বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

মসজিদে ঘোষণা দিয়ে জাবি ছাত্রদের ওপর হামলা

  •    
  • ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ২০:১৪

শিক্ষার্থীরা জানান, চার দিন আগে ক্রিকেট খেলাকে কেন্দ্র করে কথা কাটাকাটির জের ধরে এ হামলা চালানো হয়েছে। গেরুয়া গ্রামের স্থানীয় মসজিদে ঘোষণা দিয়ে বলা হয়, ‘গ্রামে ডাকাত পড়েছে, গ্রামের মা বোনের ইজ্জত নষ্ট করেছে।’ এর কিছু সময় পরই লাঠিসোঁটা নিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করে গ্রামবাসী।

মসজিদের মাইকে গ্রামে ডাকাত পড়ার গুজব ছড়িয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালিয়েছে ক্যাম্পাস সংলগ্ন গেরুয়ার একদল স্থানীয় লোক। শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টার দিকের এ হামলার এক পর্যায়ে তাদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায় শিক্ষার্থীরা। রাত ১০টা পর্যন্ত থেমে থেমে চলে সংঘর্ষ। এরপর র‍্যাব-পুলিশ গেরুয়া গ্রামে প্রবেশ করলে থমথমে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়।

‘ক্রিকেট খেলাকে কেন্দ্র করে’ এ হামলা ও সংঘর্ষে অন্তত ৩০ জন আহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে বেশিরভাগই শিক্ষার্থী। আছেন শিক্ষক, পুলিশ কর্মকর্তা এবং গ্রামটির বাসিন্দারাও।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর বলছেন, গুজব রটিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর গ্রামবাসী হামলা চালিয়েছে। পুলিশ আসতে দেরি না করলে ঘটনা এতো গভীর হতো না।

কয়েকজন শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের হল বন্ধ থাকায় গেরুয়াসহ আশপাশের গ্রামে ঘর ভাড়া করে থাকেন অন্তত ৫০০ শিক্ষার্থী। শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টার দিকে গেরুয়া গ্রামে তাদের একটি ভাড়া বাসায় হামলা শুরু হয়। এ সময় অন্যান্য ভাড়া বাসায় থাকা শিক্ষার্থীরা নিজেদের অবরুদ্ধ করে ফেলেন।

শিক্ষার্থীরা আরও জানান, চার দিন আগে ক্রিকেট খেলাকে কেন্দ্র করে কথা কাটাকাটির জের ধরে এ হামলা চালানো হয়েছে। গেরুয়া গ্রামের স্থানীয় মসজিদে ঘোষণা দিয়ে বলা হয় ‘গ্রামে ডাকাত পড়েছে, গ্রামের মা বোনের ইজ্জত নষ্ট করেছে।’ এর কিছু সময় পরই লাঠিসোঁটা নিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করে গ্রামবাসী। তারা শিক্ষার্থীদের পাঁচটি মোটরসাইকেল ভাংচুর করেছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মোটসাইকেল ভাঙচুর করে স্থানীয়রা।

রাত ১০টার দিকে আশুলিয়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) ফজলুল হক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘পরিস্থিতি এখনও নিয়ন্ত্রণে আসেনি। গ্রামবাসী ও শিক্ষার্থী দুই পক্ষ দুই পাশে অবস্থান নিয়ে আছে। তাদের মধ্যে থেমে থেমে ইট-পাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে শতাধিক পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা রয়েছে। গেরুয়া গ্রামে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আর কোনো শিক্ষার্থী অবরুদ্ধ নেই।’

লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে গেরুয়া গ্রামবাসী। ছবি: নিউজবাংলা

তবে গেরুয়া গ্রামে বেশ কিছু শিক্ষার্থী আটকা পড়ে আছেন বলে জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা।

শামসুল আলম সীমান্ত নামে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের এক শিক্ষার্থী আমরাই জাহাঙ্গীরনগর নামের ফেসবুক গ্রুপে রাত ১১টার দিকে এক পোস্টে বলেন, ‘গেরুয়া মাদ্রাসা মসজিদের পাশের বাসা এখানে আটকা পড়ে আছি। আমার রুমে অলরেডি স্থানীয় লোকজন একবার অ্যাটাক দিয়েছে। ভাগ্যক্রমে বেঁচে গিয়েছি। বাইরে অনেক লোক। কী করব বুঝতেছি না।’

কাছাকাছি সময়ে একই গ্রুপে সানিমুল হাসান নামের এক শিক্ষার্থী এক পোস্টে বলেন, ‘গেরুয়ায় বাহির থেকে গুণ্ডা ভাড়া করে আনা হইছে। ক্যাম্পাসের স্টুডেন্টদের ওপর গুলিবর্ষণ হচ্ছে। খুবই ভয়ংকর অবস্থা। জাবি প্রশাসন কই।’

