মাতৃহারা মালবিকা নাওয়ার দীঘল। বয়স সাত। পড়ে একটি কিন্ডারগার্টেনে। থাকে নানা-নানির কাছে। প্রবীণ এই দুটি মানুষ মোবাইল ফোনে কীভাবে ইন্টারনেট চালাতে হয়, সেটি জানেন না। তাই দীঘলের ক্লাস করা হয় না।
শিশুটির সহপাঠীদের স্কুল থেকে কী নির্দেশনা দেয়া হয়, জানা হয় না দীঘলের নানা-নানির। মাঝেমধ্যে স্কুলে গিয়ে নাতনির জন্য পড়া নিয়ে আসেন নানি।
আর্থিকভাবে স্বচ্ছল হলেও এই পরিবারটি প্রযুক্তি জ্ঞানের অভাবে শিশুটির স্কুলের অনলাইনের পড়ালেখা নিশ্চিত করতে পারছে না।
এই পরিবারটির অর্থের অভাব নেই, আছে প্রযুক্তি ব্যবহারে সীমাবদ্ধতা। তবে অর্থের অভাবে অন্তত দুই কোটি শিক্ষার্থী অনলাইনের ক্লাসে যোগ দিতে পারছে না।
করোনাকালে মানুষের আয় কমে যাওয়ার পর ইন্টারনেটের জন্য খরচ করে পড়াশোনা করানো বহু পরিবারের পক্ষেই সম্ভব হচ্ছে না।
দ্বিতীয় যে বিকল্প করা হয়েছে, সেই টেলিভিশন দেখে পড়াশোনার সুযোগও সীমিত। কারণ, যাদের বাসায় টিভি নেই তারা এই সুবিধার বাইরে।
আবার নিম্ন আয়ের পরিবারের শিশুরা টিভি দেখে পড়বে- এটি আশা করেন না ঢাকার একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক সারোয়ার জাহান।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ঢাকায় সরকারি প্রাথমিক স্কুলগুলোতে কারা পড়ে আপনারা জানেন। আমাদেরকে বলা হয়েছে ফোনে খোঁজ খবর রাখতে। কিন্তু এত ছেলেমেয়েকে কি ফোনে পাওয়া যায়? তাদের পরিবার তো পড়ালেখার বিষয়ে সেভাবে সচেতনও না। আমরা অনেক কল করলে অনেক সময় ধরেও না।’
‘তবে স্কুলে যেদিন শিশুদের বিস্কুট দেয়া হয়, সেদিন আবার ঠিকই দল বেঁধে চলে আসে। সেদিন আমরা বলে দেই। কিন্তু এই অ্যাসাইনমেন্ট জমা পড়ে না বললেই চলে’-বলেন এই শিক্ষক।
যশোর শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান আমিরুল আলম খান বলেন, ‘নিঃসন্দেহে করোনাকাল দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় বড় বৈষম্য ও বিভাজন সৃষ্টি করছে। এর ফলে করোনা-পরবর্তী সময়ে অনেক শিক্ষার্থী তো ঝরে পড়বেই, আর টিকে থাকা শিক্ষার্থীদের মধ্যেও মোটাদাগে দুইটি শ্রেণি গড়ে উঠবে।
‘এক আর্থিক শ্রেণির শিক্ষার্থীদের তুলনায় অন্য শ্রেণির শিক্ষার্থীরা অনেকটাই পিছিয়ে পড়বে। ফলে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার ভবিষ্যতে আমি বড় দুর্যোগ দেখতে পারছি। এই অবস্থা চলমান থাকলে ২০৩০ সালে শিক্ষা খাতে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) মানসম্মত শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ অধরা রয়ে যাবে।’
সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রাথমিক স্কুল আছে ৬৪ হাজার। সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে মাধ্যমিক স্কুল আছে আরও ১৭ হাজারের মতো।
কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় আছে প্রায় আড়াই হাজার। সব মিলিয়ে শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় পাঁচ কোটি।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, শিক্ষার্থীদের ৮৬ শতাংশ ও অভিভাবকদের ৭৪ শতাংশ সংসদ টিভির বিষয়ে জানেন না।
জরিপে অংশ নেয়া ৪৩ শতাংশ শিক্ষার্থী সংসদ টেলিভিশনের ক্লাস দেখেছে। বাকি ৫৭ শতাংশ এই টিভি বা অনলাইন ক্লাসের বাইরে থেকে গেছে।
ঝিনাইদহ জেলা উচ্চ বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির আলমগীর হোসেন। স্কুল বন্ধ বলে বসতে হয় বাবার মুদি দোকানে। জানায়, ২৯ মার্চ ক্লাস চালু হওয়ার পর দু-তিনটি ক্লাসে অংশ নিতে পেরেছে।
আলমগীরের বাবা আসিফ আলী বলেন, গ্রামে অনেক সময় বিদ্যুৎ থাকে না। এমন অনেক দিন হয়েছে, ক্লাসের মাঝামাঝি সময়ে হঠাৎ করে বিদ্যুৎ চলে গেছে। তাছাড়া স্কুলের চাপ ও পরীক্ষা না থাকায় ছেলেরও আগ্রহ নেই।
বিপরীত চিত্র রাজধানীর আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী সাদিয়া আক্তারের পরিবারে। তার বাবা-মা সম্পদশালী। অভিভাবকও সচেতন। তিনজন হোম শিক্ষক দিয়ে চলছে পড়াশোন। অনলাইনে ক্লাস চলছে নিয়মিত। পরীক্ষাও নিচ্ছে তার স্কুল।
গ্রামীণ মানুষের ডিজিটাল শিক্ষা ও বৈষম্যের বিষয়টি উঠে এসেছে ব্র্যাক ইনস্টিটিটিউট অব গভারনেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) দুটি জরিপেও। এতে দেখা গেছে, গ্রামের ৪১ শতাংশ মানুষ স্মার্টফোন ব্যবহার করে। ৯ শতাংশের কম্পিউটার চালানোর দক্ষতা আছে। ইন্টারনেট সংযোগ আছে ৩৭ শতাংশের।
ইন্টারনেট সুবিধা ভালো ঢাকা, চট্টগ্রাম ও খুলনায়। সব থেকে খারাপ অবস্থায় রংপুর, ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগ।
