বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

ম খা আর বাবুল চিশতী যেভাবে লুটপাট করে ফারমার্স ব্যাংক

  • নিজস্ব প্রতিবেদক   
  • ১৭ আগস্ট, ২০২৪ ২১:৫৯

ঋণ কেলেঙ্কারির কারণে বাবুল চিশতী ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে ১২টি মামলা করেছে দুদক। তবে ম খা আলমগীর তখন প্রভাবশালী থাকায় শুধু চেয়ারম্যান পদ থেকে সরিয়ে দিয়েই চুপ হয়ে যান নিয়ন্ত্রকরা। সপরিবারে দেশের বাইরে অবস্থান করা ম খা আলমগীরকে দ্রুত দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের দাবি ব্যাংক খাত-সংশ্লিষ্টদের।

সাবেক ফারমার্স ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর ও অডিট কমিটির চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক ওরফে বাবুল চিশতীর ব্যাপক অনিয়ম ও লুটপাটের কারণে নতুন প্রজন্মের ব্যাংকটি ধ্বংস হয়েছে যায়। সাধারণত কোনো প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তাদের সেই প্রতিষ্ঠানটিকে টিকিয়ে রাখতে তৎপর হতে দেখা যায়, তবে ম খা আলমগীরের ক্ষেত্রে ছিল ব্যতিক্রম। তিনি ও তার ঘনিষ্ঠ মাহবুবুল হক ওরফে বাবুল চিশতী মিলে উদীয়মান ব্যাংকটিকে প্রায় ধ্বংস করে দিয়েছিল। নামে-বেনামে ঋণ, ব্যবস্থাপনা কমিটিকে তোয়াক্কা না করে ঋণ অনুমোদন, নামমাত্র প্রতিষ্ঠান তৈরি করে সেসব হিসাবে কোটি কোটি টাকা হস্তান্তর, ঋণ অনুমোদন হওয়ার আগেই টাকা সরবরাহ, ঋণ গ্রহীতাদের কাছ থেকে বিপুল অঙ্কের কমিশন, শেয়ার বাণিজ্য- এমন শত শত অভিযোগ উঠে এসেছে খোদ বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত প্রতিবেদনে।

যদিও ব্যাংকটির শুরুর গল্পটা ছিল আশায় ভরা। ২০১৩ সালে তৎকালীন সরকার চতুর্থ প্রজন্মের কয়েকটি ব্যাংকের লাইসেন্স প্রদান করে। যাদের উদ্দেশ্য ছিল ভিন্ন ধারায় আধুনিক ব্যাংকিং করে উদাহরণ তৈরি করা। ফারমার্স ব্যাংকের মূলত উদ্দেশ্য ছিল দেশের কৃষি খাতের উন্নয়নে ঋণ প্রধান ও কৃষিকে আধুনিকায়ন করতে ভূমিকা রাখা। ক্ষমতাসীন সরকারের অল্প সময়ের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীরকে দেওয়া হয় ব্যাংকটির লাইসেন্স। কার্যক্রম শুরু হলে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেন তিনি। পাশাপাশি ইসি কমিটির চেয়ারম্যান বানানো হয় তার ঘনিষ্ঠ মাহবুবুল হক ওরফে বাবুল চিশতীকে। যারা দুজন মূলত অনিয়মের নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত তৈরি করে ব্যাংকটিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে আসেন। নিয়ম অনুযায়ী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও অন্য পরিচালকরা থাকলেও তাদের তেমন কোনো ভূমিকা ছিল না ব্যাংক কার্যক্রমে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষণে তাদের মধ্যেও কেউ কেউ অনিয়মে জড়িত ছিল বলে জানা গেছে।

