দেড় বছর ধরে বন্ধ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল। সচল হয়নি পরিবহন ব্যবস্থা। তবুও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নেয়া হচ্ছে পরিবহন ফি। এমনকি বন্ধ হলের ‘সিট ভাড়া’ হিসেবে দুই বছরের ফি জমা দিতেও বলা হয়েছে।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বিস্তার রোধে গত বছরের মার্চে বন্ধ ঘোষণা করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বন্ধ হয়ে যায় আবাসিক হলগুলোও। এ অবস্থায় প্রায় দেড় বছর আবাসিক হলে না থেকে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহনে না চড়লেও হল এবং পরিবহন ফি নেয়ায় ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, ‘আমাদের সাথে অন্যায্য ও বৈষম্যমূলক আচরণ করছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এসব দেখার কেউ নেই। শিক্ষার্থীরা যেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে জিম্মি।’
শিক্ষার্থীদের অভিযোগের স্পষ্ট জবাব না দিলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল সেবা কার্যক্রম সীমিত পরিসরে হলেও ক্রিয়াশীল রাখতে হয়। তবে এগুলো থেকে শিক্ষার্থীরা কোনো সুবিধা পাচ্ছেন না, এটা সত্য। অল্প কিছু পয়সা শিক্ষার্থীদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ, সেটিও আমরা বুঝি।’
এসব ফি মওকুফ করা হবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আর্থিক বিষয় হওয়ার কারণে এ ব্যাপারে তাৎক্ষণিক কিছু বলা কঠিন। হুটহাট সিদ্ধান্ত নিলে প্রতিষ্ঠিত সেক্টরে বড় আকারের ধাক্কা পড়ে কি না সেটিও আমাদের দেখতে হবে। শিক্ষার্থীরা কিছু সুবিধা পেলে সেটিই তো আমাদের পাওয়া হয়।’
করোনাকালের শুরুতে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বলা হয়েছিল শিক্ষার্থীদের এসব ফি কমানোর বিষয়টি বিবেচনা করা হবে। সে কথা স্মরণ করিয়ে দিলে উপাচার্য বলেন, ‘সেটি দেখা যাক। এখনো সেগুলো দেখার সুযোগই হয়নি।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জুলাই মাস থেকে শিক্ষার্থীদের স্বশরীরের বা অনলাইনে পরীক্ষা শুরুর কথা রয়েছে। পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য শিক্ষার্থীদের ভর্তি হতে হয়। আর ভর্তি হতে গিয়েই সামনে এসেছে ‘অযাচিত ফি’ আদায়ের এসব বিষয়।
ভর্তির রসিদে দেখা যায়, আবাসিক হল ফি ছাড়া মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে সর্বমোট নেয়া হচ্ছে ৩ হাজার ৭১৫ টাকা, বিজ্ঞান বিভাগ থেকে ৪ হাজার ২৮৫ টাকা এবং বাণিজ্য বিভাগ থেকে নেয়া হচ্ছে ৪ হাজার ৮৫ টাকা। এর মধ্যে ‘পরিবহন ফি’ হিসেবে নেয়া হচ্ছে ১ হাজার ৮০ টাকা। এ ছাড়া আবাসিক হলভেদে শিক্ষার্থীদের দিতে হবে গত বছরসহ এই বছরের ‘সিট ভাড়া’।
এ বিষয়ে ভাষা বিজ্ঞান বিভাগের আবাসিক শিক্ষার্থী আসিফ মাহমুদ বলেন, ‘করোনা মহামারিতে আমাদের পরিবারগুলো আর্থিক সংকটে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকায় টিউশনি নেই বললেই চলে। হল বন্ধ থাকায় অনেককে মেস ভাড়া নিয়ে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে। ঠিক সে সময়ে শিক্ষার্থীদের থেকে অযাচিত ফি আদায়ের চেষ্টা দুঃখজনক।’
