রাজধানীর মোহাম্মদপুরে জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া মাদ্রাসা যখন হেফাজত নেতা মামুনুল হক ও তার ভাই মাহফুজুল হকের দখলমুক্ত হতে চলেছে, তখন তার অনুসারীরা গণমাধ্যমে বিবৃতি দিয়ে সতর্কতা উচ্চারণ করেছেন।
তাদের দাবি, সেই মাদ্রাসাটি নিয়ে অস্থিরতায় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
মামুনুল-মাহফুজুলের বাবা আজিজুল হক ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোটের শরিক ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যানে ছিলেন। ক্ষমতায় থাকাকালে প্রকাশ্যে মাদ্রাসাটি তিনি দখল করেন। এ নিয়ে মামলাও আছে আদালতে।
গত মার্চ ও এপ্রিলে সহিংসতার ঘটনায় মামুনুল হক ও আরও অনেক হেফাজত নেতা গ্রেপ্তার হওয়ার পর এই দখলদারিত্বের বিষয়টি সামনে আসে।
তবে আজিজুল হকের মৃত্যুর পর থেকে মাদ্রাসাটি নিয়ন্ত্রণে রাখলেও মাহফুজুল হক ও মামুনুল হককে পরিচালনা পর্ষদ থেকে বাদ দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন মাহফুজুলের ব্যক্তিগত সহকারী মাহফুজ বিন হাবিব নিজেই।
নিউজবাংলা প্রথমে এই সংবাদ প্রকাশ করে। এরপর অন্যান্য গণমাধ্যমেও প্রকাশিত হয় তথ্যটি।
এই অবস্থায় রোববার মামুনুল সমর্থক আলেমরা একজোট হয়ে বিবৃতি পাঠায় গণমাধ্যমে।
মুহাম্মদ আব্দুল মুমিন স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে বলা হয়, ‘দুই যুগ আগের বিরোধকে কেন্দ্র করে একটি পক্ষ মাদরাসার দায়িত্ব নিতে তৎপরতা চালাচ্ছে অভিযোগ করে ওই বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এমন একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অস্থিরতায় যে কোনো দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।’
গত ৩ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের রিসোর্টে অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে মুক্ত হওয়ার পর ভাই মাহফুজুল হককে নিয়ে লাইভে আসেন মামুনুল হক। দাবি করেন, রিসোর্টের নারীকে তিনি বিয়ে করেছেন।
বিবৃতিতে সই করেন মাওলানা আতাউল্লাহ হাফেজ্জি, মাওলানা নূরুল ইসলাম জিহাদি, মাওলানা ইসমাইল নূরপুরী, মাওলানা বাহাউদ্দীন জাকারিয়া, মাওলানা উবায়দুর রহমান মাহবুব, মাওলানা আবুল কালাম, মাওলানা মুনিরুজ্জামান, মাওলানা সাঈদ নূর, মাওলানা আফজালুর রহমান, মাওলানা সামিউর রহমান মুসা, মাওলানা তালহা, মাওলানা আলী উসমান, মাওলানা মাহমুদুল হাসান, মাওলানা আব্দুল আজিজ, মুফতি ইসমাইল হুসাইন, মাওলানা নোমান মুহিব্বুল্লাহ, মাওলানা মুহাম্মদ জুবায়ের।
এদের সবাই ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বিভিন্ন মাদ্রাসার মুহতামিম হিসেবে কর্মরত আছেন।
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছি, দেশের অন্যতম শীর্ষ আলেম মরহুম শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক প্রতিষ্ঠিত জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া নিয়েও অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। দুই যুগ আগের বিরোধকে কেন্দ্র করে একটি পক্ষ মাদরাসার দায়িত্ব নিতে তৎপরতা চালাচ্ছে। অনেকের অভিযোগ-- প্রশাসনেরও একটি পক্ষ তাদের সহযোগিতা করছে যা খুবই দুঃখজনক।
