শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এম আব্দুস সোবহান তার মেয়াদের শেষ দিনে ১৪১ জনকে নিয়োগ দিয়েছেন। অস্থায়ী ভিত্তিতে বিভিন্ন পদে এই নিয়োগ দিয়ে বৃহস্পতিবার দুপুরে পুলিশ পাহারায় ক্যাম্পাস ত্যাগ করেন তিনি।
এর আগে এই নিয়োগপত্রে স্বাক্ষর করতে অস্বীকৃতি জানানোয় বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার আবদুস সালামকে অব্যাহতি দেন উপাচার্য। তার স্থলে পরিষদ সেকশনের সহকারী রেজিস্ট্রার মামুন-উর-রশিদকে ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রারের দায়িত্ব দিয়ে এই নিয়োগ সম্পন্ন করেন।
ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার মামুন-উর-রশিদের স্বাক্ষরে ৯ জন শিক্ষক, ২৩ জন সেকশন অফিসার, ২৪ জন সহায়ক কর্মচারী এবং ৮৫ জন উচ্চ ও নিম্ন সহকারী নিয়োগ দেয়া হয়েছে। উপাচার্য এম আব্দুস সোবহানের বিদায় ও নতুন নিয়োগ নিয়ে দিনভর সরগরম ছিল ক্যাম্পাস।
নিয়োগের গুঞ্জনে বৃহস্পতিবার ভোর থেকে উপাচার্য ভবনের সামনে অবস্থান নেন শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী এবং ছাত্রলীগ নেতা-কর্মী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা। বেলা সাড়ে ১১ টার দিকে মহানগর ছাত্রলীগের একদল নেতা-কর্মী এসে উপাচার্য ভবনের সামনে অবস্থান নেন। পরে দুপুর সোয়া ১২টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়।
তবে মহানগর ছাত্রলীগের দাবি, তাদের ওপর হামলাকারীরা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কেউ নন, তারা উপাচার্যের ‘গুন্ডাবাহিনী’।
মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি নুর মোহাম্মদ সিয়াম বলেন, ‘ভিসি ছাত্রলীগের নাম করে বিএনপি-জামায়াতের লোকজনকে নিয়োগ দেয়ার চেষ্টা করছেন, এমন খবর পেয়ে আমরা ক্যাম্পাসে যাই। সে সময় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়। ভিসির গুন্ডাবাহিনী আমাদের ওপর হামলা চালায়।’
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতারা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। কথা বলতে রাজি হননি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর লুৎফর রহমানও।
তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রলীগ নেতা কামরুজ্জামান চঞ্চল জানান, ‘মেয়াদের শেষ দিন বৃহস্পতিবার উপাচার্য এম আব্দুস সোবহান চাকরিপ্রত্যাশী ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীকে নিয়োগ দিয়েছেন বলে প্রচার হয়। তা শুনে মহানগর ছাত্রলীগের চাকরিপ্রত্যাশীরা ক্যাম্পাসে অবস্থান নেন। তারাও চাকরি দাবি করেন। তাদের (মহানগর ছাত্রলীগ) এমন ভাব যেন এখনই তাদের নিয়োগ দিতে হবে। এ নিয়ে সেকশন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা-কাটাকাটির একপর্যায়ে তারা হামলা চালায়। এ সময় আমি এগিয়ে গেলে তারা আমাকেও লাঞ্ছিত করে।
‘ঘটনার সময় রাবি ছাত্রলীগের কিছু নেতা-কর্মী সেখানে ছিল। তারা এগিয়ে গেলে তাদের ওপরও হামলা করা হয়। পরে রাবির কর্মকর্তা কর্মচারী, ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী, স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা সংগঠিত হয়ে মহানগর ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের ধাওয়া দেয়। এ সময় পুলিশ এসে লাঠিচার্জ শুরু করলে দুই পক্ষই ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়।’
পরে বেলা সোয়া দুইটায় পুলিশি নিরাপত্তায় উপাচার্য এম আব্দুস সোবহান উপাচার্য ভবন ত্যাগ করেন এবং ক্যাম্পাস ছেড়ে বেরিয়ে যান। এই নিয়োগের বিষয়ে বিদায়ী উপাচার্যের বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
