বাংলাদেশের হালাল শিল্পকে বৈশ্বিক বাজারে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার জন্য এর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা এবং বিদ্যমান সুযোগগুলোকে কাজে লাগানোর আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলেন, হালাল বাজারের পূর্ণ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে বাংলাদেশে একটি ঐক্যবদ্ধ, জ্ঞানভিত্তিক ও বৈজ্ঞানিকভাবে সমর্থিত হালাল ইকোসিস্টেম গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি।
তারা আরও বলেন, কোনো পণ্য শুধু ধর্মীয়ভাবে বৈধ হলেই যথেষ্ট নয়, বরং তা হতে হবে বিশুদ্ধ, নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মতও। ইসলামিক ফাউন্ডেশন এবং বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) হালাল সার্টিফিকেশন উদ্যোগ বাংলাদেশের হালাল শিল্প বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি এনেছে।
শনিবার ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত ‘বাংলাদেশের হালাল শিল্পের উন্নয়ন: চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক ফোকাস গ্রুপ আলোচনা সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্যে ঢাকা চেম্বারের ঊর্ধ্বতন সহসভাপতি রাজিব এইচ চৌধুরী বলেন, হালাল শিল্প বর্তমানে শুধু একটি ধর্মীয় বিধান নয়, এটি এখন বৈশ্বিক অর্থনীতির দ্রুত-বর্ধনশীল ও সম্ভাবনাময় একটি খাত।
তিনি বলেন, বিশ্বে হালাল পণ্যের বাজার প্রায় ৩ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের, কিন্তু বাংলাদেশ রপ্তানি করছে মাত্র ৮৫০ মিলিয়ন ডলারের হালাল পণ্য। যার বেশিরভাগই কৃষিভিত্তিক। কার্যকর হালাল ইকোসিস্টেম ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সার্টিফিকেশন বোর্ডের অভাবে দেশের বিশাল সম্ভাবনাময় এই খাতের কাঙ্ক্ষিত বিকাশ হচ্ছে না।
রাজিব এইচ চৌধুরী আরও বলেন, ২০৩৪ সালের মধ্যে বৈশ্বিক হালাল বাজার ৯ দশমিক ৪৫ ট্রিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে। অথচ বাংলাদেশে কাঠামোগত ও প্রাতিষ্ঠানিক অব্যবস্থাপনার কারণে আমরা এ খাতে পিছিয়ে আছি। আন্তর্জাতিক মান বজায় না রাখা, সার্টিফিকেট প্রাপ্তির জটিলতা, আধুনিক ল্যাবের অভাব, দক্ষ জনবল সংকট সব মিলিয়ে হালাল ইকোসিস্টেম গড়ে উঠছে না।
তিনি বলেন, ‘হালাল শিল্প খাতকে আমাদের অর্থনীতির নতুন চালিকাশক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে হলে স্বতন্ত্র হালাল সার্টিফিকেশন বোর্ড গঠন করা এখন সময়ের দাবি।’
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে ‘আইইউবিএটির’ মার্কেটিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. মমিনুল ইসলাম বলেন, গত ২ আগস্ট ঢাকায় আয়োজিত জাতীয় পর্যায়ের স্টেকহোল্ডার সংলাপ এবং পরবর্তীতে ১২-১৫ আগস্ট মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত যৌথ কর্মসূচি বাংলাদেশের হালাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল হাব গঠনের স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথকে আরও সুগম করেছে।
বর্তমানে দেশে ৩০০টিরও বেশি প্রতিষ্ঠান হালাল সার্টিফিকেশন পেয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখন সময় এসেছে একটি একীভূত জাতীয় হালাল কর্তৃপক্ষ গঠনের, যেখানে ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বিএসটিআই, একাডেমিক প্রতিষ্ঠান ও শিল্প খাতের মধ্যে সমন্বয় থাকবে। পাশাপাশি স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে হালাল শিক্ষা অন্তর্ভুক্তকরণও অত্যন্ত প্রয়োজন।
তিনি আরও বলেন, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও সিঙ্গাপুরের মতো দেশগুলো ধর্মীয় বিধান, বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও জাতীয় ব্র্যান্ডিংকে একত্র করে হালাল খাতকে নীতিনির্ধারণের আওতায় এনেছে। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হিসেবে বাংলাদেশও একইভাবে এগোলে বিশাল সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হবে।
দেশে এখনো ‘হালাল কান্ট্রি ব্র্যান্ডিং’ গড়ে ওঠেনি। এ জন্য বড় আকারের আন্তর্জাতিক হালাল এক্সপো আয়োজন এবং সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে (পিপিপি) প্রকল্প বাস্তবায়নের পরামর্শ দেন বক্তারা।
আলোচনার শেষে বক্তারা আশাবাদ ব্যক্ত করেন যে, যৌথ উদ্যোগ, নৈতিক প্রতিশ্রুতি এবং আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে বাংলাদেশ একদিন বৈশ্বিক হালাল বাজারে একটি শক্তিশালী অবস্থান দখল করবে। যা শুধু অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিই নয়, বরং আত্মিক পরিতৃপ্তিও এনে দেবে।
সভায় আলোচক হিসেবে অংশ নেন বাংলাদেশ অ্যাক্রেডিটেশন বোর্ডের মহাপরিচালক মো. আমিনুল ইসলাম, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. জহিরুল ইসলাম, বিডার মহাপরিচালক (যুগ্ম সচিব) মো. আরিফুল হক, ইপিবির মহাপরিচালক মিসেস বেবী রাণী কর্মকার, বিএসটিআইর উপপরিচালক (হালাল সার্টিফিকেশন) এস এম আবু সাইদ, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উপপরিচালক ড. মো. আবু সালেহ পাটোয়ারী।
ডিসিসিআই সহসভাপতি মো. সালিম সোলায়মান, পরিচালনা পর্ষদের সদস্য, সরকারি ও বেসরকারি খাতের প্রতিনিধিরা এ সময় উপস্থিত ছিলেন।