গবেষণায় চুরির দায়ে পদাবনতির সাজাকে অন্যায় বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক সামিয়া রহমান। তার দাবি, শিকাগো জার্নালের যে চিঠির ভিত্তিতে এই সাজা দেয়া হয়েছে, সেটি ভুয়া।
যে লেখার কারণে এই শাস্তি দেয়া হয়েছে, সেটার দায় তার নয়। অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক সৈয়দ মাহফুজুল হক মারজানের দায় এটি।
মারজান বর্তমানে বৃত্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের একটি ইউনিভার্সিটিতে উচ্চশিক্ষা নিচ্ছেন।
পদাবনতির সাজা দেয়ার এক মাস পর সোমবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সংবাদ সম্মেলনে আসেন সামিয়া, যিনি শিক্ষকতার পাশাপাশি সংবাদভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেল নিউজ টোয়েন্টিফোরে চাকরি করেন। তিনি প্রতিষ্ঠানটির কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স বিভাগের প্রধান।
গবেষণায় চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ প্রমাণ হওয়ার পর গত ২৮ জানুয়ারি সামিয়া রহমান ও মারজানকে সাজা দেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট।
সামিয়াকে সহযোগী অধ্যাপক থেকে সহকারী অধ্যাপক পদে নামিয়ে দেয়া হয়েছে।
অন্যদিকে মারজানের পদোন্নতি আটকে দেয়া হয়েছে। তিনি প্রভাষক হলেও শিক্ষা ছুটি শেষে দেশে ফেরার পর পদোন্নতি পেয়ে যেতেন। কিন্তু তাকে আরও দুই বছর প্রভাষক পদে চাকরি করতে হবে।
এই ব্যবস্থা নেয়ার পর সামিয়া অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার হয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেছেন তার বাবা। জানিয়েছেন, তার মেয়ে এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মামলা করবেন।
‘দায় মারজানের’
সামিয়া যে গবেষণার কারণে শাস্তি পেয়েছেন তার সহলেখক সৈয়দ মাহফুজুল হক মারজানকে তিনি ২০১৩ সালে আইডিয়া দিয়েছিলেন বলে দাবি করেন।
বলেন, ‘মারজান আমার ছাত্র ছিল। আমি তাকে ১২ থেকে ১৩টি আইডিয়া দিয়েছি। সে একটি আইডিয়া নিয়ে এটা লিখেছে। আমি তার এই লেখার সঙ্গে কোনোভাবে সম্পৃক্ত নই, এটা প্রমাণে উঠে এসেছে।
‘২০১৬ সালের ডিসেম্বরে সোশ্যাল সায়েন্স জার্নালে আমার আর সৈয়দ মাহফুজুল হক মারজানের নামে প্রকাশিত ‘‘A New Dimension in Colonialism and Pop Culture: A Case Study of the Cultural Imperialism" প্রবন্ধটি শিকাগো জার্নালে প্রকাশিত হয়। সেখানে মিশেল ফুঁকোর ‘‘The Subject and Power" বই থেকে কিছু অংশ চুরি করায় সেই জার্নালের অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অ্যাসিস্ট্যান্ট অ্যালেক্স মার্টিন আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করার পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট ২০১৭ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।’
লেখাটি তার নয় দাবি করে সামিয়া বলেন, ‘যে লেখাটি আমি লিখিনি, জমা দিইনি; আইডিয়া দেয়া আর গবেষণা এক বিষয় নয়। ডিন অফিসে আমার কাছ থেকে লেখার কোনো হার্ড বা সফট কপি জমা দেবার কোনো প্রমাণ তদন্ত কমিটি, ট্রাইব্যুনাল পর্যন্ত পায়নি। রিভিউয়ারের কপিও আমার কাছে আসেনি।’
যুক্তরাষ্ট্রে থাকা মারজান এর আগেও সামিয়ার এই বক্তব্যের জবাব দিয়েছেন। তিনি স্পষ্ট করেই বলেছেন, লেখাটি শেষবার গেছে সামিয়ার হাত ধরেই। এখানে বরং তার দায় নেই।
সামিয়ার দাবি, ২০১৭ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি তিনি (সামাজিকবিজ্ঞান অনুষদের) ডিন অফিসে গিয়ে লেখাটি প্রত্যাহারের আবেদন জানান। এই আবেদনের কপিও তদন্ত কমিটির কাছে জমা দেয়া হয়েছিল। সে সময়ের উপাচার্য আরেফিন সিদ্দিক বিষয়টি সিন্ডিকেটে তোলার কথাও বলেছেন বারবার।
‘শিকাগো জার্নালের চিঠি ভুয়া’
শিকাগো জার্নালের যে চিঠির কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এই তদন্ত করেছে, সেটিকেই ভুয়া দাবি করেন সামিয়া। তার দাবি, চার বছর ধরে তিনি মিডিয়া ট্রায়ালের শিকার।
যে মেইলের সূত্র ধরে তদন্ত হয়েছে, সেটিকেও ভিত্তিহীন দাবি করেন সামিয়া। বলেন, ‘যে ব্যক্তি মেইল করেছেন, তার কোনো অস্তিত্ব কেউ এখন পর্যন্ত দেখাতে পারেননি।’
কীভাবে বুঝলেন, সেই চিঠি ভুয়া?
