বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

দুই জালিয়াতের স্বেচ্ছাচারিতা ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয় ফারমার্স ব্যাংককে

  • নিজস্ব প্রতিবেদক   
  • ১৮ আগস্ট, ২০২৪ ২৩:২৫

নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে ঋণ অনুমোদন, ব্যবস্থাপনা কমিটিকে মূল্যায়ন না করা, অনুমোদনের আগেই ঋণের টাকা সরবরাহ, গ্রাহকের হিসাব থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে অর্থ উত্তোলন, ঋণ দিতে কমিশন বাণিজ্য এবং শেয়ার বাণিজ্যসহ নানা অভিযোগ রয়েছে ম খা আলমগীরের বিরুদ্ধে। আর এসব অপকর্মে এই জালিয়াতকে সহায়তা করেছেন ব্যাংকটির ইসি কমিটির চেয়ারম্যান আরেক জালিয়াত মাহবুবুল হক ওরফে বাবুল চিশতী।

‘জন্মদাতার হাতেই সন্তানের ভবিষ্যৎ ভস্মীভূত’- ঠিক এমনটাই ঘটেছে চতুর্থ প্রজন্মের ফারমার্স ব্যাংকের (বর্তমানে পদ্মা ব্যাংক) ভাগ্যলিপিতে। প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন খান আলমগীর নিজেই ব্যাংকটির ভবিষ্যৎ অন্ধকারে ঠেলে দেন।

নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে ঋণ অনুমোদন, ব্যবস্থাপনা কমিটিকে মূল্যায়ন না করা, অনুমোদনের আগেই ঋণের টাকা সরবরাহ, গ্রাহকের হিসাব থেকে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে অর্থ উত্তোলন করে নেয়া, ঋণ দিতে বিপুল অঙ্কের কমিশন বাণিজ্য এবং শেয়ার বাণিজ্যসহ বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ রয়েছে ম খা আলমগীরের বিরুদ্ধে।

আর এসব অপকর্মে এই জালিয়াতকে সহায়তা করেছেন ব্যাংকটির ইসি কমিটির চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক ওরফে বাবুল চিশতী। তিনি নিজেও তার পরিবারের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে অনিয়মের মাধ্যমে ঋণ দিতে ব্যাংকটিকে ব্যবহার করেছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত প্রতিবেদনে ফারমার্স ব্যাংকের এই দুই কুশীলবের বিরুদ্ধে এমন অসংখ্য অভিযোগ উঠে আসে। এমনকি ২০১৮ সালে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রাথমিক অনুসন্ধানেও ব্যাংকটিকে ধ্বংসে বাবুল চিশতী ও তার পরিবারের সদস্যদের সম্পৃক্ততার তথ্য মেলে।

এ বিষয়ে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘লুটপাটে ফারমার্স ব্যাংক শেষ হয়ে গেছে। প্রতিষ্ঠাতারাই ব্যাংকটিকে লুটপাট করে শেষ করে দিয়েছে।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন দলের রিপোর্ট বলছে, ২০১৭ সালে ব্যাংকের গুলশান শাখা কর্তৃক তনুজ করপোরেশনের বিপরীতে বড় অঙ্কের একটি ঋণ ক্রেডিট কমিটির সুপারিশ ছাড়া এবং পর্ষদ বা ইসি কমিটির অনুমোদন ছাড়াই মঞ্জুর ও বিতরণ করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ঋণ মঞ্জুর ও বিতরণে অনিয়ম হয়েছে। ব্যাংকের পর্ষদের তৎকালীন চেয়ারম্যান ম খা আলমগীর, তখনকার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এ কে এম শামীম এবং ওই শাখার ব্যবস্থাপক এ অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।

এ ছাড়া গুলশান শাখায় কয়েকটি ক্ষেত্রে দেখা যায়, কোনো ‘সেংশন লেটার’ বা অনুমতি পত্র ছাড়াই শুধু চেয়ারম্যানের সুপারিশে বড় বড় ঋণ অনুমোদন করা হয়েছে। ২০১৭ সালে গুলশান শাখাসহ বেশ কয়েকটি শাখা থেকে আলাদা আলাদা অ্যাকাউন্টে ৪০ কোটি, ১২ কোটি ৪৫ লাখ, ৯ কোটি ১৫ লাখ, ১০ কোটি ৭৭ লাখ টাকা প্রদান করা হলেও কোনোটির ক্ষেত্রেই ব্যবস্থাপনা কমিটি ‘লোন সেংশন’ করেনি।

একই বছরের ১৮ অক্টোবর ৪০ কোটি টাকার ঋণ বর্ধিতকরণের জন্য চেয়ারম্যান ও এমডি ফরমাল সুপারিশ করলেও তার আগেই ঋণটি প্রদান করা হয়। সেখানে কোনো প্রকার ব্যাংকিং নিয়মের তোয়াক্কা করা হয়নি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই পরিদর্শন প্রতিবেদনে আরও উঠে আসে, ২০১৭ সালের ১৯ জুলাই গুলশান শাখায় তনুজ করপোরেশনের মেয়াদি ঋণের হিসাব থেকে ১ কোটি ২২ লাখ টাকা গ্রাহকের চলতি হিসাবে স্থানান্তর করা হয়। একই দিনে এ হিসাব থেকে ৪২ লাখ টাকা নগদ উত্তোলন এবং অবশিষ্ট ৮০ লাখ টাকা পে-অর্ডার হিসেবে স্থানান্তর করতে পিও ইস্যু করা হয়।

