করোনাভাইরাস মহামারিতে এক বছরের বেশি সময় বন্ধ রয়েছে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সন্তানের শিক্ষাজীবন নিয়ে উদ্বিগ্ন অভিভাবকরা। স্কুলে যাওয়ার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে আছে শিক্ষার্থীরাও। বিশেষ করে প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তরের ‘গৃহবন্দি’ শিক্ষার্থীরা। সরকারও সচেষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিতে।
শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি করোনার চলমান পরিস্থিতির মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হবে নাকি বন্ধই থাকবে, এ বিষয়ে দ্বিমুখী চাপের কথা জানিয়েছেন। সম্প্রতি তিনি আরও জানান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ১৩ জুন খুলে দেয়ার চেষ্টা থাকলেও খুলে দেয়ার মেসেজ থেকে বন্ধ রাখার মেসেজ বেশি পাওয়া যাচ্ছে।
এমন পরিস্থিতিতে নিউজবাংলা কথা বলেছে শিক্ষার্থীদের অভিভাবক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা, শিক্ষক ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে।
মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের অধিকাংশ ১৩ জুন স্কুল খুলে দেয়ার সিদ্ধান্তের পক্ষে নন। তারা বলছেন, করোনা সংক্রমণের ন্যূনতম ঝুঁকি থাকা অবস্থায় ‘টেস্ট কেস’ হিসেবে স্কুল খোলা সঠিক হবে না। কোমলমতি শিশুদের শিক্ষার ক্ষতি মেনে নেয়া কষ্টকর। কিন্তু সে ক্ষতি পোষাতে তাদের জীবনের ঝুঁকিতে ফেলা যাবে না।
এদিকে মাসের পর মাস বন্ধ থাকায় বিপাকে পড়েছে প্রায় সব বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। কিন্ডারগার্টেনের উদ্যোক্তারা পড়েছেন মহাসংকটে। তারা চাইছেন, যত দ্রুত সম্ভব স্কুল খুলে দেয়া হোক। তবে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনও সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার মতো পরিস্থিতি হয়নি।
রাজধানীর বন্ধ থাকা কদমতলী এলাকার রেঁনেসা আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে এক শিক্ষার্থী। ছবি: নিউজবাংলা
অভিভাবকরা বলছেন, বেসরকারি স্কুলগুলো আর্থিক সংকটে পড়েছে। তাই তারা দ্রুত স্কুল খোলার পক্ষে। শিশুদের শিক্ষার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে অনলাইনে ক্লাস ও পরীক্ষা নিচ্ছে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। কিন্তু বেশির ভাগের সেদিকে নজর নেই। আর সরকারি বিদ্যালয়ে অনলাইনে শিক্ষার ব্যবস্থা করা যায়নি নানা কারণে।
করোনা পরিস্থিতির কারণে আর্থিক সংকটে পড়ে ভিকারুননিসা নূন স্কুল। প্রতিষ্ঠানটি গত মে মাসের প্রথম সপ্তাহে একটি বিজ্ঞপ্তি দেয়। বিজ্ঞপ্তিতে ঈদের ছুটির আগে ১২ তারিখের মধ্যে চলতি মাসের বেতন চাওয়া হয় অভিভাবকদের কাছে। এ নিয়ে তুমুল প্রতিক্রিয়া হয়। ক্ষুব্ধ অভিভাবকরা বেতন দেননি।
১৩ জুন স্কুল খুলতে পারে, এমন খবরে এই স্কুলের অভিভাবক ফোরাম অনলাইনে তীব্র সমালোচনা করেছে।
‘আমরা ভিকারুননিসা পরিবার’ নামে একটি ফেসবুক পেজে এক পোস্টে বলা হয়, ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি ১২ জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। চলমান পরিস্থিতিতে ১৫ দিন, ৩০ দিন করে সময় না বাড়িয়ে আপাতত ২১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় বাড়ানো দরকার বলে মনে করি।’
