মানবসেবার ব্রত নিয়ে চিকিৎসক হবার স্বপ্ন দেখেন চট্টগ্রামের মেয়ে জান্নাত-ই তায়েবা। তাই করোনাভাইরাসের সংক্রমণ তুচ্ছ করে আগের রাতেই ঢাকা ছুটে এসেছেন তিনি। কারণ মেডিক্যাল কলেজের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে হবে তাকে।
ভিড় এড়িয়ে সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করতে বেছে নিয়েছেন ট্রেন। কিন্তু সেখানে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ছিটেফোঁটাও ছিল না। তাতে হতাশ আর ক্ষুব্ধ হয়েছেন তায়েবা।
তিনি বলেন, ‘করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে এক সিট ফাঁকা রাখার সিদ্ধান্ত হলেও দাঁড়ানোর জায়গা ছিল না ট্রেনে। রাজধানীর এয়ারপোর্ট স্টেশনে নেমে কোনোরকম আত্মীয়ের বাসায় উঠলাম।’
একদিকে করোনা আক্রান্ত হওয়ার ভয়, অন্যদিকে নিজের স্বপ্নপূরণ আর বাবা-মায়ের মুখ উজ্জ্বল করা– সবমিলিয়ে এই ঝুঁকির মধ্যেও পরীক্ষায় বসতে হচ্ছে তাকে।
চিকিৎসক হবার ইচ্ছা নারায়ণগঞ্জের ছেলে আজহারুল ইসলামেরও। পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে গিয়ে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হন তিনি। হাসপাতালে ভর্তি থাকতে হয়েছে ১০ দিন। করোনা নেগেটিভ সনদ নিয়েই পরীক্ষা দিতে যাচ্ছেন তিনি। কিন্তু অসুস্থ থাকায় শেষ মুহূর্তে আর নিজেকে ঝালিয়ে নেয়ার সময়টা পাননি আজহার।
‘দীর্ঘ ১০ দিন করোনা আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম,’ নিউজবাংলাকে আজহারুল বলেন। ‘গতকাল বুধবার বাসায় ফিরেছি। পড়াশোনা তেমন করতে পারিনি। ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল। করোনা যে হারে বাড়ছে, সে ক্ষেত্রে আবার নতুন করে আক্রান্ত হব না- এমনটা বলা যাবে না।’
তার মতে, পরীক্ষা পিছিয়ে দিলে উপকার হতো শিক্ষার্থীদের। যুক্তি দেখিয়ে আজহার বলেন, ‘আমার পরিচিত ১০ থেকে ১২ জন করোনা আক্রান্ত শিক্ষার্থী পরীক্ষা দিতে আসতে পারছে না।’
করোনা সংক্রমণের তীব্র এই পরিস্থিতির মধ্যে ভর্তিযুদ্ধে অংশ নেবেন প্রায় সোয়া লাখ শিক্ষার্থী।
পেছানোর দাবির মুখেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি পরীক্ষা নেয়ার সব প্রস্তুতি শেষ করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। সারা দেশে ৫৫টি কেন্দ্রে মোট ১ লাখ ২২ হাজার শিক্ষার্থী অংশ নিচ্ছেন এই ভর্তিযুদ্ধে।
এ বছর ৩৭টি সরকারি মেডিক্যাল কলেজে ৪ হাজার ৩৫০টি আসনের জন্য পরীক্ষা দিচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। ঢাকাসহ ১৫টি শহরের মোট ১৯টি মেডিক্যাল কলেজের অধীনে অনুষ্ঠিত হচ্ছে এই ভর্তি পরীক্ষা। এর মধ্যে ঢাকাতেই সবচেয়ে বেশি পাঁচটি মেডিক্যাল কলেজের অধীনে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
গত বছরের মার্চে করোনা সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর সংক্রমণের হার বর্তমানের অর্ধেক থাকাকালেই ঘোষণা করা হয় সাধারণ ছুটি। বন্ধ করে দেয়া হয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পরীক্ষা। তবে সংক্রমণ আর মৃত্যু বেড়ে যাওয়ার পরও এবার লকডাউন বা সাধারণ ছুটির মতো সিদ্ধান্ত নেয়নি সরকার। বরং জনসমাগম এড়িয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাসহ ১৮ দফা নির্দেশনা এসেছে।
স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এ এইচ এম এনায়েত হোসেন বলেন, ‘স্বাস্থ্যবিধি মেনে যেন ভর্তিপরীক্ষা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা যায়, সে বিষয়ে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।’