এর আগে উপাচার্য ভবনের সামনে থেকে উপস্থিত কর্মকর্তা, কর্মচারী, ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের সরিয়ে দেয় পুলিশ। পরে উপাচার্য ভবনে চাকরিপ্রত্যাশীরা প্রবেশ করে নিয়োগপত্র সংগ্রহ করে যোগদান প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন।
অব্যাহতির বিষয়ে সদ্য সাবেক রেজিস্ট্রার আব্দুস সালাম বলেন, ‘আমি এ সব ব্যাপারে কিছুই জানি না। আমাকে নানাভাবে অনৈতিক চাপ দেয়া হয়েছিল। তাই আমি গত দুই দিন ধরে আত্মগোপনে ছিলাম।’
২০১৭ সালের ৭ মে দ্বিতীয় মেয়াদে উপাচার্য পদে নিয়োগ পান এম আব্দুস সোবহান। দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে যোগ্যতা শিথিল করে মেয়ে-জামাতাকে নিয়োগসহ নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। গত বছর ইউজিসির তদন্তে এসব অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে সব ধরনের নিয়োগ স্থগিত রাখার নির্দেশ দেয়। তবে শেষ দিনে সেই নির্দেশ উপেক্ষা করে ১৪১ জনকে নিয়োগ দিয়ে গেলেন উপাচার্য এম আব্দুস সোবহান।
শেষ মুহূর্তের নিয়োগ তদন্তে কমিটি
মেয়াদ শেষের দিন ১৪১ জনকে বিশ্বিবদ্যালয়ের বিভিন্ন পদে নিয়োগের তদন্ত করতে কমিটি গঠন করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপসচিব শামিমা বেগম স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে ওই নিয়োগ অবৈধ উল্লেখ করে চার সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) সদস্য অধ্যাপক ড মুহাম্মদ আলমগীরকে আহ্বায়ক করে ৪ সদস্যের কমিটি গঠন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন ইউজিসির সদস্য ড. মো. আবু তাহের, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের যুগ্ম সচিব ড. মো. জাকির হোসেন আখন্দ এবং ইউজিসির পরিচালক মোহাম্মদ জামিনুর রহমান।
চিঠিতে বলা হয়েছে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এম আব্দুস সোবহানের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের বিষয়ে ইতিপূর্বে ইউজিসি তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করে। তদন্ত প্রতিবেদনে উপাচার্যের বিরুদ্ধে নিয়োগ কার্যক্রমসহ আনা অভিযোগ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হওয়ায় গত বছর ১০ ডিসেম্বর পত্রের মাধ্যমে প্রশাসনিক কারণে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ধরনের নিয়োগ কার্যক্রম স্থগিত রাখার জন্য উপাচার্যকে অনুরোধ করা হয়েছিল।
কিন্তু উপাচার্য বৃহস্পতিবার তার মেয়াদের শেষ কর্মদিবসে মন্ত্রণালয়ের ওই নির্দেশনা উপেক্ষা করে বিভিন্ন পদে অবৈধ ও বিধি বহির্ভূতভাবে জনবল নিয়োগ দিয়েছেন মর্মে মন্ত্রণালয় অবহিত হয়েছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে তা অনভিপ্রেত। বিদায়ী উপাচার্য অবৈধ জনবল নিয়োগের বৈধতা প্রাপ্তির সুযোগ নেই বিধায় এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদন দাখিলের কমিটি গঠন করা হলো। আগামী সাত কর্মদিবসের মধ্যে কমিটিকে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
এদিকে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আরেকটি চিঠিতে বিশ্ববিদ্যালয়টির উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. আনন্দ কুমার সাহাকে উপাচার্যের দৈনন্দিন রুটিন দায়িত্ব পালনের জন্য বলা হয়েছে। অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে তিনি এটি পালন করবেন বলে ওই চিঠিতে বলা হয়েছে।