রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য হিসেবে চার বছরের জন্য ২০১৭ সালের ১ জুন নিয়োগ পেয়েছিলেন ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ। সেই হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের এ অধ্যাপকের মেয়াদ শেষ হয়েছে সাত দিন আগে।
যদিও ১৪ জুন যোগ দেয়ায় একটি পক্ষের দাবি উপাচার্যের মেয়াদ শেষ হবে ওই দিন। তবে ১ জুন তার মেয়াদ শেষ হয়েছে ধরে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের দাবি, উপাচার্য হিসেবে নানা সমালোচনার জন্ম দেয়া কলিমউল্লাহর বিদায়ে ক্যাম্পাসে অনেকটাই স্বস্তি ফিরেছে।
তারা জানান, উপাচার্য হিসেবে চার বছর মেয়াদে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের হয়রানি, অপছন্দের হওয়ায় পদোন্নতি আটকে দেয়া, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে মামলা, ক্যাম্পাসে না থাকাসহ নানা সমালোচনার জন্ম দেন কলিমউল্লাহ।
এ সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক কার্যক্রমে স্থবিরতাসহ দেখা দেয় চরম বিশৃঙ্খলা। ভেঙে পড়ে প্রশাসনিক ‘চেইন অব কমান্ড’। নষ্ট হয় শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক।
এ কারণে তার তৈরি করা নানা বিশৃঙ্খলা ও পছন্দের প্রশাসন এখনও থাকলেও অন্তত শান্তিতে দম ফেলার পরিবেশ ফিরেছে।
বর্তমানে রাজধানী ঢাকায় অবস্থান করা উপাচার্য কলিমউল্লাহর বিরুদ্ধে যত অভিযোগ-
ক্যাম্পাসে না থাকা
উপাচার্য কলিমউল্লাহর বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি প্রচার পাওয়া অভিযোগ তিনি অধিকাংশ সময় ক্যাম্পাসে থাকেননি।
বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন উপস্থিত না থাকায় একপর্যায়ে বিরক্ত হয়ে গত বছরের ৩ জুন ক্যাম্পাসের শেখ রাসেল চত্বরে উপাচার্যের হাজিরাখাতার বোর্ড টাঙিয়ে দেয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তাদের একাংশের সংগঠন ‘অধিকার সুরক্ষা পরিষদ’ এটি করে।
সেই হাজিরাখাতার হিসাব অনুযায়ী, ১৪ জুন যোগদানের পর উপাচার্য হিসেবে কলিমউল্লাহ পেয়েছেন ১ হাজার ৪৪৭ দিন। এর মধ্যে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলেন ২৪০ দিন। অনুপস্থিত ছিলেন ১ হাজার ২০৭ দিন।
পদোন্নতি বঞ্চিত করা
কলিমউল্লাহর বিরুদ্ধে আরেক অভিযোগ যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও অপছন্দের অনেকের পদোন্নতি তিনি আটকে দেন।
অভিযোগ, পছন্দ না হওয়ায় এবং নানা অনিয়মের প্রতিবাদ করায় বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. তুহিন ওয়াদুদ, মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষক রাকিবুল ইসলাম, ভূগোল ও পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক মহুয়া শবনমসহ বেশ কয়েকজন শিক্ষকের পদোন্নতি বিনা কারণে তিনি আটকে দেন।
অথচ নিয়ন অনুযায়ী তাদের অনেকের এক থেকে দেড় বছর আগে অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পাওয়ার কথা।
কর্মকর্তাদের মধ্যে সহকারী রেজিস্ট্রার এস এম আবদুর রহিম, লাইব্রেরির উপপরিচালক মামদুদুর রহমান, সহকারী রেজিস্ট্রার মোহাম্মদ আলী, উপপরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ফিরোজুল ইসলাম, হিসাবরক্ষক বিভাগের সহকারী পরিচালক আনোয়ারুল হক, উপপরিচালক রেজাউল করীম শাহসহ অনেকের পদোন্নতিও আটকে রাখেন।
হয়রানিমূলক বরখাস্ত, মানেননি উচ্চ আদালতের নির্দেশও
অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ায় হয়রানিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয় ১৫ জন শিক্ষক-কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। কয়েকজনকে চাকরি থেকে বরখাস্তও করা হয়।
অভিযোগ, এসব শিক্ষক-কর্মকর্তা উচ্চ আদালতে রিট করে যোগদানের আদেশ নিয়ে এলে সেই আদেশও মানা হয়নি।
