বার্ষিক পরীক্ষা না নিয়ে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নে যে অ্যাসাইনমেন্ট পদ্ধতি চালু করা করেছে, তাতে টাকা দিতে হবে এমন কোনো কথা বলা ছিল না। তবে স্কুলগুলো একে নিয়েছে অর্থ আদায়ের কৌশল হিসেবে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর বেপরোয়া আচরণের পর সরকারের পক্ষ থেকে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বলা হয়েছে, এ ধরনের অর্থ আদায় করা যাবে না। তারপরও দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে টাকা আদায় করার অভিযোগ আসছেই।
সর্বনিম্ন দেড় হাজার থেকে শুরু করে সাড়ে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত আদায়ের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে।
এ জন্য অজুহাতের শেষ নেই। ফটোকপি ফি, দুই পৃষ্ঠার কাগজের দাম, বিদ্যুৎ বিল, এমনকি মসজিদের নামে আদায় করা হচ্ছে টাকা। তবে কোনো রসিদ দেয়া হচ্ছে না।
হুমকি দেয়া হচ্ছে, টাকা না দিলে পরের ক্লাসে প্রমোশন দেয়া হবে না।
টাকা আদায় করা যাবে না, এমন নির্দেশনা এলেও যারা টাকা আদায় করছেন, তাদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর মাউশির মহাপরিচালক সৈয়দ গোলাম ফারুক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘যদি কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্দেশনা অমান্য করে অর্থ আদায় করে এবং তার প্রমাণ মেলে, তাহলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
এ বিষয়ে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দেয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এই চিঠিতে যারা টাকা নিয়েছে, তাদের টাকা ফেরত দিতে বলা হয়েছে।’
স্কুল-কলেজে সরকার নির্ধারিত ফির অতিরিক্ত আদায় কোনো নতুন কাহিনি নয়। রেজিস্ট্রেশন ফি, পুনঃভর্তি ফিসহ নানা নামে অতিরিক্ত অর্থ আদায় ঠেকাতে কখনও কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া যায়নি।
মানিকগঞ্জের যাত্রাপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রতি বিষয়ে অ্যাসাইনমেন্ট বাবদ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ১০০ টাকা নিচ্ছে। এর বিনিময়ে তারা একটি খাতা ও অ্যাসাইনমেন্টের একটি ফটোকপি দিচ্ছে বলে সপ্তম শ্রেণির ছাত্র তরিকুল ইসলাম জানিয়েছেন।
প্রতিষ্ঠানটির সহকারী প্রধান শিক্ষক দিলীপ কুমার মণ্ডল টাকা নেয়ার বিষয়টি স্বীকারও করেছেন। যুক্তি হিসেবে বলেন, ‘খাতা ও ফটোকপি করতে যে টাকা খরচ করা হচ্ছে, সেই নেয়া হচ্ছে; অ্যাসাইনমেন্ট বাবদ নয়।’
ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার আঠারবাড়ি এমসি উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায় করা হচ্ছে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা। টাকা না দিলে শিক্ষার্থীদের একই ক্লাসে থাকতে হবে বলে হুমকি দেয়ার অভিযোগ উঠেছে শিক্ষক মো. আনোয়ারের বিরুদ্ধে।
এক শিক্ষার্থী জানায়, তিন পাতার প্রশ্ন (অ্যাসাইনমেন্ট), দুটি কলম ও এক পাতার সাজেশন দিয়ে ৩৪০ টাকা চেয়েছে। টাকার অভাবে সেই অ্যাসাইনমেন্ট সে নিতে পারেনি।
এ বিষয়ে শিক্ষক মো. আনোয়ারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে চাননি।
বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার রুপধন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রতিটি বিষয়ের অ্যাসাইনমেন্টের জন্য দুই পাতার সাদা কাগজ দেয়া হয়েছে। আর এ জন্য নেয়া হচ্ছে ২০০ টাকা করে।
অষ্টম ও নবম শ্রেণির দুই শিক্ষার্থী জানায়, ছয়টি বিষয়ে অ্যাসাইনমেন্ট ফি বাবদ তাদের কাছ থেকে যথাক্রমে ৪২০ ও ৪৮০ টাকা করে নেয়া হয়েছে।
অষ্টম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী জানায়, তাদের শ্রেণিতে ১৪টি বিষয় রয়েছে। তবে স্কুল কর্তৃপক্ষ চারটি বিষয়ে বাড়তি অ্যাসাইনমেন্ট নেবে। ওই চারটিসহ তাদের মোট ১৮টি অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিতে হবে বলে জানানো হয়েছে।
রুপধন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কবির হোসেন বলেন, যে টাকা নেয়া হচ্ছে, এটা অ্যাসাইনমেন্টের বাবদ নয়, মূলত বকেয়া বেতন নেয়া হচ্ছে। তবে চলমান পরিস্থিতি বিবেচনায় নির্ধারিত বেতনের ৭০ ভাগ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায় করা হচ্ছে।
বরগুনা সদরের নলটোনার গর্জনবুনিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়, পরীরখাল মাধ্যমিক বিদ্যালয়সহ জেলার বেশিরভাগ স্কুলেই এই চিত্র।
বরগুনা জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘অ্যাসাইনমেন্টের সময় শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে সব প্রকার টাকা আদায় নিষেধ করা হয়েছে। বিষয়টি খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হবে।’
