢাকা শিক্ষা বোর্ড তদন্ত কমিটি গঠন করার পর থেকেই তারা আমার বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগেছে।’
তবে অভিভাবক ফোরামের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মজিদ সুজন অধ্যক্ষের এ অভিযোগকে ভিত্তিহীন বলে দাবি করেছেন। তিনি বলেন, ‘অডিও ক্লিপ ফাঁস হওয়াতে অধ্যক্ষ এখন এসব কথা বলছেন।’
কলেজ শাখার অভিভাবক প্রতিনিধি মনিরুজ্জামান খোকন বলেন, ‘ষড়যন্ত্র যদি করে থাকি, তাহলে ওনার কমপ্লেন করার জন্য জায়গা আছে। সেটার প্রতিদান কি একজন অধ্যক্ষের মুখের এমন ভাষা? সম্পর্ক খারাপের সঙ্গে এমন মুখের ভাষার কী সম্পর্ক, বলেন?’