তাদের মধ্যে ২০১৭ সালের ১৫ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর আলমকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়। জাহাঙ্গীর হাইকোর্টে রিট করলে আদালত তার সাময়িক বরখাস্তাদেশ স্থগিত করে তাকে যোগদান করানোর নির্দেশনা দেন। তবে এখনও তাকে যোগ দিতে দেয়া হয়নি। বরং তার পদে উপাচার্যের একজন ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
২০১৯ সালের ২৩ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-রেজিস্ট্রার তারিকুল ইসলাম ও সহকারী রেজিস্ট্রার এস এম আবদুর রহিমের বিরুদ্ধে জুয়া খেলার অভিযোগে মামলা করে পুলিশ।
আবদুর রহিমের দাবি, উপাচার্যের নানা অনিয়মের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ায় পুলিশকে দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে জুয়া খেলার মিথ্যা মামলা দিয়ে গ্রেপ্তার করান। ওই দিনই এক ঘণ্টার ব্যবধানে তাদের সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়।
তিনি জানান, ২০২০ সালের ২৬ আগস্ট এ মামলার চূড়ান্ত রায়ে তাদের খালাস দেয় আদালত। এরপর ওই বছরের ৩ সেপ্টেম্বর বরখাস্তাদেশ প্রত্যাহার করে স্বপদে যোগ দেয়ার আবেদন করেন তিনি। তিন মাস পর তাকে যোগদান করার সুযোগ দেয়া হয়।
সহকারী রেজিস্ট্রার মুক্তারুল ইসলামের বিরুদ্ধে ২০২০ সালের ২৬ জুন মামলা দেয়া হয় মাদক সেবনের। ২৮ জুন তাকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়। তিনিও বেকসুর খালাস পান। তবে এখন পর্যন্ত তিনি স্বপদে যোগদান করতে পারেননি।
সহকারী রেজিস্ট্রার মোহাম্মদ আলীকে জনসংযোগ দপ্তর থেকে বদলির তিন বছর পর ওই দপ্তরের একটি আলমিরা নেয়া হয় অন্য দপ্তরে। সেই আলমিরার একটি ফাইলকে কেন্দ্র করে ২০২০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর মোহাম্মদ আলীকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়।
এটিও উচ্চ আদালতের নির্দেশে স্থগিত করা হয়। তবে হাইকোর্টের নির্দেশনা বাস্তবায়ন করেনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
এ ছাড়া উপ-রেজিস্ট্রার তারিকুল ইসলাম, জিয়াউল হক, সাহানা ও শফিয়া শবনমের মূল পদ পরিবর্তন করে নিম্নপদে পদায়ন করা হয়। এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট করেন তারা।
২০২০ সালের ২৬ জানুয়ারি এ সিদ্ধান্তের ওপর স্থগিতাদেশ দেয় হাইকোর্ট। একই সঙ্গে কেন এই সিদ্ধান্ত বাতিল করা হবে না, জানতে চেয়ে ভিসি ও রেজিস্ট্রারকে কারণ দর্শানোর জন্য রুল জারি করে। তবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কোনো জবাব দেয়নি।
অতিরিক্ত পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) এটিজিএম গোলাম ফিরোজ, উপপরিচালক (অর্থ ও হিসাব) খন্দকার আশরাফুল আলম এবং উপ-রেজিস্ট্রার মোর্শেদ উল আলম রনিকে করা সাময়িক বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহার করতে আদেশ দিয়েছিল হাইকোর্ট। সেই আদেশ না মানায় তারা আদালত অবমাননার মামলা করেন। এরপরও উপাচার্য আদালতে যাননি।
এক শিক্ষককে ৩৩ বার শোকজ
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একাংশের সংগঠন বঙ্গবন্ধু পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মশিউর রহমানকে ৩৩ বার শোকজ করা হয়েছে।
মশিউর রহমানের দাবি, তিনি সব সময় উপাচার্যের অনিয়মের বিরুদ্ধে ছিলেন। তাকে দমাতে এতবার শোকজ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘আমি ওই শোকজের জবাব দিইনি। তার যা ইচ্ছে করুক। আমি তো তার অনিয়মের বিরুদ্ধে কথা বলেছি। তার অপকর্মের বিরুদ্ধে কথা বলেছি। আমরা চাই তার নজিরবিহীন শাস্তি হোক, তাহলে আরও বেশি স্বস্তি ফিরবে ক্যাম্পাসে।’
শিক্ষকদের হয়রানি
বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বশেষ ৭৬তম সিন্ডিকেট সভায় পাঁচজন শিক্ষককে সতর্কবার্তা দেয়া হয়।