এমন বক্তব্যে সমর্থনের পাশাপাশি অনেক অভিভাবক স্কুল খোলা নিয়ে তির্যক মন্তব্য করেছেন।
মিজানুর রহমান নামের এক অভিভাবক লিখেন, ‘করোনা মহামারি চলাকালে যেসব অভিভাবক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার ব্যাপারে সম্মতি দেবেন, তারা মূর্খ, পাগল, বিকৃত মনমানসিকতার পিতা-মাতা।’
মিরপুরের একটি বেসরকারি প্রাথমিক স্কুলের দুই শিক্ষার্থীর বাবা কাওসার চৌধুরী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘স্কুল বন্ধ থাকায় বাচ্চারা অস্থির হয়ে গেছে। ওদের আর বাসায় আটকে রাখা খুবই কষ্টকর হয়ে পড়েছে। কিন্তু করোনার যে খবর শুনছি, তাতে ওদের স্কুলে পাঠানোর সাহস করছি না। বেঁচে থাকলে পড়ালেখা করতে পারবে। আগে করোনা যাক, তারপর স্কুল খুলুক।’
আরেক অভিভাবক সাজিয়া আফরিন বলেন, ‘বাচ্চাদের জন্য ঝুঁকিমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত স্কুলে পাঠাব না। সবকিছু মেনে নিলেও বাচ্চার ক্ষতি মানতে পারব না।’
অভিভাবকদের অনেকে বলছেন, পরিস্থিতি ও প্রয়োজন বিবেচনায় কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় খোলার উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। তবু সেখানে টিকাদানসহ স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনের কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। মাধ্যমিক পর্যায়ে সিদ্ধান্ত আরও দেরিতে নেয়াটাই যুক্তিযুক্ত হবে।
বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ঐক্য পরিষদের চেয়ারম্যান এম ইকবাল বাহার চৌধুরী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এক বছরেরও বেশি সময় আমাদের স্কুলগুলো বন্ধ। সামনে কবে খুলবে আমরা তা-ও জানি না।
‘সারা দেশে ৬০ হাজার কিন্ডারগার্টেন স্কুলের মধ্যে করোনার শুরু থেকে আজ পর্যন্ত প্রায় ১০ হাজার স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে। ধার-দেনা করে অনেক দিন চলেছি। কিন্তু এখন কেউ ধার দিতেও রাজি নন। আমরা কীভাবে বেঁচে আছি সেটা বলে বোঝানো যাবে না।’
এম ইকবাল বাহার বলেন, ‘কিছুদিন আগেও সরকার আমাদের স্কুল খুলে দেবে বলে শুনেছিলাম। সে সময় আমরা ধার-দেনা করে স্কুলগুলো সংস্কার করে খোলার প্রস্তুতি নিলাম। কিন্তু স্কুল খুলল না। তখন থেকেই মূলত আমরা শেষ হয়ে গেছি।
‘তাই সরকারের কাছে আমাদের দাবি, যত দ্রুত সম্ভব স্কুলগুলো খোলার ব্যবস্থা করুন। স্কুলে করোনা মোকাবিলায় আমরা সব ধরনের চেষ্টা করব।’
প্রধান শিক্ষক এখন খেলনার দোকানি
মোহাম্মদপুরের আদাবরে অবস্থিত গ্রিন লিফ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল করোনার কারণে বন্ধ রয়েছে। জীবন চালাতে স্কুলের গেটের মুখে শিশুদের প্লাস্টিকের খেলনার দোকান সাজিয়ে বসেছেন স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান শিক্ষক নুর আক্তার ডলি।
কেমন আছেন জানতে চাইলে নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘কোনো রকমে বেঁচে আছি ভাই। কিন্তু কত দিন বেঁচে থাকব জানি না। এই খেলনার দোকান থেকে যা আয় করি, সেটা দিয়ে কোনো রকমে পেট চালাই। কিন্তু স্কুল চালাতে পারি না। প্রতি মাসে স্কুলের ভবন ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল ও পানির বিল দিতে হয়।
‘ধার-দেনা আর গ্রামের সম্পত্তি বেচে এত দিন চালিয়ে এসেছি। এখন আর পারছি না। আর কিছুদিন দেখব। তারপর সব ছেড়ে গ্রামে চলে যাওয়া ছাড়া আমার আর কোনো উপায় নেই।’