সামিয়া বলেন, ‘অ্যালেক্স মার্টিন নামে যার মেইল ধরে আমার বিরুদ্ধে তদন্ত করা হয়েছে সেই অ্যালেক্স মার্টিন নামে কেউ নেই। শিকাগো জার্নালের এডিটর ক্রেইগ ওয়াকার আমাকে ব্যক্তিগতভাবে জানিয়েছেন যে, এই নামে কেউ শিকাগো জার্নালে কাজ করেন না।’
দাবি, প্রতিহিংসার শিকার
সামিয়ার দাবি, যে কমিটি তার বিরুদ্ধে তদন্ত করেছে, সেটি প্রতিহিংসাপরায়ণ।
তিনি বলেন, ‘দীর্ঘ চার বছর তারা তদন্ত ঝুলিয়ে রেখেছিলেন। প্রতিটি মিটিংয়ের পর যেচে পড়ে তদন্ত কমিটির দু-তিনজন সদস্য সাংবাদিকদের ডেকে আমার বিরুদ্ধে বিষোদগার করেছেন তদন্ত শেষ হবার আগেই।’
তাকে শাস্তি দেয়ার উদ্দেশ্যে এমন করা হয়েছে উল্লেখ করে সামিয়া বলেন, ‘মারজান তদন্ত কমিটির কাছে লিখিতভাবে স্বীকার করেছে যে, সে জমা দিয়েছে। রিভিউয়ারের কপিও সেই নিয়েছিল এবং এটি তার অনিচ্ছাকৃত ভুল। অথচ তদন্ত কমিটি বলছে দালিলিক প্রমাণ নাকি অস্পষ্ট কে জমা দিয়েছে! মারজান নিজে তদন্ত কমিটির কাছে জমা দেয়া ও রিভিউ করার কথা লিখিতভাবে বলার পরও কেন দালিলিক প্রমাণ অস্পষ্ট বলে তদন্ত কমিটি? এ-সংক্রান্ত প্রমাণস্বরূপ মারজানকে দেয়া আমার মেইল পর্যন্ত তদন্ত কমিটির কাছে জমা দেয়া হয়েছিল। তদন্ত কমিটি সেক্ষেত্রেও নিশ্চুপ থেকেছে।’
তিনি বেশি সাজা পেলেও মারজানকে কম সাজা দেয়া হয়েছে বলেও দাবি করেন সামিয়া।
তিনি বলেন, ‘আমি কোনো কিছুর সঙ্গে জড়িত না থেকেও আমাকে পদ অবনমন করা হয়েছে। আর মারজানের শুধু দুই বছর প্রমোশন আটকে রাখা হলো। আমাকে এই সময়ে দেশের বাইরে কোনো একাডেমিক কাজে যেতে দেয়া হয়নি। বলা হয়েছে আমার বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। আর সেখানে মারজানকে সুপারিশ করে আমেরিকাতে স্কলারশিপে পাঠানো হয়েছে।’
হুমকির কারণে মুখ বন্ধ
গবেষণাকাজে চুরির অভিযোগ আরও চার বছর আগের। সামিয়ার দাবি, তার ওপর হুমকি ছিল। এ কারণেই তিনি এত দিন এ নিয়ে কথা বলেননি।
নিজেকে ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের নোংরা রাজনীতির শিকার’ দাবি করে এ বিষয়ে মুক্তি পেতে তিনি রাষ্ট্রপতির হস্তক্ষেপও দাবি করেন।
সামিয়ার ভাষ্য, ২০১৭ সালে অভিযোগ ওঠার পর চার বছর তাকে বিভিন্নভাবে হুমকি দেয়া হয়েছে যাতে তিনি গণমাধ্যমে কথা না বলেন। সে সুযোগে ষড়যন্ত্রকারীরা দিনের পর দিন তার বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়ে গেছে।
চাকরি ছেড়ে দেয়ার হুমকি দেয়া হয়েছিল জানিয়ে সামিয়া বলেন, ২০১৯ সালে তিনি বর্তমান উপাচার্য আখতারুজ্জামানের কাছে তদন্ত কমিটির দুইজন সদস্য পরিবর্তন করতে বলেছিলেন।
সেই দুইজন কারা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সেটা আমি আজকে আপনাদের কাছে যে ডকুমেন্টস দিয়েছি, সেখানে উল্লেখ করা আছে।’
নথিতে সামিয়া জানান, ২০১৯ সালের ১৮ ডিসেম্বর উপাচার্য বরাবর চিঠিতে সমাজবিজ্ঞান অনুষদের বর্তমান ডিন সাদেকা হালিম ও উপ-উপাচার্য নাসরীন আহমদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে ধরেন তিনি।
চার বছর চুপ থাকা প্রসঙ্গে সামিয়া রহমান বলেন, ‘গত চার বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের হুমকি-ধমকির চাপে ও তদন্তাধীন বিষয় বলে মুখ বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছিলাম। তার সুযোগে ষড়যন্ত্রকারীরা দিনের পর দিন প্রপাগান্ডা চালিয়েছে আমার বিরুদ্ধে।’
আইনি সহায়তা দেবেন তুরিন আফরোজ
সংবাদ সম্মেলনে ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ উপস্থিত ছিলেন। তিনি সামিয়া রহমানের হয়ে আইনি বিষয়ে কাজ করবেন।
তিনি বলেন, তারা একটা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এই বিষটি নিয়ে উপাচার্য থেকে শুরু করে আচার্য ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে জানাবেন।
সামিয়া রহমানকে ফাঁসানো হয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, ‘একটা ভুয়া মেইলের ভিত্তি ধরে তার বিরুদ্ধে তদন্ত হয়েছে।’
সংবাদ সম্মেলনে রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহসহ সামিয়া রহমানের পরিবারের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।