মোহাম্মদপুরের আলোচিত কওমি মাদ্রাসা জামিয়া রহমানিয়া আরাবিয়ায় কর্তৃত্ব হারাচ্ছেন আলোচিত হেফাজত নেতা মামুনুল হকের বড় ভাই মাহফুজুল হক। কেবল তিনি নিজে নন, মাদ্রাসাটি তিনি যাদেরকে নিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতেন, তাদের সবাইকেই বাদ দেয়া হচ্ছে।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে মাদ্রাসাটা দখলে নেন সে সময় বিএনপির শরিক ইসলামী ঐক্যজোটের নেতা আজিজুল হক। তার ছেলে মাহফুজুল হক মাদ্রাসাটির অধ্যক্ষ।
গত এপ্রিলের শুরুতে মামুনুল হক নারায়ণগঞ্জের একটি রিসোর্টে নারী নিয়ে অবরুদ্ধ হওয়ার দুই সপ্তাহ পর ১৮ এপ্রিল গ্রেপ্তারের পর তার পরিবারের মাদ্রাসা দখলের বিষয়টি আবার সামনে আসে।
সেই বিতর্ক স্থিমিত হয়ে আসার মধ্যেই মাহফুজুলকে তার দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়ার ঘটনা ঘটেছে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন তার ব্যক্তিগত সহকারী মাহফুজ বিন হাবিব।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘যারা মাদ্রাসা পরিচালনা পর্ষদে আছে, তারা মাদ্রাসা ছেড়ে দিচ্ছে।’
পরিচালনা পর্ষদের সব সদস্যই দায়িত্ব ছাড়ছেন কি না, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘জ্বি, জ্বি’।
কী কারণে পরিচালনা পর্ষদ মাদ্রাসা ছাড়ছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা সরকারি সিদ্ধান্ত, আমাদের সিদ্ধান্ত না। আমাদের মৌখিকভাবে জানানো হয়েছে। এখনও নোটিশ আসেনি। কবে থেকে সিদ্ধান্ত বলবৎ হবে, এটা সরকার বলতে পারবে।’
মাদ্রাসায় কর্তৃত্ব হারালে মাহফুজুল কোন পদে থাকবেন, এমন প্রশ্নে তিনি কিছু বলতে চাননি। বলেন, তারা বিজ্ঞপ্তি দেবেন, সেখানেই সব উল্লেখ থাকবে।
মাহফুজুল হক কওমি মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড বেফাকুল মাদারাসিল আরাবিয়ার মহাসচিব। পাশাপাশি তিনি সদ্য বাতিল হয়ে যাওয়া হেফাজতে ইসলামের কমিটির নায়েবে আমির ছিলেন।
মামুনুল হেফাজতের যে কমিটিতে যুগ্ম মহাসচিব ছিলেন, সেই কমিটির নায়েবে আমির ছিলেন মাহফুজুল হক। গত নভেম্বরের সম্মেলন শেষে হেফাজতের কমিটি ঘোষণা করেন মাহফুজুলইমাহফুজুলের ভাই মামুনুল হক নিজেও এই মাদ্রাসার শিক্ষক। নেতৃত্বে পরিবর্তন আসলেও তাকে মাদ্রাসা থেকে বাদ দেয়া হচ্ছে কি না, সেটি নিশ্চিত করেননি মাহফুজ বিন হাবিব।
তিনি বলেন, ‘মাওলানা মামুনুল হক এখানকার শিক্ষক। তিনি তো এখন ভেতরে (জেলে)। উনি বাইরে থাকলে বলতে পারলাম। এটা উনার বিষয় তিনি থাকবে কি থাকবেন না।’
তবে মাহফুজুল হকের বক্তব্য পাওয় যায়নি। গত দুই দিন ধরে তার ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলেও তিনি কল ধরেননি।
মোহাম্মদপুরের সাতমসজিদ রোডের মাদ্রাসায় গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি। পাশেই তার বাসা। তবে সেখানেও একাধিক দিন গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি।
ওই মাদ্রাসায় গেলে সেখানকার কর্মীরা মাহফুজুলের ব্যক্তিগত সহকারীর সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।
মাহফুজুলের সঙ্গে কথা বলিয়ে দেয়ার অনুরোধ করেল তার সহকারী বলেন, ‘আপনার ইমেইল আইডিটা দেন। আপনাকে প্রেস রিলিজ দেয়া হবে। সেখানে ওনার বক্তব্য থাকবে।’
১৮ এপ্রিল এই মাদ্রাসা থেকেই মামুনুল হককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
সেই মাদ্রাসা সেভাবে মুহফুজুল-মামুনুল পরিবারের দখলে
মামুনুল ও মাহফুজুলের বাবা আজিজুল হক মোহাম্মদপুরের জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া মাদ্রাসায় একজন সাধারণ শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। এরপর অধ্যক্ষ হয়েই জড়িয়ে পড়েন অনিয়মে, যে কারণে ১৯৯৯ সালে তিনি প্রতিষ্ঠান থেকে বহিষ্কৃত হন।
গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, জামিয়া আরাবিয়া মাদ্রাসায় রাজনীতি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হলেও অধ্যক্ষ হওয়ার পর আজিজুল হক সেই নিয়ম ভাঙতে শুরু করেন। রাজনৈতিক সংগঠন খেলাফত মজলিসের আমির হওয়ার সুবাদে বিএনপি সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হন। এরপর নানান অভিযোগে ১৯৯৯ সালে মাদ্রাসা থেকে তাকে চূড়ান্তভাবে বহিষ্কার করা হয়।
