নগরীর রূপাতলী হাউজিং এলাকার মেসে ১৬ ফেব্রুয়ারি রাতে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর যে হামলার ঘটনা ঘটে, তার নেতৃত্ব দেয়ার অভিযোগ উঠেছে জেলা ছাত্রলীগের প্রভাবশালী দুই নেতার বিরুদ্ধে।
তবে প্রকাশ্যে কেউ তাদের নাম উল্লেখ না করে শুধু পরিবহন শ্রমিক ও মালিক নেতাদের নাম সামনে আনছেন।
আন্দোলনকারী বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সংবাদ সম্মেলন করলেও সেখানে কেউই ওই দুই ছাত্রলীগ নেতার নাম বলেননি। এ কারণে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। অসন্তুষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ কর্মীরাও।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা ভয়ে জড়িতদের নাম না বললেও ইঙ্গিতে জানিয়ে দিচ্ছেন কারা ছিলেন সেই রাতে হামলার নেতৃত্বে।
১৬ ফেব্রুয়ারি দুপুরে নগরীর রূপাতলী বাসস্ট্যান্ডে বিআরটিসি বাস কাউন্টারের এক কর্মীর সঙ্গে কথা-কাটাকাটির জেরে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী ছুরিকাহত ও এক ছাত্রী লাঞ্ছিত হন।
এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করেন। পরে প্রশাসনের আশ্বাসে অবরোধ প্রত্যাহার করা হয়। তবে ওইদিন রাতে হামলা হয় রূপাতলী হাউজিং এলাকায় বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মেসে।
মহাসড়কে বাসে আগুন দেন বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। ছবি: নিউজবাংলা
কী কারণে শিক্ষার্থীদের মেসে হামলা হয়েছিল?
অনুসন্ধানে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, কয়েকজন উচ্ছৃঙ্খল শিক্ষার্থীর ‘খারাপ আচরণ আর বেয়াদবির’ কারণে মেসে হামলা হয় শিক্ষার্থীদের ওপর।
মঙ্গলবার দুপুরে সড়ক অবরোধের পরপর সেই রাতেই হামলার ঘটনা নিয়ে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যক্ষদর্শী পাঁচ শিক্ষার্থীর সঙ্গে এ প্রতিবেদক আলাদাভাবে কথা বলেন। তাদের সবার ভাষ্যে মিল পাওয়া গেছে।
তারা জানিয়েছেন, বিআরটিসি বাস কাউন্টারের কর্মীদের সঙ্গে ঝামেলার পর শিক্ষার্থীরা ঢাকা-কুয়াকাটা মহাসড়ক অবরোধ করলে সেখানে যান বাসমালিক, স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা।
শিক্ষার্থীদের শান্ত করতে সেখানে যারা গিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে ছিলেন মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহিদুর রহমান মনির মোল্লা, শ্রম বিষয়ক সম্পাদক ও বরিশাল পটুয়াখালী মিনিবাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক কাওছার হোসেন শিপন, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা জিয়াউদ্দিন জিয়া, বরিশাল জেলা ছাত্রলীগের সহসভাপতি সাজ্জাদ সেরনিয়াবাত, সাংগঠনিক সম্পাদক রাজীব হোসেন খান ও ২৯নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ইমরান মোল্লা।
নেতারা বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের বিষয়টি সমাধানের আশ্বাস ও দোষীদের বিচারের নিশ্চয়তা দিলেও উচ্ছৃঙ্খল কিছু শিক্ষার্থী ওই নেতাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন। তারা নেতাদের গালিগালাজ করেন এবং তাদের ওপর হামলা করতে উদ্যত হন।
‘অপমানিত’ নেতারা কিছু না বলে চলে যান। তবে উচ্ছৃঙ্খল আচরণকারী শিক্ষার্থীদের খুঁজে বের করতে রূপাতলী হাউজিং এলাকার মেসে ঢুকে হামলা চালায় একদল লোক। এদের মধ্যে দুপুরে মধ্যস্থতাকারী জেলা ছাত্রলীগের অন্তত দুজন প্রভাবশালী নেতাকেও দেখা যায়।
দুই পরিবহন শ্রমিককে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে বাস মালিক ও শ্রমিকদের সড়ক অবরোধ
অভিযোগ পাওয়া গেছে, এ হামলার পেছনে মহানগর আওয়ামী লীগের এক প্রভাবশালী নেতার ইন্ধন ছিল। কিন্তু রহস্যজনকভাবে আন্দোলনে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তারা জেনেও এদের নাম প্রকাশ করছেন না। তারা শুধু পরিবহন শ্রমিকদের কথা বলছেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা এ প্রতিবেদককে জানান, গভীর রাতে মেসে হামলার কারণ বিআরটিসি কর্মীদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব নয়। হামলার কারণ আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতাদের সাথে অশোভন আচরণ। শুধু আন্দোলন চাঙা রাখতে পরিবহন শ্রমিক ও মালিকদের নাম আনা হচ্ছে সামনে।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের এক ছাত্র বলেন, ‘আন্দোলন করতে চায় আন্দোলনকারীরা। তবে সেটা নিজেদের বাঁচিয়ে। আওয়ামী লীগ বা ছাত্রলীগ নেতাদের নাম সামনে আসছে না শুধু নিজেদের বাঁচানোর জন্য। তা না হলে আন্দোলনকারীরা নিজেরাই চাপে আলু ভর্তা হয়ে যাবে। মূল হামলাকারী কারা সেটা সবাই জানে। কেউ বলছে না মিডিয়ায়। এই ভয়ে তারা ভারসাম্য রেখে আন্দোলন করছেন।’