সংক্রমিতদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা থাকবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘যদি কেউ আশঙ্কা করে থাকেন যে তার মাঝে করোনা উপসর্গ আছে অথবা কারও মাঝে যদি সংক্রমণ থাকে, তবে আমরা তাদের আলাদাভাবে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় পরীক্ষা নেব।’
এ জন্য প্রথমবারের মতো প্রতিটি পরীক্ষাকেন্দ্রে আইসোলেশন কক্ষের ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘তাপমাত্রা পরিমাপ করে সবাইকে পরীক্ষা কেন্দ্রে প্রবেশ করতে হবে। আশা করছি সফলভাবে পরীক্ষা সম্পন্ন হবে। সবাই যার যার প্রস্তুতি নিয়ে এতে অংশগ্রহণ করতে পারবেন।’
এমন পরিস্থিতিতে পরীক্ষা নেয়াটা ঝুঁকি হিসেবে দেখছেন প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও ইউসিজি অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ।
তিনি বলেন, ‘এই মুহূর্তে পরীক্ষা নেয়া নীতিনির্ধারণী ব্যাপার। তারা চাইলে পুনরায় বিবেচনা করতে পারেন। যদি পরীক্ষা নিতেই হয়, তাহলে অবশ্যই কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে পরীক্ষা নিতে হবে। নয়তো বড় একটা ঝুঁকি তৈরি হবে।’
মহামারি নিয়ন্ত্রণে সরকার অর্ধেক যাত্রী নিয়ে গণপরিবহন চালানোর নির্দেশনা দেয়ায় শুক্রবার মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষার দিন সকালে পরিবহন সঙ্কট দেখা দিতে পারে বলে আগেই সতর্ক করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশ।
এ পরিস্থিতিতে সকালে পরীক্ষার্থীদের পর্যাপ্ত সময় হাতে নিয়ে বাসা থেকে বের হতে এবং সকাল ৮টার মধ্যে পরীক্ষা কেন্দ্রে পৌঁছতে অনুরোধ করা হয়েছে পুলিশের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে।
শুক্রবার সকাল ১০ থেকে ১১টা পর্যন্ত ঢাকা মহানগরের ১৫টি কেন্দ্রে ২০২০-২০২১ শিক্ষাবর্ষের এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষা হবে। ঢাকায় ৪৭ হাজার পরীক্ষার্থী এ পরীক্ষায় অংশ নেবে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, পরীক্ষার্থীদের মাস্ক পরে পরীক্ষা কেন্দ্রে আসতে হবে। সবক্ষেত্রে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে, সামাজিক ও শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। পরীক্ষা কেন্দ্রের প্রবেশদ্বারে সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে অথবা স্যানিটাইজ করতে হবে। কেন্দ্রের আশপাশে গাড়ি রাখা যাবে না। অভিভাবকরা কেন্দ্রের কাছে অবস্থান করতে পারবেন না। ফটোকপিয়ার, কম্পিউটার কম্পোজ ও প্রিন্টিংয়ের দোকান পরীক্ষার আগের দিন রাত ৮টা থেকে পরীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত বন্ধ থাকবে।
২০২০ সালে যেখানে ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৪ হাজারের কিছু বেশি রোগী শনাক্ত হয়েছে, সেখানে এখন এক দিনে শনাক্ত ছাড়িয়েছে সাড়ে ৬ হাজারের মতো। এই পরিস্থিতিতে গত সোমবার সরকার জনসমাগম সীমিত, বেশি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় সমবেত হওয়া নিষিদ্ধ, অফিস ও গণপরিবহনে লোকবল ৫০ শতাংশ কমানোসহ নানা নির্দেশনা দেয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) উপাচার্য মো. শরফুদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য এই ১৮ দফা নির্দেশনা বাস্তবসম্মত, তবে এ ধরনের নির্দেশনা এক থেকে দেড় মাস আগে আসা দরকার ছিল।’