শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে সারা দেশে বার্ষিক পরীক্ষা না নিয়ে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নে যে ‘অ্যাসাইনমেন্ট’ নেয়া হয়েছে, তাতে শিক্ষার্থীদের তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি বলে মনে করছেন অভিভাবকেরা।
আবার দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এমন অনেক বিদ্যালয় আছে, যেখানে অ্যাসাইনমেন্ট পদ্ধতির কোনো প্রভাব পড়েনি।
নিউজবাংলার সঙ্গে কথা হয়েছে দেশের কয়েকটি বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও অভিভাবকদের। ‘অতি উত্তম’, ‘উত্তম’, ‘ভালো’, ‘অগ্রগতি প্রয়োজন’—এই চার ধরনের মন্তব্য লিখে শেষ হয়েছে অ্যাসাইনমেন্টের মূল্যায়ন।
অভিভাবকেরা জানিয়েছেন, সারা বছর শিক্ষা কার্যক্রম থেকে মোটামুটি দূরে ছিল শিক্ষার্থীরা। অ্যাসাইনমেন্টের ফলে তারা শিক্ষার সঙ্গে অল্প সময়ের জন্য সংযুক্ত হলেও সেটা কাঙ্ক্ষিত কোনো ফল দিতে পারেনি।
শিক্ষকেরা জানিয়েছেন, সারা বছর স্কুলগুলো বন্ধ ছিল। অ্যাসাইনমেন্ট পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার সাথে যুক্ত হতে পেরেছে। এই পদ্ধতির পরবর্তী ধাপে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করতে সুবিধা হবে।
রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুলের একজন শিক্ষার্থী টানা এক মাস ধরে অ্যাসাইনমেন্ট শেষ করে জমা দিয়েছে স্কুলে। স্কুল থেকে কিছু ভুল দেখিয়ে আবার তাকে সংশোধনের জন্য অ্যাসাইনমেন্ট দেয়া হয়েছে। পরবর্তীতে আবার তা স্কুল জমা নিয়েছে।
অ্যাসাইনমেন্ট করে আদৌ কোনো ফল আসেনি মন্তব্য করে ওই শিক্ষার্থীর মা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমার মনে হয় না ওদের তেমন কোনো অগ্রগতি হবে। ওরা তো সারাবছর পড়াশোনার বাইরে ছিল। হঠাৎ করে বলা হলো অ্যাসাইনমেন্ট দেয়া হবে। কিন্তু এতে তো ওদের এক বছরের ঘাটতি পূরণ হয়নি। বরং ওদের বেশি করে ক্লাসের উপর গুরুত্ব দেয়া উচিত ছিল।’
অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেয়ার পর স্কুল থেকে কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ওরা তো জমা দিয়েছে। এরপর আবার ফেরত দিয়ে নিয়ে নিয়েছে। এভাবে সারা বছরের এত বড় ঘাটতি অ্যাসাইনমেন্ট দিয়ে কাভার করা সম্ভব নয়। এখন আবার ওদের নতুন বই দিয়েছে। ২০ দিন পার হয়ে গেলেও নতুন ক্লাসের কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।’
তবে অ্যাসাইনমেন্টের ফলে ঢাকার স্কুলগুলোর শিক্ষার্থীদের সুবিধা হয়েছে বলে মনে করেন আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের সিনিয়র শিক্ষক ওহিদুজ্জামান।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, শিক্ষার্থীরা সারাবছর একরকম পড়াশোনা থেকে আলাদা ছিল। অ্যাসাইনমেন্ট অনেকটা তাদের সেই দূরত্ব কমিয়ে দিয়েছে। অ্যাসাইনমেন্টে যদিও কোনো নম্বর দেয়া হয়নি, তবে তাদের মধ্যে চর্চ্চাটা চালু হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘আমি জানি যে সারা দেশে হয়ত অ্যাসাইনমেন্ট পদ্ধতি সব জায়গায় ফলপ্রসূ হয়নি। তবে রাজধানীর স্কুলগুলোর ক্ষেত্রে অ্যাসাইনমেন্ট পদ্ধতি অনেক বেশি কার্যকর। শিক্ষার্থীদের যে ঘাটতিগুলো রয়েছে, তা আমরা জানতে পেরেছি। আর সেই অনুযায়ি আমরা পরবর্তী শ্রেণিতে ব্যবস্থা নিতে পারব।’
ভিকারুননিসা নূন স্কুলের মূল ‘প্রভাতি’ শাখার প্রধান মহসীন তালুকদার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সরকার আমাদের যেটা বলেছিল যে, অ্যাসাইনমেন্টে কোনো গ্রেডিং নম্বর থাকবে না। তাদের প্রাক-প্রস্তুতি কেমন বা কোথায় ঘাটতি আছে, সেগুলো আমরা মার্ক করে রেখেছি। আমরা খাতায় লিখে দিয়েছি তাদের কী কী ঘাটতি আছে। আমরা পরবর্তী ক্লাসে তাকে হয়ত সেই বিষয়ে একটু দেখব।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের বাচ্চারা অ্যাসাইনমেন্টগুলো খুব যত্ন সহকারে করেছে। যদিও সারা দেশে এমন অনেক স্কুল আছে, যেখানে প্রযুক্তির অভাবে তারা অ্যাসাইনমেন্ট জমা নিতে পারেনি, তবে আমরা এক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে। আমরা আগেই বলেছি বাচ্চাদের ওপর কোনো প্রেসার দেয়া যাবে না।’
তিনি উল্লেখ করেন, ‘সরকার আবার অ্যাসাইনমেন্ট দেয়ার পরিকল্পনা করছে। আমরা এই পদ্ধতি ধরে রাখতে চাই।’
