বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেছেন, দেশের স্বল্পমেয়াদি জ্বালানি সংকট মোকাবিলায় এলপিজির দাম নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত জরুরি। বর্তমানে সিলিন্ডারের বাজার মূল্য ১২০০ টাকার বেশি হওয়ায় শিল্প ও গৃহস্থালি ব্যবহারকারীরা যথাযথ সুবিধা পাচ্ছেন না। অথচ এর দাম ১ হাজার টাকা মধ্যে হওয়া উচিত।
বাজারে বাড়তি দামে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) বিক্রি বন্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত দিয়ে অভিযান চালানো হবে বলেও তিনি জানিয়েছেন।
শনিবার রাজধানীর একটি হোটেলে বাংলাদেশে এলপিজি: অর্থনীতি, পরিবেশ ও নিরাপত্তাশীর্ষক পলিসি কনক্লেভে এসব কথা বলেন জ্বালানি উপদেষ্টা।
টেকসই এলপিজি অর্থনীতি গড়ে তোলা, পরিবেশগত প্রভাব মোকাবিলা এবং নিরাপত্তা জোরদারের লক্ষ্য নিয়ে এই সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
এক শ্রেণির রাজনীতিবিদ ও তাদের সহযোগী ব্যবসায়ীরা জ্বালানির সংকট তৈরি করেছে বলে মন্তব্য করেন উপদেষ্টা ফাওজুল।
তিনি বলেন, ১২০০ টাকার এলপিজি সিলিন্ডার বিক্রি হয় ১৪০০ টাকায়। এটার দায় নিতে হবে ব্যবসায়ীদের। দায়-দায়িত্বহীন ব্যবসা তো চলতে পারে না। জ্বালানি সংকটে এলপিজি একটা বড় সমাধান হতে পারে। বড় সমস্যা হলো- এলপিজির দামটা বেশি। এটা মূলত বেসরকারি খাতে সরবরাহ হয়। এলপিজির দামটা একটা চ্যালেঞ্জ। তবে ব্যবসায়ীদের দায়িত্বশীল হতে হবে। অতিরিক্ত মুনাফা করে সম্পদের পাহাড় গড়ে বিদেশে টাকা পাচার করার মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। জ্বালানি নিশ্চিত না করেই চাহিদার অতিরিক্ত বিদ্যুৎকেন্দ্র করা হয়েছে। গ্যাস খাতে অসংখ্য অবৈধ সংযোগ দেওয়া হয়েছে। এসব অপকর্ম করেছেন রাজনীতিবিদরা।
দেশে জ্বালানি অনুসন্ধান কাজ বাড়ানো হয়েছে জানিয়ে জ্বালানি উপদেষ্টা বলেন, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানির (বাপেক্স) জন্য নতুন রিগ কেনা হচ্ছে। তবে এখন পর্যন্ত উন্নতি সন্তোষজনক নয়। এসব কারণে বাধ্য হয়ে চড়া দামের এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে। এলএনজি রূপান্তরের সক্ষমতা বাড়াতে নতুন এফএসআরইউ চেষ্টা করা হচ্ছে। এগুলো দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। বিদ্যুৎ উৎপাদনসহ অন্য খাতে কীভাবে এলপিজি ব্যবহার করা যায়, সেটা বের করতে হবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খান বলেন, রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের দোষারোপ করে গেছেন জ্বালানি উপদেষ্টা। বিষয়টা আসলে এমন নয়, সবাইকে দোষারোপের কিছু নেই। বাংলাদেশের গ্যাস ফুরিয়ে যাচ্ছে। এ ঘাটতি কীভাবে পূরণ করা হবে, তার পরিকল্পনা এখন থেকেই করতে হবে। জ্বালানি সরবরাহ বাড়িয়ে মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়াই মূল লক্ষ্য। একটি দেশের উন্নয়নের চাবিকাঠি হলো জ্বালানি। মানুষ যত উন্নতির দিকে যাবে, জ্বালানি চাহিদা তত বাড়বে। জ্বালানি ব্যতিরেকে আজকের দুনিয়া চলতে পারে না।
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ বলেন, উন্নত দেশের পর্যায়ে যেতে হলে মাথাপিছু জ্বালানি ব্যবহার বাড়াতে হবে। এ ক্ষেত্রে এলপিজি ভূমিকা রাখতে পারে। ডলারের দর ও সৌদি আরামকোর বিক্রয় মূল্য ধরে প্রতি মাসে এলপিজির দাম সমন্বয় করা হচ্ছে। মূল কথা হলো- ভোক্তা যাতে কম দামে এলপিজি পায়। আর ব্যবসায়ীদের লাইসেন্স নিতে ভোগান্তি কমানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।
অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের উপাচার্য ম. তামিম। এতে বলা হয়, দেশে প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহের ক্ষেত্রে এখন দিনে ১৬০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের ঘাটতি আছে। আর বছরে এলপিজি মজুত করার সক্ষমতা আছে ১৬ লাখ টন। দিনে ৪০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহের সক্ষমতা আছে এলপিজি খাতে। শিল্পে গ্যাস সংকট কাটাতে এলপিজি ব্যবহার করা যেতে পারে। ডিজেল চালিত বয়লার রূপান্তর করে এলপিজি দিয়ে চালালে ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ খরচ কমানো সম্ভব। কয়লা, ডিজেল, ফার্নেস অয়েলের চেয়ে এলপিজির কার্বন নিঃসরণ কম।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম বলেন, জ্বালানি খাতে তামাশা চলছে। পাইপলাইনের গ্যাস বন্ধ করে এলপিজির বাজার তৈরি করা হয়েছে। তিনি স্বচ্ছভাবে ব্যবসা করে, সেবা দিয়ে এলপিজির নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আহ্বান জানান।
প্যানেল আলোচনায় অংশ নেন বিপিসি চেয়ারম্যান মো. আমিন উল আহসান, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ জাহেদ কামাল, ইস্ট কোস্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান আজম জে চৌধুরী, এলপিজি অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি মোহাম্মদ আমিরুল হক, ইস্টার্ন ব্যাংক পিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী রেজা ইফতেখার, ইউনাইটেড আইগ্যাস এলপিজি লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী হারুন গুরতাচ, পেট্রোম্যাক্স এলপিজি লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী মার্কো অ্যান্টোনিও রড্রিগেজ ডি অলিভেইরা এবং আকিজ বশির গ্রুপের চিফ অপারেটিং অফিসার মোহাম্মদ খোরশেদ আলম।
অনুষ্ঠানে দেশের জ্বালানি খাতের নীতিনির্ধারক, গবেষক, উদ্যোক্তা, শিল্পপ্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি ও উন্নয়ন সহযোগীরা অংশ নেন। কনক্লেভে এলপিজি খাতের ভবিষ্যৎ নীতিমালা প্রণয়ন, নিরাপত্তা মানদণ্ড, বাজার কাঠামো, পরিবেশগত টেকসই যোগ্যতা ও বিনিয়োগ সম্ভাবনা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। সঞ্চালনা করেন একটি জাতীয় দৈনিকের সম্পাদক ও প্রকাশক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ।