শনিবার। তখনও ভোরের আলো ফোটেনি। ঘড়ির কাটা চারটা ছুঁই ছুঁই। এর মধ্যে মাদ্রাসা শিক্ষার্থী শামীম মিয়াকে ডেকে তুলতে যান শিক্ষক মোস্তাকিম বিল্লাহ।
এত ভোরে ঘুম থেকে উঠেও আবার ঘুমিয়ে পড়ে ১৪ বছর বয়সী শামীম। সঙ্গে সঙ্গে গায়ে পড়তে থাকে বেত্রাঘাত।
শামীমের কান্না ও চিৎকারে ভয়ে কুঁকড়ে যায় অন্যরা। ভয়ে ঘুম ছেড়ে উঠে সবাই।
এই পিটুনির রেশ কাটতে না কাটতেই মাসুদ রানা নামে আরেক ছাত্রকে বেদম পিটুনি সহ্য করতে হয় একই শিক্ষকের।
তার ওপর আক্রোশের কারণ, সে শিক্ষক মোস্তাকিমের কক্ষ থেকে হিটার নিয়ে আরেক শিক্ষকের কক্ষে গিয়েছিল।
তাকেও ক্রমাগত বেত্রাঘাত করা হয়।
কওমি মাদ্রাসায় ছাত্রদের নির্যাতনের বিষয়টি নতুন নয়। তবে সম্প্রতি বেশ কিছু ঘটনার ভিডিও প্রকাশের পর তুমুল আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। তবে ঘটনা কমছেই না।
গত মঙ্গলবার চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে একটি কওমি মাদ্রাসায় মায়ের দিকে ছুটে যাওয়ার পর শিশুকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গিয়ে বেদম পেটান এক শিক্ষক। পরে ওই শিক্ষককে আটক করা হয়েছে।
এ নিয়ে তুমুল আলোচনার মধ্যে শনিবার রাতে সাতকানিয়ার একটি মাদ্রাসায় চার জন শিশুকে একই কায়দায় বেত্রাঘাত করা হয়।
আরও বেশ কিছু মাদ্রাসাতেও একই ধরনের নির্যাতনের তথ্য এসেছে গত দুই দিনে।
হাটহাজারীতে একটি কওমি মাদ্রাসায় মায়ের দিকে ছুটে যাওয়ার পর শিশুকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গিয়ে বেদম পেটান শিক্ষক
রংপুরের দুটি শিশু গঙ্গাচড়া উপজেলার ইয়াহিয়া উল-উলুম কওমি মাদ্রাসার ছাত্র। পিটুনি থেকে বাঁচতে এক পর্যায়ে তারা সিদ্ধান্ত নেয়, মাদ্রাসা থেকে পালানোর।
সুযোগ বুঝে সেখান থেকে বের হয়ে দুই জন হাঁটতে হাঁটতে চলে যায় গঙ্গাচড়া থানার পাশে। সেখানে তাদেরকে খুঁজে পান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সুশান্ত কুমার সরকার।
দুই শিশুর অবস্থা সঙ্গীন দেখে পুলিশ কর্মকর্তা তাদেরকে নিয়ে যান হাসপাতালে। তাদের অবস্থা দেখে ভর্তি করে নেন স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা। তাদের শরীরের নানা স্থানে জখম রয়েছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসক।
এর মধ্যে থানা থেকে যোগাযোগ করা হয় দুই শিশুর পরিবারের সঙ্গে। মাসুদ রানার বাবা আবদুল মালেক ছেলেকে দেখতে এসে ক্ষুব্ধ হন। থানায় গিয়ে মামলা করেন শিক্ষক মোস্তাকিম বিল্লাহর বিরুদ্ধে। এরপর রাতে পুলিশ গিয়ে গ্রেপ্তার করে তাকে।
রোববার বিকেলে ওই মাদ্রাসা শিক্ষককে তোলা হয় গঙ্গাচড়া আমলি আদালতের বিচারক দিবাংশু কুমার সরকারের এজলাসে। শুনানি শেষে তিনি তাকে কারাগারে পাঠান।
ইয়াহিয়া উল-উলুম কওমি মাদ্রাসাটি উপজেলা চত্বরে প্রতিষ্ঠিত। এর পরিচালনা কমিটির সভাপতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাসলিমা বেগম।
গঙ্গাচড়া থানার ডিউটি অফিসার ওমর ফারুক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘নির্যাতনের শিকার ওই দুই শিক্ষার্থী রাতে মাদ্রাসা থেকে পালিয়ে থানা এলাকায় ঘোরাফেরা করতে থাকে। বিষয়টি নজরে আসলে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তাদের ডেকে নেন। ঘটনা শুনে প্রথমে তাদেরকে হাসপাতালে পাঠানো হয়।’
গঙ্গাচড়া হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, ব্যাথায় কাতরাচ্ছে দুই শিশু। তাদের দুই হাত পায়ে ও পিঠে জখম রয়েছে।
গঙ্গাচড়ার এই হাসপাতালে ভর্তি মাদ্রাসা শিক্ষার্থী শামীম ও মাসুদ
আহত মাসুদ রানা নিউজবাংলাকে বলে, ‘আমি বিল্লাহ হুজুরের হিটার এনে অন্য হুজুরকে দেয়ায় তিনি আমাকে মেরেছেন। আমি দেড় বছর হয় এই মাদ্রাসায় ভর্তি হয়েছি। প্রায় তিনি মারেন। তখন কিছু বলি না। ভাবি হুজুর হয় তাই মারে। কিন্তু আর সহ্য করতে না পেরে পুলিশকে বলেছি।’
শামীম মিয়া বলে, ‘আমি শনিবার ভোর চারটার দিকে ঘুম থেকে উঠি। খুব ঘুম ধরছে, আবার কখন ঘুমাইছি জানি না। বিল্লাহ হুজুর ঘুম থেকে তুলে খুব মারছে। আমার পিঠে, দুই হাত ও পায়ে ব্যাথা।’
শামীমার মা রুবিজা বেগম বলেন, ‘আমার সন্তানের বয়স ১৪ বছর। কোনোদিন মারি নাই। ওমরা শিক্ষক একটু শাসন করবে তাই বলে এইভাবে গরুর মতো মারবে তাই কী মানি নেওয়া যায়। থানাত মামলা হইচে এলা বিচার হোক। এটা দেখি যেন আর কোনো হুজুর কোনো বাচ্চাকে না মারে।’
মাসুদ রানার বাবা আব্দুল মালেক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাকে রাইতে পুলিশ ফোন করি বলচে, তোমার ছেলেক হুজুর মারছে। হাসপাতালত নাকি ভর্তি করছে। শুনি ঘুম হয় নাই,পরে পুলিশ কইছে মামলা কর। মামলা করছি। আমি এই হুজুরের বিচার চাই।’
দুই শিশুর শারীরিক অবস্থার বিষয়ে জানতে চাইলে গঙ্গাচড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা আসিফ ফেরদৌস নিউজবাংলাকে বলেন, ‘তাদের হাতে, পিঠে বড় আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। আরও চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। আরও দুদিন পর ছাড়পত্র দেয়া হবে।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাসলিমা বেগম নিউজবাংলাকে জানান, ‘আমি ওসিসহ মাদ্রাসায় যাই, অভিযুক্ত শিক্ষকসহ অনেকের সঙ্গে কথা বলি। ওই শিক্ষক ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেছেন। মামলা হয়েছে, গ্রেপ্তার করা হয়েছে।’
ওসি সুশান্ত কুমার সরকার বলেন, ‘আমি ঘটনাটি জানার পর রাতেই ইউএনও মহোদয়কে অবগত করি। কারণ, তিনি মাদ্রাসার সভাপতি। তার পরামর্শে হুজুরকে প্রথমে আটক করি। পরে মামলা হলে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হয়েছে।’
গঙ্গাচড়া আমলি আদালতের সাধারণ নিবন্ধন কর্মকর্তা (জিআরও) সোনালী বেগম জানান, শুনানি শেষে আসামিকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন বিচারক।