‘আমরা লক্ষ্য করছি যে, দেশের বিভিন্ন স্থানে কওমি মাদরাসার অভ্যন্তরীণ তুচ্ছ বিষয়কে হাতিয়ার বানিয়ে মাদরাসা দখলের তৎপরতা চালাচ্ছে একটা শ্রেণি, যা অত্যন্ত ন্যাক্কারজনক ঘটনা। আমরা এসব অপতৎরতার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি।’
বিবৃতিদাতারা বলেন, ‘জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় একটি দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বোর্ড পরীক্ষাসহ পড়ালেখার নানা দিকে রয়েছে তাদের সাফল্য। শিক্ষাবর্ষের শুরুতে এই প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়েছে সহস্রাধিক ছাত্র। এমন একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অস্থিরতা বিরাজ করলে যে কোনো দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।’
আলেমরা বলেন, ‘এই অস্থিরতা দূর হয়ে মাদ্রাসার স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরে আসুক। আলোচনার মাধ্যমে সবধরনের সংকটের সমাধান হোক এবং এ ক্ষেত্রে প্রশাসনের সহযোগিতারও আহ্বান জানাই।’
সেই মাদ্রাসা সেভাবে মুহফুজুল-মামুনুল পরিবারের দখলে
মামুনুল ও মাহফুজুলের বাবা আজিজুল হক মোহাম্মদপুরের জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া মাদ্রাসায় একজন সাধারণ শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। এরপর অধ্যক্ষ হয়েই জড়িয়ে পড়েন অনিয়মে, যে কারণে ১৯৯৯ সালে তিনি প্রতিষ্ঠান থেকে বহিষ্কৃত হন।
গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, জামিয়া আরাবিয়া মাদ্রাসায় রাজনীতি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হলেও অধ্যক্ষ হওয়ার পর আজিজুল হক সেই নিয়ম ভাঙতে শুরু করেন। রাজনৈতিক সংগঠন খেলাফত মজলিসের আমির হওয়ার সুবাদে বিএনপি সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হন। এরপর নানান অভিযোগে ১৯৯৯ সালে মাদ্রাসা থেকে তাকে চূড়ান্তভাবে বহিষ্কার করা হয়।
গত ১৮ এপ্রিল জামিয়া রহমানিয়া মাদ্রাসা থেকেই মামুনুল হককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
২০০১ সালের ৩ নভেম্বর স্থানীয় বিএনপি ও পুলিশের সহায়তায় আজিজুল হকের পরিবারের সদস্যরা মাদ্রাসাটি দখল করেন। হামলায় নেতৃত্ব দেন মামুনুল হক ও তার ভাই মাহফুজুল হক। চারদলীয় জোটের এমপি ও আজিজুল হকের এক মেয়ের ভাশুর মুফতি শহীদুল ইসলামও ছিলেন তাদের সঙ্গে।
মাদ্রাসা দখলের পর এর প্রতিষ্ঠাতা ও সরকার অনুমোদিত পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের বিতাড়িত করা হয়। অনুমোদনহীন পারিবারিক কমিটির মাধ্যমে শুরু হয় একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ। অন্যদিকে, প্রকৃত পরিচালনা কমিটির সদস্যরা বিতাড়িত হওয়ার পর মূল মাদ্রাসার কয়েক শ গজ দূরে একই নামে আরেকটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব নেন মূল জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া মাদ্রাসা থেকে বিতাড়িত অধ্যক্ষ মাওলানা হিফজুর রহমান। নতুন ওই মাদ্রাসার কার্যক্রম এখনও চলমান।
মাদ্রাসা দখলের দিন সেখানে উপস্থিত থাকা সাবেক এক শিক্ষক কথা বলেছেন নিউজবাংলার সঙ্গে। পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ‘তখন বাৎসরিক ছুটি চলছিল বলে মাদ্রাসা ছিল একেবারে ফাঁকা। শুধু আমি আর সিনিয়র শিক্ষক ও তৎকালীন কমিটির সদস্য মুফতি মনসুরুল হক এবং কিছু ছাত্র ছিলাম।