কার্তিক আরিয়ান নামের আরেক শিক্ষার্থী এক পোস্টে বলেন, ‘গেরুয়াতে এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে লোডশেডিং। ভাই সবাই সাহায্যে এগিয়ে আসুন।’

রাত সাড়ে ১২টার দিকে ফরহাদ ইবনে আওয়াল নামে এক শিক্ষার্থী তার পাস্টে বলেন, ‘প্রশাসন কতটা কেয়ারলেস হলে সংঘর্ষ শুরু হওয়ার ৬ ঘণ্টা পার হলেও পুলিশের সাহায্যে আটকেপড়া শিক্ষার্থীদের উদ্ধার করতে পারে না! জাস্ট ইমাজিন যারা গেরুয়ায় বিভিন্ন মেসে আছে তারা কতটা অসহায় ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে রাতটা পার করবে। আর যদি গেরুয়ার সন্ত্রাসীরা গভীর রাতে ওদের হামলা করে তখন সেটার কী জবাব দিবেন উনারা?’

হামলার খবর জানিয়ে সন্ধ্যা ৭টার দিকে আশরাফুল আলম নামের এক শিক্ষার্থী তার ফেসবুকে পেজে লেখেন, ‘গেরুয়ায় ছাত্র-এলাকাবাসীর প্রচণ্ড মারামারি হচ্ছে। আমরা খুব হেল্পলেস আছি। আমাদের বাঁচান।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ উল হাসান রাত ১০টার দিকে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘গ্রামবাসীর হামলার পর সন্ধ্যা ৭টার দিকে ছাত্রদের সঙ্গে সংঘর্ষ শুরু হয়। এখনও থেমে থেমে সংঘর্ষ চলছে। গ্রামবাসীর হামলায় বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। তাদের বিশ্ববিদ্যালয় মেডিক্যাল সেন্টারে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালাচ্ছে পুলিশ।’

এর আগে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে প্রক্টর বলেছিলেন, ‘আমাদের বেশ কিছু শিক্ষার্থী গেরুয়া গ্রামে আটকা পড়েছেন। তাদের উদ্ধারে চেষ্টা চলছে।’

রাত সাড়ে ১০টার দিকে এসএম রাশিদুল ইসলাম নামে এক শিক্ষার্থীকে অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে উদ্ধার করা হয়।

রাত সাড়ে ১১টায় আশুলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এসএম কামরুজ্জামান জামান বলেন, ‘পরিস্থিতি আপাতত শান্ত রয়েছে। আমরা ঘটনাস্থলে রয়েছি।’

রাত সাড়ে ১০টার দিকে উদ্ধার হওয়া রাশিদুল ভুগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের ৪৭তম আবর্তনের শিক্ষার্থী। নিউজবাংলাকে তিনি তার অবরুদ্ধ অবস্থার কথা জানিয়েছেন।

রাশিদুল বলেন, ‘বিকাল থেকেই রুমে ছিলাম। ফেসবুকে জানতে পারি ক্রিকেট খেলাকে কেন্দ্র করে এই সমস্যাটা লাগে। পরবর্তীতে আমাদের ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপের মাধ্যমে জানতে পারি, শিক্ষার্থীদের মেসে গিয়ে গিয়ে প্রত্যেকের দরজায় গিয়ে শিক্ষার্থীদের আক্রমণ করতে যাচ্ছে এবং অনেককে আক্রমণ করেছে। আমি যে মেসে থাকি সেই মেসেরও পেছন দিয়ে কিছু লোক গিয়েছিল।

‘তারা বলছিল, সবকিছু ভেঙে ফেলব, সবাইরে মেরে ফেলব। তখন নিজেকে বাইরে থেকে আরেকজনের মাধ্যমে তালাবদ্ধ করে রেখেছিলাম আমার রুমটাকে। লাইট বন্ধ করে রেখেছিলাম, যাতে কেউ বুঝতে না পারে যে আমি রুমে আছি। এমনকি সেই রুমে কেউ আছে। সেই সন্ধ্যা থেকে প্রায় ৪ ঘণ্টা অবরুদ্ধ ছিলাম। পরবর্তীতে এক সিনিয়র আমাকে সেফ জায়গায় আনেন।’

তিনি বলেন, ‘এলাকাবাসী মাইকের মাধ্যমে একটি গুজব ছড়ানোর চেষ্টা করে। তারা বলে যে, ডাকাত পড়েছে। আপনাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে বের হন এবং আমাদের মা-বোনের ইজ্জত রক্ষা করতে হবে। মসজিদকে ব্যবহার করে অথবা মসজিদের মাইককে ব্যবহার করে গুজবের যে রীতি বাংলাদেশে আছে সেই রীতি আজকে আবারও ব্যবহার করা হলো।’

