নয় মাসেরও বেশি সময় ধরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় নানা রকম ক্ষতিকর প্রভাব দেখা যাচ্ছে শিক্ষার্থীদের মধ্যে।
যারা শিক্ষা জীবন শেষ করে চাকরির প্রস্তুতি নিতে যাচ্ছিলেন, জীবন থমকে যাওয়ায় উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা তৈরি হয়েছে তাদের মধ্যে।
শিশু-কিশোররা স্কুলে বন্ধুদের সঙ্গে মেলামেশা করতে না পারায় মনের কথা খুলে বলতে না পারায় হয়ে যাচ্ছে বিষন্ন; মেজাজ হচ্ছে খিটখিটে।
করোনা পরিস্থিতি অন্য সব সমস্যার পাশাপাশি শিক্ষা জীবনকে তছনছ করে দিয়েছে। ক্লাস বন্ধ থাকায় অনলাইনে চলছে লেখাপড়া। কিন্তু এটা ভালো লাগছে না শিক্ষার্থীদের কাছে।
করোনা ভাইরাসের কারণে কলেজ বন্ধ। রাজধানী একটি সরকারি কলেজের স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আরিফা (ছদ্মনাম) ঢাকা ছেড়ে গ্রামে। শুরুতে পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতে ভালোই লাগত। কিন্তু কিছুদিন পর লাগে একঘেয়েমি।
আরিফার আচরণ পাল্টাতে থাকে। শুরুতে দিনের বেশিরভাগ সময় একা থাকতেন। কারও সঙ্গে কথা বলতেন না। পরে শুরু হয় মধ্যরাতে ঘুমের মধ্যেই উচ্চস্বরে চিৎকার। এক পর্যায়ে পরিবারের কাউকেই সহ্য করতে পারতেন না।
এমন অস্বাভাবিক আচরণ কেন, চিন্তিত হয়ে পড়েন স্বজনরা। গ্রামে ভালো ডাক্তার নেই। যার কাছে তাকে নেয়া হয়, তিনি কোনো ব্যাখ্যাই দিতে পারলেন না।
পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে থাকে। পরে পরামর্শ করে আরিফাকে গত আগস্টে রাজধানীর জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়। এখানে এসে অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলেও পুরোপুরি সুস্থ হননি আরিফা।
করোনাকালে জাতীয় মানসিক রোগ ইনস্টিটিউটে রোগীর চাপ বেড়েছে
প্রাপ্তবয়স্ক এই তরুণী যখন নিজেকে সামলাতে পারেননি, তখন ক্ষুদে শিক্ষার্থীরাও যে বিপাকে, সেটা সহজেই বোঝা যায়।
রাজধানীর একটি বেসরকারি স্কুলের অষ্ঠম শ্রেণি ছাত্রী শ্রেয়সী বোসকে অনলাইনে চার ঘণ্টা ক্লাস করতে হয়। তার ভালো লাগে না এভাবে পড়তে। মাঝে মাঝে মাকে বলে গ্রামের বাড়ি যাবে, যেখানে অনলাইনে ক্লাস করা লাগবে না। সবার সঙ্গে কথা বলতে পারবে, মিশতে পারবে, খেলতে পারবে।
রাজধানীর আইডিয়াল স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী মোহাম্মদ মোমিনের মা বৃষ্টি আক্তার বলেন, ‘ছেলে অনেক সময় পড়ানো বিষয়ও ভুলে যায়। বার বার পড়ানোর পরেও মনে রাখতে পারেন না। এটা নিয়ে অনেক সমস্যায় রয়েছি।’
করোনা সংক্রমণ ও সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতে গত ১৮ মার্চ দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। পাঁচ দফা বাড়িয়ে ছুটি করা হয়েছে আগামী ১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত। ফলে প্রায় চার কোটি সাড়ে ৪৪ লাখ শিক্ষার্থীর বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটানো, স্কুলে পড়াশোনা সব বন্ধ।
প্রথম কিছুদিন অ্যাকাডেমিক চাপের বাইরে বাড়িতে আত্মীয় পরিজনের কাছাকাছি থাকায় ভালো লাগলেও এখন ভালো সময় কাটছে না।
ক্যাম্পাস কবে খুলবে, লেখাপড়া শেষ কবে, পড়াশোনা শেষ হলে চাকরির কী হবে, বিকল্প আয়ের কী সংস্থান হবে, এসব চিন্তায় নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে বহু জন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান সালাউদ্দিন কাউসার বিপ্লব নিউজবাংলাকে জানান, মহামারিকালে তারা মানসিক রোগী পাচ্ছেন আগের তুলনায় ৫০ শতাংশ বেশি। অন্যান্য রোগও বেড়েছে। করোনা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে এ সময়ে টিভি, স্মার্টফোন বা ডিজিটাল ডিভাইসে আসক্ত হয়ে পয়েছে। যে কারণে শারীরিক ও মানসিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।