গত ১৮ এপ্রিল জামিয়া রহমানিয়া মাদ্রাসা থেকেই মামুনুল হককে গ্রেপ্তার করে পুলিশতবে ২০০১ সালের ৩ নভেম্বর স্থানীয় বিএনপি ও পুলিশের সহায়তায় আজিজুল হকের পরিবারের সদস্যরা মাদ্রাসাটি দখল করেন। হামলায় নেতৃত্ব দেন মামুনুল হক ও তার ভাই মাহফুজুল হক। চারদলীয় জোটের এমপি ও আজিজুল হকের এক মেয়ের ভাশুর মুফতি শহীদুল ইসলামও ছিলেন তাদের সঙ্গে।
মাদ্রাসা দখলের পর এর প্রতিষ্ঠাতা ও সরকার অনুমোদিত পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের বিতাড়িত করা হয়। অনুমোদনহীন পারিবারিক কমিটির মাধ্যমে শুরু হয় একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ। অন্যদিকে, প্রকৃত পরিচালনা কমিটির সদস্যরা বিতাড়িত হওয়ার পর মূল মাদ্রাসার কয়েক শ গজ দূরে একই নামে আরেকটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব নেন মূল জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া মাদ্রাসা থেকে বিতাড়িত অধ্যক্ষ মাওলানা হিফজুর রহমান। নতুন ওই মাদ্রাসার কার্যক্রম এখনও চলমান।
মাদ্রাসা দখলের দিন সেখানে উপস্থিত থাকা সাবেক এক শিক্ষক কথা বলেছেন নিউজবাংলার সঙ্গে। পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ‘তখন বাৎসরিক ছুটি চলছিল বলে মাদ্রাসা ছিল একেবারে ফাঁকা। শুধু আমি আর সিনিয়র শিক্ষক ও তৎকালীন কমিটির সদস্য মুফতি মনসুরুল হক এবং কিছু ছাত্র ছিলাম।
মোহাম্মদপুরের জামিয়া রহমানিয়া মাদ্রাসা। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে মাহফুজুল-মামুনুলের বাবা আজিজুল হক এটি দখলে নেন‘হঠাৎ করেই বিকেলে মামুনুল হক ও মাহফুজুল হকের নেতৃত্বে কয়েক শ অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী হামলা করে। তারা মাদ্রাসাজুড়ে তাণ্ডব চালায়, মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে বোমা বিস্ফোরণ করে। আমি মাদ্রাসার তৃতীয় তলার বাথরুমে ও মনসুর হুজুর একটি কক্ষে আশ্রয় নেন। তারা মাদ্রাসা দখল নেবার পর পুলিশ এসে নিরাপত্তার কথা বলে আমাদের বের করে নিয়ে যায়। বের হবার পথে লক্ষ করি মাদ্রাসার চারপাশে পুলিশ আর দুটি মাইক্রোবাস ভর্তি নানা ধরনের অস্ত্র। এরপর থেকে আমরা আর মাদ্রাসায় ঢুকতে পারিনি।’
আদালতের নির্দেশনাও উপেক্ষিত
২০০১ সালের অক্টোবরে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় আসার এক মাসের মধ্যে আজিজুল হক মোহাম্মদপুরের মাদ্রাসা দখলের পর আবদুল মালেককে প্রধান করে ৯ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি করেন।
সেই কমিটির বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে আদালতে মামলা করে বিতাড়িত পরিচালনা কমিটি। ঢাকা জেলা জজ আদালতের সেই মামলার (নম্বর ৪১০/২০০১) রায় বিতাড়িত কমিটির বিপক্ষে যায়। আজিজুল হকের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে গেলে ২০১২ সালে হাইকোর্টও বিতাড়িত কমিটির পক্ষে রায় দেয়। হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে আপিল ২০১৪ সালে আপিল বিভাগেও খারিজ হয়।
এর মধ্যে ২০১২ সালের আগস্টে আজিজুল হক মারা যান। তবে তার মৃত্যুর পর ছেলেদের নিয়ন্ত্রণেই চলছে মোহাম্মদপুরের মাদ্রাসাটি।
আদালতে মামলার মধ্যেই ২০০৩ সালে ওয়াকফ প্রশাসন থেকে নিবন্ধন পেয়ে ২০০৬ সালে ২১ সদস্যের নতুন কমিটি গঠন করে মাদ্রাসার বিতাড়িত কমিটি। নতুন কমিটির সভাপতি আহমদ ফজলুর রহমান জমির বৈধ কাগজের ভিত্তিতে আজিজুল হকের অবৈধ কমিটিকে উচ্ছেদ করে তাদের কাছে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতে ওয়াকফ প্রশাসনে আবেদন করেন।
এই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৭ সালে মাদ্রাসার অবৈধ কমিটিকে উচ্ছেদ করতে জেলা প্রশাসক বরাবর চিঠি দেয় ওয়াকফ প্রশাসন। পরে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ২০০৮ ও ২০০৯ সালে দুইবার জেলা প্রশাসন থেকে ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করা হলেও তারা উচ্ছেদের কোনো পদক্ষেপ নেননি। ওয়াকফ কমিশনের এই আদেশের বিরুদ্ধেও উচ্চ আদালতে রিট আবেদন করেছিলেন আজিজুল হক, তবে সেটিও খারিজ হয়।
আইনি এসব লড়াইয়ের বেশ কিছু নথি পেয়েছে নিউজবাংলা। ২০০৮ ও ২০০৯ সালে মাদ্রাসাটি দখলমুক্ত করতে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. মকবুল হোসেন ও মো. কামরুজ্জামানকে দায়িত্ব দেয়া হয়। তাদের বর্তমান অবস্থান চিহ্নিত করতে পারেনি নিউজবাংলা, ফলে এ বিষয়ে তাদের বক্তব্য জানা যায়নি।