বরিশাল সদর উপজেলাধীন কড়াপুর এলাকার পপুলার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক জানান, তাকে স্কুলে ডেকে নিয়ে দুই হাজার ৮০০ টাকা দিতে বলা হয়েছে।
নগরীর জগদিশ স্বারস্বত মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক বলেন, তার কাছ থেকে চাওয়া হয়েছে দুই হাজার ৯০০ টাকা।
নগরীর দলিলউদ্দিন বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির এক ছাত্রীর বাবা জানান, তাকে তিন হাজার ১০০ টাকা জমা দিতে বলা হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘আমি সামান্য চার দোহানদার। করোনার লইগ্যা এমনি সংসার চালাইতে পারি না। এহন এই টাহা ক্যামনে দিমু।’
তবে পপুলার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ফরিদ উদ্দিন, জগদীশ স্বারস্বত বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শাহ আলম দাবি করেন, তারা কোনো টাকা দিচ্ছেন না।
বরিশাল শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. ইউনুস বলেন, ‘অভিযোগ পাওয়ার পরপরই বিদ্যালয়গুলোকে হুঁশিয়ারি দিয়ে নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। এভাবে টাকা তোলার কোনো অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের স্বীকৃতি স্থগিত করে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
ঝালকাঠি জেলার রাজাপুর সরকারি পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সাত শতাধিক শিক্ষার্থীর কাছ থেকে পাঁচ লাখেরও বেশি টাকা আদায়ের তথ্য পাওয়া গেছে।
নলছিটি উপজেলায় কয়েকটি স্কুলে অ্যাসাইনমেন্ট ছাড়াও মসজিদের চাঁদা, বিদ্যুৎ বিল, বেতন, সেশন ফি, পরীক্ষার ফি নেয়া হচ্ছে।
একটি বিদ্যালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নবম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী জানায়, গত সপ্তাহে তার কাছ থেকে ৭৩৫ টাকা চেয়েছে স্কুল। গত সোমবার টাকা পরিশোধ করা হয়েছে।
এই শিক্ষার্থীর অভিভাবক জানান, অ্যাসাইনমেন্টের জন্য টাকা লাগে না, এ কথা জেনে তিনি স্কুলে গিয়ে টাকা আদায়ের কারণ জানতে চান। তখন তাকে বলা হয়, বেতনসহ বিদ্যালয়ের বিভিন্ন খরচের জন্য নেওয়া হচ্ছে।
বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে যে অ্যাসাইনমেন্ট দেয়া হয়েছিল, টাকা আদায়ের জন্য তা পরিবর্তন করে নিজেদের খেয়াল খুশিমতো অ্যাসাইনমেন্ট তৈরি করেছেন শিক্ষকরা, যাতে করোনা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় সংযুক্ত করা হয়েছে।
জানতে চাইলে রাজাপুর সরকারি পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক গোলাম মোস্তফা গাজী নিউজবাংলা বলেন, ‘যারা অভিযোগ করেছেন, তারা অপপ্রচার চালাচ্ছেন। সরকারি নির্দেশনা মেনেই আমরা কাজ করছি।’
নলছিটি উপজেলার প্রতাপ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, সুবিদপুর বিজি ইউনিয়ন একাডেমি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, খাগড়াখানা মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয় ছাড়াও বেশ কয়েকটি বিদ্যালয়ে অ্যাসাইনমেন্ট ফি নিলেও রশিদ দিচ্ছে বেতন আদায়ের।
রশিদে ১৯টি বিষয়ের বিবরণ থাকলেও বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নির্দিষ্ট কোনো বিষয় ছাড়াই ৭০০ থেকে ৮৮০ টাকা পর্যন্ত নিচ্ছে।
উপজেলার সুবিদপুর বিজি ইউনিয়ন একাডেমি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী লিয়া আক্তারের মা নুসরাত জাহান বলেন, ‘বাড়িতে বসে পরীক্ষা হলে খাতাও আমাদের কিনতে হবে। তাহলে কেন টাকা দেবো? শুধু আমার মেয়ের কাছ থেকেই নয়; সব শিক্ষার্থীদের কাছ থেকেই টাকা নেয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে আমি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছি।’
শিক্ষার্থী অভিভাবক নাসির উদ্দিন খান বলেন, ‘আমার মেয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। আমার কাছ থেকে ৬০০ টাকা নিয়েছে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। জানতে চাইলে তারা একটি রসিদ ধরিয়ে দেন।’
সুবিদপুর বিজি ইউনিয়ন একাডেমি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আলী আহম্মেদ বলেন, ‘আমরা অ্যাসাইনমেন্ট ফি নিচ্ছি না। বিদ্যালয়ের বেতনসহ অন্যান্য খরচ বাবদ টাকা নেয়া হচ্ছে; এটার রশিদও দিয়ে দিচ্ছি।’
কিন্তু কোনো প্রকার টাকা নেয়া যাবে বলে সরকারের নির্দেশ রয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছে এ ধরনের কোনো নির্দেশনা নেই।’
ঝালকাঠির শিক্ষা কর্মকর্তা সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘আমাদের কাছে কেউ লিখিতভাবে জানালে আমরা ব্যবস্থা নেব।’
প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে ঢাকার তবিবুর রহমান, বরিশালের তন্ময় দাস, ঝালকাঠির হাসনাইন তালুকদার দিবস, বরগুনার রুদ্র রুহান, ময়মনসিংহের জাহাঙ্গীর আকন্দ, মানিকগঞ্জের আজিজুল হাকিমের তথ্যে।