এই বিশেষজ্ঞ বলেন, এই পরিস্থিতিতে মেদস্থুলতা বেড়ে হৃদরোগ, ডায়াবেটিস ইত্যাদি রোগের ঝুঁকি বাড়ছে। বেড়েছে হতাশা, উদ্বেগ, আত্মহত্যা ও বখে যাওয়ার প্রবণতা। বাল্যবিয়ে, শিশুশ্রমে, শিশু নির্যাতন ও শিশু-কিশোরদের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অর্থনৈতিক যত সমস্যাই থাকুক না কেন, আতঙ্কগ্রস্ত না হওয়া যাবে না। আতঙ্কিত হলেই মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে আসে।
করোনাকালে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে রোগীর চাপ বেড়েছে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে এখানকার বহির্বিভাগে সেবা নিতে আসেন চার হাজার ৭৪৭ জন রোগী। অক্টোবরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ছয় হাজার ৩৭০ এ। একই অবস্থা পাবনা মানসিক হাসপাতালে।
মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের এক হিসাব বলছে, ২০১৮ সালে দেশে ১৮.৫ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক এবং প্রায় ১৩ শতাংশ শিশু-কিশোরদের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা রয়েছে। তবে এদের মধ্যে ৯২ শতাংশ মানুষই চিকিৎসার বাইরে থাকে।
ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘প্রায় ৯ মাস শিক্ষা প্রতিষ্ঠা বন্ধ যে কারণে শিক্ষার্থীদের বিসন্নতা ও মানসিক চাপ তৈরি হচ্ছে। এসব রোগীকে আগে শুধু পরামর্শ দিলেই হতো এখন ভর্তি রেখে চিকিৎসা দিতে হচ্ছে।’
এই চিকিৎসক জানান, প্রতিদিন তিনশর মতো রোগী আসেন। এদের বেশিরভাগ বিষন্নতা ও মানসিক চাপ, উদ্বেগ্ন, খিটখিটে মেজাজ, অস্বাভাবিক আচরণের সমস্যা নিয়ে আসেন।
যারা শিক্ষার্থী তাদের মধ্যে শিক্ষা জীবন নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে বলে জানান এই মনরোগ বিশেষজ্ঞ।
শিশুদেরকে খেলাধুলায় ব্যস্ত থাকার পরামর্শ দিয়েছেন মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞরা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশন অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মেহজাবীন হক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিশুরা আটকা পড়ে গেছে। প্রতিটা শিক্ষার্থীদের আলাদা আলাদা পরিকল্পনা ছিল। অনেক ইচ্ছা ছিল ভালো চাকরি, বা বিদেশে পড়তে যাওয়া, অনেকেই পরিকল্পনা ছিল বিয়ে করবে। এসব পকিল্পনা বাধাগ্রস্ত হল করোনা কারণে তারা বিষন্নতাবোধ করবে এটা খুবই স্বাভাবিক।
তিনি বলেন, ‘যারা টিউশন করে চলত, তাদের আয়ের পথ বন্ধ হয়ে আসছে। ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষতি হয়েছে। শুধু শিক্ষার্থী নয় পরিবার প্রতিটা সদস্য কিছু না কিছু মানসিক সমস্যার মধ্যে রয়েছে। এটা কাটিয়ে উঠা কিন্তু সহজ নয়।’
সমাধান কী?- জানতে চাইলে এই মনরোগ বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘এসব সমস্যা থেকে বের হয় আসতে পরিবারকে সচেতন হতে হবে। শিক্ষার্থীদের বলতে হবে এই মহামারি সারাজীবন থাকবে না। কোনো না কোনো দিন এটি বিদায় নিবে। পৃথিবীতে এমন মহামারি অনেক বার এসেছে। একটু ধৈর্য ধারণ করতে হবে।’
এই সময়ে নিজেকে কাজে ব্যস্ত রাখার পরামর্শ দেন এই চিকিৎসক। বলেন, পাখি বা বিড়াল পালা যেতে পারে।
‘প্রকৃতির সঙ্গে সময় কাটান, তাহলে আমাদের হতাশ ও মানসিক সমস্যা অনেক অংশ কমে যায়। এছাড় নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের ব্যায়াম করা যায়, খেলাধূলা করা যায়। এসব কর্মকাণ্ড আমাদের সুস্থ থাকতে সহযোগিতা করবে।’