সর্বশেষ পরিস্থিতি জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ উল হাসান রাত সাড়ে ১১টার দিকে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি এখন স্পটেই দাঁড়িয়ে আছি। প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিদের সঙ্গে এখনো বসার সুযোগ হয়নি। গ্রামবাসী মাইকে ঘোষণা দিয়ে শিক্ষার্থীদের ডাকাত-চাঁদাবাজ বলে আশপাশের তিন-চার গ্রামের লোকজন নিয়ে আমার শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করেছে।

‘আমার অনেক শিক্ষার্থী আহত। আমরা চেষ্টা করছি, আমাদের শিক্ষার্থীদের যাতে সাপোর্ট দিতে পারি; গ্রামবাসী যাতে আমাদের শিক্ষার্থীদের আক্রমণ করতে না পারে। সে জন্য সন্ধ্যা থেকে আমরা এখানে দাঁড়িয়ে আছি। আমরা সাধ্যমত আমাদের প্রক্টরিয়াল টিম নিয়ে কাজ করছি।’

এ সময় তিনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘পুলিশকে আমরা যথা সময়ে জানিয়েছি। আরও দ্রুত যদি পুলিশ আসত হয়ত অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাটা এত বেশি গভীর হতো না।

‘এখন পরিস্থিতি যদি আমরা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারি, আমরা যদি ম্যানেজ করতে পারি তারপর প্রশাসনের সঙ্গে বসব। তারপর প্রশাসনিকভাবে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।’

মামলার বিষয়ে কি পদক্ষেপ নিবেন জানতে চাইলে প্রক্টর বলেন, ‘এই ব্যাপারে আমি এখানে সিদ্ধান্ত দিতে পারব না। আমাদের শিক্ষার্থীদের যেহেতু ক্ষতি হয়েছে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করব তাদের বিষয়টি দেখতে।’

‘ঘটনার শুরু যেভাবে’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর হলের ৪৪তম আবর্তনের শিক্ষার্থী ইমরুল কায়েস নিউজবাংলাকে বলেন, ‘গেরুয়াতে সম্প্রতি একটা ক্রিকেট টুর্নামেন্ট শুরু হয়। সেখানে স্থানীয় ও ক্যাম্পাসের ছেলেদের নিয়ে দল গঠন করা হয়েছিল। আমি নিজেও একটি দলের প্রতিনিধিত্ব করেছি। আমার হলের আর এক জন ছেলের দলের সঙ্গে গত সোমবার পাশের এলাকা জামসিং এর খেলা ছিল।

‘খেলা চলার সময়ে জামসিং থেকে আসা ছেলেরা মারামারি শুরু করে। তখন আমাদের হলের ৪৪তম আবর্তনের এলেক্স, পিয়াস ও শহীদ রফিক জব্বার হলের ৪৫তম আবর্তনের জুবায়েরসহ খেলার আয়োজক যারা ছিল তারা ওই মারামারি মেটাতে যায়। তখন জামসিংয়ের ছেলেরা আমাদের ছেলেদের মারতে থাকে। তবে সেই মুহূর্তে কাউকে আমরা আটক করতে পারিনি।’

কায়েস আরও বলেন, ‘এর মধ্যে কয়েক দফা এই বিষয় নিয়ে তাদের সঙ্গে আলোচনা করে মিটমাট করার কথা বলা হয়। জামসিংয়ের স্থানীয় কাউন্সিলরও আমাদের আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু তারা মিটমাট করার কোনো চেষ্টা না করে উল্টো আমাদের হুমকি-ধামকি দিয়ে আসছিল।

গেরুয়া গ্রামে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে অবস্থান নিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ছবি: নিউজবাংলা

‘এরপরও আজ বিকেল ৪টার দিকে গেরুয়া বসবাসরত কয়েকজন শিক্ষার্থী আয়োজক কমিটির সদস্যদের খুঁজতে থাকে। এক পর্যায়ে আয়োজক কমিটির নজরুল নামে একজনকে পাওয়া গেলে তার কাছে মিটমাট না হওয়ার কারণ জানতে চাওয়া হয়। এ নিয়ে বাগবিতণ্ডা শুরু হয়। এরপর নজরুল গেরুয়া সংলগ্ন মাদ্রাসা মসজিদ থেকে মাইকিং করতে বলে।’

কায়েস বলেন, ‘ওখানে ওরা অনেকে ছিল। শুরুতে আমাদের ছেলেদের ধাওয়া দিয়ে এলেক্স, পিয়াস ও জুবায়েরকে মারা হয়। জুবায়েরের মাথা ফেটে গেছে। এরপর ওরা কোনোভাবে গেরুয়ায় ভাড়া বাসায় আশ্রয় নিলে সেখানে গ্রামবাসী লাঠি ও দেশীয় অস্ত্র নিয়ে হামলা করে। প্রায় এক ঘণ্টা আহত অবস্থায় থাকার পর আমাদের ছেলেদের উদ্ধার করে মেডিক্যালে পাঠানো হয়।’

এ বিভাগের আরো খবর