তবে ঢাকার বাইরে অনেক স্কুলে জমা পড়েনি অ্যাসাইনমেন্ট। আবার মূল্যায়ন করতে গিয়ে বিপাকে পড়েছেন শিক্ষকেরা।
সিলেটের বিয়ানিবাজার উপজেলার আঙ্গুরা মোহাম্মদপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আলী হোসেন জানান, বিদ্যালয়ের প্রায় ৬শ শিক্ষার্থীর অভিভাবকদের মোবাইল ফোন নম্বার জানা না থাকায় অ্যাসাইনমেন্ট জমা নেয়ার নির্দেশনায় বিপাকে পড়েন তারা।
তিনি বলেন, ‘এলাকার মসজিদ ও মন্দিরে চিঠি পাঠানো থেকে শুরু করে মসজিদ থেকে অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেয়ার জন্য মাইকে ঘোষণা দেয়ানো হয়। শিক্ষকরাও বিভিন্ন বাড়িতে এ তথ্য জানান। তাতেও সবার কাছে তথ্য পৌঁছেনি। আবার অনেকে অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিতে আগ্রহও দেখায়নি। যেহেতু অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেয়ার সাথে ফলের কোনো সম্পর্ক ছিলো না, তাই বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই এটি জমা দেয়নি।’
সিলেট সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কবির উদ্দিন খান জানান, অনেক বিদ্যালয়ে ৫০ শতাংশের মতো অ্যাসাইনমেন্ট জমা পড়েছে।
অ্যাসাইনমেন্ট মূল্যায়ন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সরকারি নির্দেশনার আলোকেই আমরা মূল্যায়ন করেছি। শিক্ষার্থীদের লেখার উপর ভিত্তি করে আমরা “অতি উত্তম”, “উত্তম”, “ভালো”, “অগ্রগতি প্রয়োজন” – এরকম চারটি ক্যাটাগরিতে মূল্যায়ন করেছি।’
বরিশালের হিজলার বিসিডি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ আলী নিউজবাংলাকে বলেন, এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীর মেধা-মনন বোঝা যায়নি। কারণ অনলাইনে উত্তরপত্র ছড়িয়ে পড়ায় দুর্বল শিক্ষার্থীদের লেখাও কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভালো হয়েছে। নেট থেকে বের করে কপি করেছে বেশিরভাগ শিক্ষার্থী। এ কারণে যে অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেয়া হয়েছে, সেটা দিয়ে মেধা মূল্যায়নটা কষ্টকর।
তিনি বলেন, ‘আমরা শিক্ষার্থীদের কনভিন্স করেছি যে, অ্যাসাইনমেন্ট জমা না দিলে শ্রেণিতে উত্তরণ করা হবে না। এতে আশানুরূপ অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিয়েছে শিক্ষার্থীরা।’
তবে অ্যাসাইনমেন্ট পদ্ধতি নতুন বছরে শিক্ষার্থী ধরে রাখতে সহায়ক হয়েছে বলে মনে করেন রাজশাহীর বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকেরা।
বেশিরভাগ প্রধান শিক্ষক জানিয়েছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় যোগাযোগ ছিল না শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের। স্কুলের সাথেও প্রায় বিচ্ছিন্ন ছিল শিক্ষার্থীরা। অ্যাসাইনমেন্ট আসার পর ধীরে ধীরে যোগাযোগ বেড়েছে।
রাজশাহী কলিজিয়েট স্কুলের প্রধান শিক্ষক নুরজাহান বেগম বলেন, ‘আমাদের স্কুলের প্রায় ৯৯ শতাংশ শিক্ষার্থী অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিয়েছে। এগুলো আমরা যথাসময়ে মূল্যায়ন করে সেগুলো আবার তাদের কাছে ফেরত দিয়েছি। তাদের দেখা শেষে এগুলো আবারও আমরা জমা নিয়ে রেখেছি। নির্দেশনা মোতাবেকই আমরা মূল্যায়ন করেছি।’
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালক সৈয়দ গোলাম ফারুক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের কীভাবে মূল্যায়ন করা হবে, আমরা তার একটা নির্দেশনা আগে থেকে দিয়ে দিয়েছিলাম।’
এই মূল্যায়নের ফলে কী সুবিধা পাবে শিক্ষার্থীরা, তার উত্তরে তিনি বলেন, ‘এটির মাধ্যমে তাদের শিক্ষণ ঘাটতি পূরণ হবে। তাদের কোথায় কোথায় ঘাটতি আছে, সেটি ধরা পড়বে। পরবর্তী শ্রেণিতে এই ঘাটতি পুষিয়ে নেয়ার চেষ্টা করা হবে।’
অনেক স্কুলে অ্যাসাইনমেন্ট জমা পড়েনি এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমরা সেসব স্কুলকে আরও সময় দিব। শিক্ষকরা যাতে সময় নিয়ে লেখানোর ব্যবস্থা করে সেই সময় দেয়া হবে।’
এটার নিদির্ষ্ট কোনো সময় নতুন করে বেঁধে দেয়া হবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘না। তবে এটা শেষ করতে হবে।’
প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন বরিশালের তন্ময় দাস, সিলেটের দেবাশিষ দেবু, রাজশাহীর আহসান হাবিব অপু।