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মাহবুব রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘করোনাকালীন ছাত্রদের অর্থনৈতিক অবস্থা নাজুক। অনেক শিক্ষার্থীর উপার্জন ছিল টিউশননির্ভর। দেড় বছর ধরে তা বন্ধ। এ সময়ে বন্ধ বিশ্ববিদ্যালয়ের হল থেকে আমরা কোনো সেবা নিইনি, হলে না থেকে কেন আমাদের চার্জগুলো দিতে হবে? শিক্ষার্থীদের ডাবল খরচ করার সামর্থ্য নেই।’
ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী আবদুল্লাহ মাহমুদ বলেন, ‘আমরা চাই পরিবহন ফিসহ যাবতীয় অন্যায্য ফি বাতিল করা হোক। অন্যসব ঘটনায় বিশ্ববিদালয়ের শিক্ষকরা সরব থাকলেও শিক্ষার্থীদের সমস্যায় তারা নীরব।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে ডাকসুর সাবেক সহসম্পাদক সাদ্দাম হোসেন বলেন, ‘হল বন্ধ থাকা অবস্থায় আবাসিক ফি, পরিবহন ফি গ্রহণ করা শিক্ষার্থীদের সাথে তামাশারই নামান্তর। এই সিদ্ধান্তগুলো সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাহার করা উচিত।’
হলের সিট ভাড়া ও পরিবহন ফি প্রত্যাহারে হলগুলোর কিছু করার নেই বলে জানান প্রভোস্ট স্ট্যান্ডিং কমিটির সভাপতি অধ্যাপক আবদুল বাছির। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আবাসিক হলগুলো স্বতন্ত্র কোনো বিষয় না, এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অঙ্গ। বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্দেশনার বাইরে হল কোনো কিছুই করতে পারে না। আমরা যদি শিক্ষার্থীদের থেকে এক টাকা কম নিই তাহলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে জবাবদিহি করতে হবে ৷ তবে বিশ্ববিদ্যালয় যদি আমাদের ফি মওকুফ বা কম নেয়ার কোনো নির্দেশনা দেয় অবশ্যই আমরা সেভাবে চলব।’
রেগে গেলেন কোষাধ্যক্ষ
গাড়িতে না চড়েও ভাড়া গোনার বিষয় নিয়ে জানতে চাইলে রেগে যান বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক মমতাজ উদ্দীন। তিনি বলেন, ‘বিআরটিসির ভাড়া কে দেবে, তুমি দিবা? শিক্ষার্থীরা পরিবহনে না চড়লেও বিআরটিসিকে ভাড়া দিতে হচ্ছে। তাই এসব টাকা নেয়া হচ্ছে।’
তিনি জানান, পরিবহন ফি হিসেবে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বছরে নেয়া হচ্ছে ১০৮০ টাকা করে। বছরে চালু থাকা সময় ২৫০ দিন ধরলে পরিবহন বাবদ দৈনিক ব্যয় ৪ টাকা ৩২ পয়সা। এ সামান্য টাকা নিয়ে প্রশ্ন তোলায় তিনি বিস্মিত।
তবে কোষাধ্যক্ষের বক্তব্যের সাথে মিল নেই বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন ম্যানেজার আতাউর রহমানের বক্তব্যে। আতাউর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বিআরটিসির সাথে আমাদের চুক্তি বাস হিসেবে না, ট্রিপ হিসেবে। যত ট্রিপ বাস চলবে সে অনুযায়ী টাকা। ট্রিপ না দিলে টাকা নেই। এখন যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ, তাই ট্রিপ বন্ধ। সুতরাং তাদের টাকা দেয়ার প্রশ্নই ওঠে না।’
‘গাড়ি না চললে ভাড়া নেই’ এমন বিষয় সম্পর্কে উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামানকে প্রশ্ন করা হলে তিনি পরিবহন ম্যানেজারের বক্তব্যকে সমর্থন করেন। তবে শিক্ষার্থীদের পরিবহন ফি প্রত্যাহারের ব্যাপারে অবস্থান স্পষ্ট করেননি উপাচার্য।