স্কুলের গেটের মুখে শিশুদের প্লাস্টিকের খেলনার দোকান সাজিয়ে বসেছেন প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান শিক্ষক নুর আক্তার ডলি। ছবি: নিউজবাংলাকরোনার কারণে ডলির মতো অসংখ্য শিক্ষক এখন আছেন অনিশ্চয়তায়।
বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ঐক্য পরিষদের তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে প্রায় ৬০ হাজার কিন্ডারগার্টেন স্কুলে প্রায় এক কোটি ছাত্র-ছাত্রী। শিক্ষক আছেন ১০ লাখ, যার মধ্যে ২০ শতাংশ স্থায়ীভাবে অন্য পেশায় চলে গেছেন।
শিক্ষকদের পক্ষ থেকে স্কুল খুলে দেয়ার দাবি জোরালো হলেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন আরও কিছুদিন পর্যবেক্ষণ করে সিদ্ধান্ত নিতে। তবে প্রাপ্তবয়স্ক ছাত্র-ছাত্রীদের টিকার আওতায় এনে তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দ্রুত খোলা যেতে পারে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য ও করোনাবিষয়ক জাতীয় কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘ঈদের পর সংক্রমণ বাড়তে পারে বলে আমরা যে ধারণা করেছি, সেটার ভালো করে ফলোআপ নিয়ে স্কুল-কলেজ খোলার সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এ জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। তাড়াহুড়া করলে হবে না। শিক্ষার আগে শিক্ষার্থীদের জীবন বাঁচাতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘এখন সংক্রমণের হার এবং মৃত্যুর সংখ্যা কম দেখেই কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া ঠিক হবে না। কারণ, শীতকালেও আমাদের সংক্রমণের হার কম ছিল। কিন্তু তখন দেশে লকডাউন ছিল না। এখনও লকডাউন চলছে। আবার সংক্রমণের হারও শীতকালের চেয়ে বেশি।
‘আমরা এখনও বুঝতেই পারছি না কেন আমাদের সংক্রমণের হার ওঠানামা করছে। আমার ধারণা, শীতকালে এমনিতেই আমরা অনেক দেশি ফ্লুতে (জ্বর, সর্দি, কাশি) আক্রান্ত হই। হয়তো এসব ফ্লুর মধ্যে বিদেশি ভাইরাস করোনা আমাদের বেশি আক্রান্ত করতে পারেনি।’
এই ভাইরোলজিস্ট বলেন, ‘তাই আমাদের আগে ভালো করে গবেষণা করতে হবে, কেন আমাদের দেশে করোনা সংক্রমণ কখনো কম, কখনো বেশি হচ্ছে। গবেষণার সেই তথ্যের ভিত্তিতে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সাবেক পরিচালক ডা. বেনজির আহমেদ মনে করেন, প্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষার্থীদের টিকা দিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া উচিত। তবে কম বয়স্কদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলতে আরও একটু পর্যবেক্ষণ প্রয়োজন।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘স্কুল-কলেজ আমাদের আরও অনেক আগেই খুলে দেয়া উচিত ছিল। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এবং প্রাপ্তবয়স্ক ছাত্র-ছাত্রীদের টিকার আওতায় এনে এটা করতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে যদি আমরা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দিতাম তাহলে সংক্রমণ হয়তো বাড়ত না। আবার ছাত্র-ছাত্রীর শিক্ষাজীবনও ব্যাহত হতো না।’
বেনজির আরও বলেন, ‘যত দ্রুত সম্ভব প্রাপ্তবয়স্ক ছাত্র-ছাত্রীদের টিকার আওতায় এনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিতে হবে। তবে কম বয়স্ক ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আর একটু পর্যবেক্ষণ করে খোলা উচিত হবে।’