প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী শেখ মইনুদ্দিন বলেছেন, সরকার ব্যয় ব্যবস্থাপনায় বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে এবং ভবিষ্যতের যেকোনো উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য বিদেশি ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে স্থায়িত্ব এবং নমনীয়তার কঠোর মানদণ্ড অনুসরণ করছে।
সরকার কম সুদের হার এবং নমনীয় শর্তে ঋণ সংগ্রহের জন্য কাজ করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমরা জোর দিয়ে বলছি যে, যেকোনো নতুন বিদেশি অর্থায়নের ক্ষেত্রে অবশ্যই একটি উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে।’
বাসসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি উল্লেখ করেন, ঋণদাতা দেশ বা সংস্থার আরোপিত শর্তগুলো দীর্ঘদিন ধরে প্রতিযোগিতা সীমিত করেছে, যার ফলে তহবিল প্রদানকারী দেশের কোম্পানিগুলোই বেশিরভাগ সময় প্রকল্পের কাজ পেয়ে যায়। যদিও সরকার ন্যায্য ও প্রতিযোগিতামূলক ক্রয় নিশ্চিত করতে নিয়মিতভাবে উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতি অনুসরণ করে।
তিনি জানান, সরকার এখন এমন প্রকল্পের জন্য ঋণ নিতে চায়, যেগুলোর ওপর এ ধরনের সীমাবদ্ধ শর্ত নেই।
দেশের অবকাঠামো উন্নয়ন কৌশল সম্পর্কে বিশেষ সহকারী বলেন, সরকার নতুন মেট্রোরেল প্রকল্পগুলো এগিয়ে নিতে আগ্রহী।
তিনি আরও জানান, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) এসব প্রকল্পে ঋণ দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে, যেখানে উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতি বজায় থাকবে।
মেট্রোরেল প্রকল্পের ব্যয় ব্যবস্থাপনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সরকার ব্যয় হ্রাসকে অগ্রাধিকার দিয়ে একটি কৌশল বিবেচনা করছে, তা হলো- ধারাবাহিকভাবে না করে একই সঙ্গে একটি প্রকল্পের জন্য সমস্ত চুক্তি প্যাকেজ চালু করা। এর ফলে দরদাতাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা বাড়বে এবং সরকার বিদ্যমান ঠিকাদারদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে না।
তিনি আরো বলেন, নতুন অবকাঠামো প্রকল্প হাতে নেওয়ার ক্ষেত্রে সরকার সতর্কভাবে এগোচ্ছে, যেন পরবর্তী সরকারের ওপর অপ্রয়োজনীয় আর্থিক চাপ না পড়ে।
মইনুদ্দিন জানান, ঠিকাদার দেউলিয়া হওয়া, অর্থের অভাব, ভূমি অধিগ্রহণে বিলম্ব এবং ইউটিলিটি লাইন স্থানান্তরের মতো সমস্যার কারণে অনেক চলমান উন্নয়ন প্রকল্প স্থবির হয়ে আছে।
তিনি বলেন, বর্তমানে পরিবহন খাতের সবচেয়ে বড় কাঠামোগত চ্যালেঞ্জ হলো- বিভাগগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের ঘাটতি।
এই সমস্যা মোকাবিলায় মইনুদ্দিন বলেন, নৌপথ, সড়ক ও মহাসড়ক, বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ (বিবিএ) এবং বিমান পরিবহনসহ সব পরিবহন-সংশ্লিষ্ট বিভাগকে একটি ঐক্যবদ্ধ কাঠামোর অধীনে পরিচালনা করা উচিত।
ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারুক আহমেদ বাসসকে বলেন, সরকার ক্রয় প্রক্রিয়ায় প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ নিশ্চিত করতে কাজ করছে, যা ব্যয় সাশ্রয়, উদ্ভাবন, ন্যায্যতা ও দায়িত্বশীল পণ্য ও সেবা সংগ্রহে সহায়ক ভূমিকা রাখবে।
তিনি বলেন, একটি সুপরিচালিত প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র প্রক্রিয়া সরবরাহকারীদের সর্বোত্তম মূল্য ও মান প্রস্তাব দিতে উৎসাহিত করে, পাশাপাশি সরকারকে তাদের ক্রয় ক্ষমতার মাধ্যমে স্থায়িত্ব ও সামাজিক দায়িত্বের লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করে।
ঋণদাতা সংস্থা ও দেশের শর্ত সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি জানান, সীমিত প্রতিযোগিতার কারণে মেট্রোরেল নির্মাণ প্রকল্পের কিছু প্যাকেজে দরদাতারা অনুমিত খরচের চেয়ে বেশি দর প্রস্তাব করেছিলেন।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হুসাইন বলেন, সরকারকে দাতা সংস্থা বা ঋণদাতা দেশের সঙ্গে আরও আলোচনায় যেতে হবে, যাতে শর্তগুলো কমানো যায় এবং দরপত্র প্রক্রিয়ায় প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করা যায়।
তিনি আরও বলেন, যেকোনো প্রকল্পে ব্যয় ও সম্ভাব্য মুনাফার যথাযথ হিসাবের পাশাপাশি সবচেয়ে উপযুক্ত অর্থায়ন উৎস বেছে নেওয়া জরুরি।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের অধিকাংশ অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পই বিদেশি অর্থায়নে পরিচালিত। এই ঋণগুলোর উদ্দেশ্য কতটা গ্রহীতা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে সহায়তা করা এবং কতটা ঋণদাতা দেশের ব্যবসা সম্প্রসারণ ও রপ্তানি বৃদ্ধি করা, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।
তিনি ব্যাখ্যা করেন, বিশ্বব্যাংক ও এডিবির মতো বহুপাক্ষিক আন্তর্জাতিক সংস্থার ঋণের ক্ষেত্রে কোনো বাণিজ্য সম্প্রসারণের উদ্দেশ্য থাকে না।
তবে দ্বিপাক্ষিক ঋণের ক্ষেত্রে অনেক সময় ক্রয়, পরামর্শক নিয়োগ ও ঠিকাদারি কাজে নিজ দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোকে সুবিধা দেওয়ার লক্ষ্য থাকে।
তিনি বলেন, একটি দেশের উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় পুঁজি অন্য দেশ থেকে ঋণ নেওয়াতে মৌলিকভাবে কোনো সমস্যা নেই, তবে সেটি উভয়ের জন্য লাভজনক হতে হবে।
কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায়, ঋণদাতা দেশের প্রতিষ্ঠানই প্রকল্প পরিকল্পনা করছে, সম্ভাব্যতা যাচাই করছে, পরামর্শক হিসেবে কাজ করছে, আবার ঠিকাদার হিসেবেও প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে, বলেন তিনি।
তিনি বলেন, ফলে প্রকল্পের লাভ-ক্ষতির মূল্যায়ন নিরপেক্ষভাবে করা যায় না, বরং প্রকল্পের ব্যয়ও বেড়ে যায়। সূত্র: বাসস