আন্দোলন শুরুর পরই বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের একটি ফেসবুক গ্রুপে এক ছাত্রলীগকর্মী স্ট্যাটাস দেন শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার বিষয় নিয়ে। ওই স্ট্যাটাসে বলা হয়, মহানগর আওয়ামী লীগ থেকে পুলিশকে হাত করা হয়েছে এবং মহানগর আওয়ামী লীগের এক নেতার উসকানি এবং ইন্ধনে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করা হয়েছে।
হামলার ঘটনায় গ্রেপ্তার দুই জন
এ বিষয়ে কথা হয় বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়-কেন্দ্রিক ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িত একজনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘মেসে হামলার ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগকর্মী আলীম সালেহীও গুরুতর আহত হয়েছেন। তবে তাকে ভুলবশত মারা হয়েছিল। একজনকে মারতে গিয়ে আলীম সালেহীর ওপর ভুলে হামলা হয়। যারা আলীম সালেহীকে পিটিয়েছেন, তারাই তাকে হাসপাতালে ভর্তি করেছিলেন। হামলার পুরো বিষয়টাই পরিকল্পিত ছিল।’
প্রত্যক্ষদর্শী আরও এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘মহানগর আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী এক নেতার ঘনিষ্ঠ হামলায় নেতৃত্ব দানকারী ছাত্রলীগ নেতারা। হামলার আগেই রূপাতলী হাউজিং এলাকার সব রাস্তার মুখে ব্যারিকেড দেয়া হয়। পুরোটাই পরিকল্পিত ছিল।’
এ বিষয়ে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি মাহামুদুল হাসান তমাল বলেন, ‘মেসে হামলার ঘটনা যে ভবনের সিসি ক্যামেরায় রেকর্ড করা হয়েছিল, সেটা ডিবি পরিচয়ে লোকজন এসে শুক্রবার রাতে ডিলিট করে ফেলে। ওই ক্যামেরার ফুটেজ দেখা গেলে হামলাকারীদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হতো।’
আন্দোলনকারী ছাত্রী আলিসা মুনতাজ বলেন, ‘আহত ১১ ভিকটিম আলোচনা করে যে নামগুলো সাজেস্ট করেছে, সেগুলোই মিডিয়ায় বলা হয়েছে।’
আন্দোলনকারী ছাত্র অমিত হাসান রক্তিম বলেন, ‘হামলায় বেশ কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতার জড়িত থাকার কথা নিশ্চিত করেছেন আহতরা। তবে তাদের অতীত সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড আমাদেরকে ভীত করেছে। এদিকে যাদের নাম উন্মোচিত হয়েছে, তাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এখনও গ্রেপ্তার করেনি। ফলে নিরাপত্তাহীনতার কারণেই ছাত্রলীগ নেতাদের নাম সামনে আসছে না।’
বরিশাল-পটুয়াখালী মিনিবাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক কাওছার হোসেন শিপন বলেন, ‘আমরা শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা কেন করব? আমার নিজের সন্তানও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে। দুর্বৃত্ত ও দুষ্কৃতকারীরা এই হামলা চালিয়েছে। মামলায় যে দুই শ্রমিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তারা নির্দোষ। এটা শুধু আমরা নই, শিক্ষার্থীরাও বলছে। আমরাও হামলাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।’
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সুব্রত কুমার দাস বলেন, ‘১৬ ফেব্রুয়ারি রাতে হামলার ঘটনায় মামলা হয়েছে। এতে অজ্ঞাতনামাদের আসামি করা হয়েছে। তবে শিক্ষার্থীরা এখন দাবি তুলেছেন মামলায় কয়েকটি নাম অন্তর্ভুক্ত করার জন্য। আমরা আলোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত জানাব।’
বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের উপকমিশনার (দক্ষিণ) মোকতার হোসেন বলেন, ‘হামলা কারা করেছে সেটা আমরা অধিকতর গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করছি।’