মোহাম্মদপুরের জামিয়া রহমানিয়া মাদ্রাসা। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে মাহফুজুল-মামুনুলের বাবা আজিজুল হক এটি দখলে নেন।
‘হঠাৎ করেই বিকেলে মামুনুল হক ও মাহফুজুল হকের নেতৃত্বে কয়েক শ অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী হামলা করে। তারা মাদ্রাসাজুড়ে তাণ্ডব চালায়, মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে বোমা বিস্ফোরণ করে। আমি মাদ্রাসার তৃতীয় তলার বাথরুমে ও মনসুর হুজুর একটি কক্ষে আশ্রয় নেন। তারা মাদ্রাসা দখল নেবার পর পুলিশ এসে নিরাপত্তার কথা বলে আমাদের বের করে নিয়ে যায়। বের হবার পথে লক্ষ করি মাদ্রাসার চারপাশে পুলিশ আর দুটি মাইক্রোবাস ভর্তি নানা ধরনের অস্ত্র। এরপর থেকে আমরা আর মাদ্রাসায় ঢুকতে পারিনি।’
আদালতের নির্দেশনাও উপেক্ষিত
২০০১ সালের অক্টোবরে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় আসার এক মাসের মধ্যে আজিজুল হক মোহাম্মদপুরের মাদ্রাসা দখলের পর আবদুল মালেককে প্রধান করে ৯ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি করেন।
গত ১৮ এপ্রিল জামিয়া রহমানিয়া মাদ্রাসা থেকেই মামুনুল হককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ
সেই কমিটির বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে আদালতে মামলা করে বিতাড়িত পরিচালনা কমিটি। ঢাকা জেলা জজ আদালতের সেই মামলার (নম্বর ৪১০/২০০১) রায় বিতাড়িত কমিটির বিপক্ষে যায়। আজিজুল হকের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে গেলে ২০১২ সালে হাইকোর্টও বিতাড়িত কমিটির পক্ষে রায় দেয়। হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে আপিল ২০১৪ সালে আপিল বিভাগেও খারিজ হয়।
এর মধ্যে ২০১২ সালের আগস্টে আজিজুল হক মারা যান। তবে তার মৃত্যুর পর ছেলেদের নিয়ন্ত্রণেই চলছে মোহাম্মদপুরের মাদ্রাসাটি।
আদালতে মামলার মধ্যেই ২০০৩ সালে ওয়াকফ প্রশাসন থেকে নিবন্ধন পেয়ে ২০০৬ সালে ২১ সদস্যের নতুন কমিটি গঠন করে মাদ্রাসার বিতাড়িত কমিটি। নতুন কমিটির সভাপতি আহমদ ফজলুর রহমান জমির বৈধ কাগজের ভিত্তিতে আজিজুল হকের অবৈধ কমিটিকে উচ্ছেদ করে তাদের কাছে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতে ওয়াকফ প্রশাসনে আবেদন করেন।
এই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৭ সালে মাদ্রাসার অবৈধ কমিটিকে উচ্ছেদ করতে জেলা প্রশাসক বরাবর চিঠি দেয় ওয়াকফ প্রশাসন। পরে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ২০০৮ ও ২০০৯ সালে দুইবার জেলা প্রশাসন থেকে ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করা হলেও তারা উচ্ছেদের কোনো পদক্ষেপ নেননি। ওয়াকফ কমিশনের এই আদেশের বিরুদ্ধেও উচ্চ আদালতে রিট আবেদন করেছিলেন আজিজুল হক, তবে সেটিও খারিজ হয়।
আইনি এসব লড়াইয়ের বেশ কিছু নথি পেয়েছে নিউজবাংলা। ২০০৮ ও ২০০৯ সালে মাদ্রাসাটি দখলমুক্ত করতে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. মকবুল হোসেন ও মো. কামরুজ্জামানকে দায়িত্ব দেয়া হয়। তাদের বর্তমান অবস্থান চিহ্নিত করতে পারেনি নিউজবাংলা, ফলে এ বিষয়ে তাদের বক্তব্য জানা যায়নি।