তারা হলেন রসায়ন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তরিকুল ইসলাম ও সহযোগী অধ্যাপক ড. বিজন মোহন চাকী, গণিত বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মশিয়ার রহমান, লোকপ্রশাসন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আসাদুজ্জামান মণ্ডল ও গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক মাহামুদুল হক।
এর আগেও তারিকুল ইসলাম, আসাদুজ্জামান মণ্ডল, মশিয়ার রহমান, বিজন কুমার চাকীকে একাধিকবার এ ধরনের প্রশাসনিক হুমকি ও শোকজ নোটিশ দেয়া হয়েছে। তারা সবাই উপাচার্যের অনিয়মের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে আন্দোলন করছিলেন।
ভয়াবহ সেশনজট
বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থবিরতার কারণে বেশির ভাগ বিভাগের শিক্ষার্থীই দেড় থেকে দুই বছর পর্যন্ত সেশনজটে পড়েছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্টস রাইটস ফোরামের সহসভাপতি জান্নাতুল ফেরদৌস তমা বলেন, ‘বিভাগের শিক্ষকদের অবহেলার কারণেই এই সেশনজট তৈরি হয়েছে। আমরা এই সেশনজট নিরসনে অনেকবার অনেকভাবে বলেছি, আন্দোলন করেছি। কিন্তু কোনোভাবেই এই সেশনজট থেকে মুক্ত হতে পারিনি। এ কারণে আমাদের অনেকে সরকারি চাকরিতে আবেদনের যোগ্যতা হারাচ্ছেন বা হারাবেন।
শিক্ষার্থীদের নামে থানায় অভিযোগ
উপাচার্যের কর্মকাণ্ড নিয়ে ফেসবুকে লেখালেখি করায় পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী তানভীর আহমেদ ও মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষার্থী বায়েজিদ আহমেদের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ দেয়া হয়। পরে নানা চাপে সেই অভিযোগ মামলা পর্যন্ত গড়ায়নি।
বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি তুষার কিবরিয়া বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় হলো মুক্ত চিন্তার একটি বড় জায়গা। সেখানে উপাচার্যের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কেউ কথা বললে তাদের দমাতে মামলা দিতেন তিনি। ভয় দেখাতেন।
উপাচার্য কলিমুল্লাহর বিদায়ে শিক্ষার্থীরা মনে করছেন এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিবেশ ফিরে আসবে। সেশনজট দূর হবে। ক্যাম্পাস আতঙ্কমুক্ত হবে।
শিক্ষক-কর্মকর্তারা কী বলেন
বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘তিনি আমাদের বিরুদ্ধে ইচ্ছে করেই অন্যায় করেছেন। আমরা তার কঠোর শাস্তি চাই।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একাংশের সংগঠন অধিকার সুরক্ষা পরিষদের আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. মতিউর রহমান বলেন, ‘এই উপাচার্যর আমলে শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যেভাবে হয়রানি করা হয়েছে, তা কখনোই মেনে নেয়া যায় না। তিনি তো দুর্নীতির স্বর্গরাজ্য তৈরি করেছিলেন। তিনি তার অন্যায় কাজগুলোর বৈধতা দিতে একটি শক্তিশালী টিম রেখে যাচ্ছেন।
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা আসলেই কলিমউল্লাহ শূন্য বলতে পারি না। কারণ, তার গড়া প্রেতাত্মা তো রেখে যাচ্ছেন। এই প্রেতাত্মাদের বিরুদ্ধে সরকারকে কঠোর হতে হবে। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি উদ্ধার এবং উজ্জ্বল করতে হবে।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক তাবিউর রহমান প্রধান বলেন, ‘গেল ১২ বছরে নানান সংকটে ছিল বিশ্ববিদ্যালয়টি। সেগুলো থেকে বের হয়ে আসতে হবে। বিশেষ করে শিক্ষার্থীবান্ধব ভিসি চাই আমরা।’
ফোন ধরেননি উপাচার্য
বিস্তারিত জানতে উপাচার্য অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে না যাওয়ায় তাকে পাওয়া যায়নি। পরে তার মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হয়। তিনি ফোন রিসিভ করেননি।