খুলনার রূপসা বহুমুখী বিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমের ২৫ ভাগ পরিচালিত হচ্ছে অনলাইনের মাধ্যমে। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান শিক্ষক জানান, ফেসবুক লাইভ, মেসেঞ্জার ও ইউটিউবের মাধ্যমে তারা ক্লাস নিচ্ছেন। প্রত্যেক শিক্ষককে মাসে কমপক্ষে চারটি ক্লাস অনলাইনে নিতে হয়।
স্কুলের শিক্ষক অমিয় কান্তি পাল বলেন, বিদ্যালয়ের ৫০ ভাগ শিক্ষার্থীর মোবাইল না থাকায় তাদের নিকটবর্তী শিক্ষার্থীদের সহায়তা নিতে বলা হয়েছে।
বরিশাল জেলার প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষার্থীদের আর্থিক সচ্ছলতার অভাবে স্মার্টফোন ও ইন্টারনেট সংযোগ না থাকায় তারা অনলাইন ক্লাসে অংশ নিতে পারছে না।
একই অবস্থা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইনে ক্লাস নেয়া শুরু করলেও শিক্ষার্থীরা এর বিরোধিতা করে।
কারণ হিসেবে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর ডিজিটাল ডিভাইস ও ইন্টারনেট সংযোগ না থাকার কথা উঠে এসেছে। ফলে অনলাইন ক্লাস চললেও শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ৩০ শতাংশ।
মৌলভীবাজারে এক হাজার ৫০টি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। শিক্ষা কার্যক্রম চলছে সংসদ টিভি ও মোবাইলের মাধ্যমে। তবে বড়লেখা ও জুড়িসহ বেশ কিছু উপজেলায় ইন্টারনেট সংযোগের সুবিধা নেই। অভাব আছে স্মার্টফোনেরও। ফলে এসব শিক্ষার্থী ক্লাসে অংশ নিতে পারছে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ (আইইআর) বিভাগের প্রভাষক ইফফাত নায়মি নিউজবাংলাকে বলেন, ’ইন্টারনেটের সহজপ্রাপ্যতা আর বিঘ্ন একটা বড় সমস্যা বর্তমান শিক্ষাক্ষেত্রে।’
’আমার কেউই এমন পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। আমার মতে আমাদের সামনে একটা চ্যালেঞ্জ এসেছে এবং আমরা সবাই মিলে সেটাকে মোকাবিলা করার চেষ্টা করছি।’
এই শিক্ষক বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে শিক্ষকরা বড় ভূমিকা পালন করতে পারেন। কারণ শহরের তুলনায় গ্রামের শিক্ষক তার ছাত্রছাত্রীদের ভালো চেনেন। তাই ইন্টারনেটের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে ফোনের সাহায্যে বা অন্য কোনো মাধ্যমে শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারেন।’
তবে ঢাকার একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সারোয়ার জাহান বলেন, ‘শিক্ষকদের বাড়তি কোনো অর্থ বরাদ্দ নেই। কত জনকে ফোন দেয়া যায়?’
মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের ওপর করা জরিপের ভিত্তিতে তৈরি বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনা মহামারিতে স্কুল বন্ধ থাকায় তিন কোটি ৬০ লাখ শিক্ষার্থীর পড়াশোনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ ফসিউল্লাহ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘গ্রামাঞ্চলে টিভিতে কেবল সংযোগ নেই। এ কারণে অনেকেই হয়তো ক্লাসের বাইরে থাকছে। এরই মধ্যে জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের বলা হয়েছে, কেবল নেটওয়ার্কে সংসদ টিভি দেখতে যাতে কারো সমস্যা না হয়। আমাদের লক্ষ্য সব শিক্ষার্থী যাতে ঘরে বসে ক্লাস করতে পারে।’
শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি জানিয়েছেন, বার্ষিক পরীক্ষা না নিয়ে অ্যাসাইনমেন্টের ভিত্তিতে তারা শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করবেন। এই অ্যাসাইনমেন্টের সঙ্গে পাস ফেলের সম্পর্ক নেই। কোথায় দুর্বলতা সেটি জানাই উদ্দেশ্য।
এই মূল্যায়নের ভিত্তিতে আগামী শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যক্রম-শিক্ষণ কৌশল নির্ধারণ হবে। এর ফলে যে ক্ষতিটা হয়েছে, সেটি কাটিয়ে ওঠা যাবে বলে আশাবাদী তিনি।প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকও বলছেন, ‘যারা বিভিন্ন কারণে ক্লাস করতে পারেনি, তাদের কথা মাথায় রেখে উত্তরণ পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।’
‘এরই মধ্যে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। বিনামূল্য ইন্টারনেট ও স্মার্টফোন দেয়ার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। অনেক গ্রামের শিক্ষার্থীদের ফ্রি ইন্টারনেট সুবিধার আওতায় আনার পরিকল্পনাও আছে।’
করোনাভাইরাসের কারণে গত মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ আছে। ঘোষণা এসেছে, চলতি বছর আর চালু হবে না।