একদিন পর ২০ জুলাই পে-অর্ডারটি বাতিল করে পার্কিং হিসেবে (টিওএস) স্থানান্তর করা হয়। ওইদিনেই আবার তা থেকে ১৮ লাখ টাকা এবং ১৬ লাখ ৫০ হাজার টাকার দুটি পে-অর্ডার ইস্যু করা হয়। এর একটিতে ম খা আলমগীরের নাম এবং অন্যটিতে বাবুল চিশতীর নাম উল্লেখ রয়েছে। এভাবে গ্রাহকের হিসাব থেকে অর্থ উত্তোলনের মাধ্যমে নিজস্ব প্রয়োজনে পে-অর্ডার করে অনিয়ম/জাল-জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন ম খা আলমীগ ও বাবুল চিশতী।

ব্যাংকের গুলশান শাখার ৩টি ঋণ (তনুজ করপোরেশন, জাহান ট্রেডার্স এবং এস২আরএস করপোরেশন) হিসাবের অনুকূলে বিতরণকৃত ঋণের অধিকাংশ অর্থেরই প্রকৃত সুবিধাভোগী সাবেক পর্ষদ চেয়ারম্যান ম খা আলমগীর এবং অডিট কমিটির চেয়ারম্যান বাবুল চিশতী।

এ ছাড়া ওই তিন গ্রাহকের বিভিন্ন ঋণ হিসাব থেকে ম খা আলমগীর এবং বাবুল চিশতী কর্তৃক ব্যাংকের অন্য উদ্যোক্তা পরিচালকদের থেকে শেয়ার কেনার জন্য একাধিক পে-অর্ডারের মাধ্যমে অর্থ স্থানান্তরও করা হয়। এ ক্ষেত্রে সন্দেহজনক বেশ কিছু লেনদেনের তথ্য পায় বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন দল। এ ছাড়া শাখার গ্রাহক এডিএম ডাইং অ্যান্ড ওয়াশিং এবং সাবাবা অ্যাপারেলসের অনুকূলে বিতরণকৃত মোট ৫৭ কোটি ৭৫ লাখ ৩০ হাজার টাকা ঋণের প্রকৃত সুবিধাভোগী ওয়েলটেক্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাজেদুল হক চিশতী (শামীম চিশতী)। তিনি সম্পর্কে বাবুল চিশতীর ভাই। ছেলে রাশেদুল হক চিশতীও এমন সুবিধা নিয়েছেন।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্ত প্রতিবেদন অনুসারে, যেসব কোম্পানিকে ফারমার্স ব্যাংক থেকে ঋণ দেওয়া হতো, বেশিরভাগের ব্যাংক হিসাব তার কিছুদিন আগে করা। অর্থাৎ ঋণ নেওয়ার জন্যই হিসাব খোলা হয়েছে।

কাগজে-কলমে নানা রকমের ব্যবসার কথা বলা হলেও ঋণ নেওয়ার কয়েকদিনের মধ্যে সিংহভাগ টাকা তোলা হতো নগদে। অর্থাৎ সেই টাকা কার অ্যাকাউন্টে বা কোথায় যাচ্ছে তা কেউ বলতে পারবে না।

বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তারা মনে করেন, এভাবে প্রচুর টাকা দেশের বাইরে পাচার করা হয়েছে। ২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর দুটি অ্যাকাউন্টে ফারমার্স ব্যাংক থেকে ট্রান্সফার করা হয়েছিল মোটা অঙ্কের অর্থ। প্রথমটির নামে দেখা যায়, ফারিব অটো রাইস মিলস, দ্বিতীয়টির নাম এসএনডি। তাদের দুটি হিসাবে স্থানান্তর করা হয় যথাক্রমে ৬ কোটি ২ লাখ ২০ হাজার ও ৫ কোটি ৩৮ লাখ ৬৭ হাজার টাকা। অবাক করা বিষয় হলো- এ দুটি অ্যাকাউন্ট খোলা হয় ২৭ নভেম্বর। অর্থাৎ যেদিন অ্যাকাউন্ট খোলা হয় সেদিনই ঋণের টাকা স্থানান্তর করা হয়।

প্রতিবেদনে আরও উঠে এসেছে, বড় ঋণগ্রহীতাদের মধ্যে বাবুল চিশতীর ভাই ও তার ছেলের কয়েকটি কোম্পানি ছিল- যেসব কোম্পানির নামে বিপুল অর্থ বের করে নেওয়া হয় ফারমার্স ব্যাংক থেকে। শুধু তা-ই নয়, ভুয়া ও সাইনবোর্ড সর্বস্ব প্রতিষ্ঠানকে মোটা কমিশনের বিনিময়ে বড় অঙ্কের লোন দিতেও কার্পণ্য করত না এই চক্র।

এসব ঋণ কেলেঙ্কারির কারণে দুদকে বাবুল চিশতী ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে ১২টি মামলা করা হলেও রাজনৈতিক ক্ষমতাবলে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায় ম খা আলমগীর। অবশ্য ২০১৮ সালে দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধানে উঠে আসে, বাবুল চিশতী ও রাশেদুল হক চিশতী ভুয়া প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিয়ে ফারমার্স ব্যাংক থেকে কৌশলে প্রায় ১৮০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।

এ বিভাগের আরো খবর