শুধু তা-ই নয়, ব্যাংকটিতে নিয়োগের ক্ষেত্রেও ব্যাপক অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন দলের রিপোর্ট বলছে, ২০১৭ সালে ৮৫ জন কর্মকর্তা নিয়োগে প্রায় প্রতিটির ক্ষেত্রে তখনকার চেয়ারম্যানের সুপারিশ ছিল। অনেক প্রার্থীর বায়োডাটায় ‘চেয়ারম্যান ও ডিরেক্টর চিশতী’ বড় করে লেখা ছিল বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষকদের নজরে আসে। এইচ আর কর্তৃক লিখিত পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে তবে তা শুধুই নামমাত্র। কয়েকটি পরীক্ষায় কোনো নম্বর দেয়নি এইচ আর। বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষক দল বলছে, এইচ আর পলিসি ছিল শুধু খাতা-কলমে, যার কোনো প্রয়োগ ছিল না।

প্রধান অফিসের পাশাপাশি শাখা অফিসগুলোতেও নিজেদের লোক বসিয়ে সুপারিশের ঋণ অনুমোদন করাতেন এই চক্র। গুলশান শাখায় কয়েকটি ঋণের ক্ষেত্রে দেখা যায় কোনো ‘সেংশন লেটার’ ছাড়াই শুধু চেয়ারম্যানের সুপারিশে বড় বড় ঋণ অনুমোদন করা হয়েছে। ২০১৭ সালে গুলশান শাখা-সহ বেশ কয়েকটি শাখা থেকে আলাদা আলাদা অ্যাকাউন্টে ৪০ কোটি, ১২ কোটি ৪৫ লাখ, ৯ কোটি ১৫ লাখ, ১০ কোটি ৭৭ লাখ টাকা প্রদান করা হলেও কোনোটির ক্ষেত্রেই ব্যবস্থাপনা কমিটি ‘লোন সেংশন’ করেনি। একই বছরের অক্টোবর মাসের ১৮ তারিখে ৪০ কোটি টাকার ঋণ বর্ধিতকরণের জন্য চেয়ারম্যান ও এমডি ফরমাল সুপারিশ করলেও তার আগেই ঋণটি প্রদান করা হয়। যেখানে কোনো প্রকার ব্যাংকিং নিয়মের তোয়াক্কা করা হয়নি।

যেসব কোম্পানিকে ফারমার্স ব্যাংক থেকে ঋণ দেওয়া হতো, তদন্তে বেরিয়ে এসেছে, বেশির ভাগের ব্যাংক হিসাব তার কিছুদিন আগে করা। অর্থাৎ ঋণ নেওয়ার জন্যই হিসাব খোলা হয়েছে। কাগজে-কলমে নানা রকমের ব্যবসার কথা বলা হলেও ঋণ নেওয়ার কয়েকদিনের মধ্যে সিংহভাগ টাকা তোলা হতো নগদে। অর্থাৎ সেই টাকা কার অ্যাকাউন্টে বা কোথায় যাচ্ছে তা কেউ বলতে পারবে না। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তারা মনে করেন এভাবে করে প্রচুর টাকা দেশের বাইরে পাচার হয়েছে। ২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর দুটি অ্যাকাউন্টে ফারমার্স ব্যাংক থেকে ট্রান্সফার করা হয়েছিল মোটা অঙ্কের অর্থ। প্রথমটির নামে দেখা যায়, ফারিব অটো রাইস মিলস্, দ্বিতীয়টির নাম এসএনডি। তাদের দুটি হিসাবে স্থানান্তর করা হয় যথাক্রমে ৬ কোটি ২ লাখ ২০ হাজার ও ৫ কোটি ৩৮ লাখ ৬৭ হাজার টাকা। অবাক করা বিষয় হলো এই দুটি অ্যাকাউন্ট খোলা হয় ২৭ নভেম্বর। অর্থাৎ যেদিন অ্যাকাউন্ট খোলা হয় সেদিনই ঋণের টাকা স্থানান্তর করা হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের রিপোর্টে আরও উঠে এসেছে বড় ঋণ গ্রহীতাদের মধ্যে বাবুল চিশতীর ভাই ও তার ছেলের কয়েকটি কোম্পানি ছিল- যেসব কোম্পানির নামে বিপুল অর্থ বের করে নেওয়া হয় ফারমার্স ব্যাংক থেকে। শুধু তা-ই নয় ভুয়া ও সাইনবোর্ড সর্বস্ব প্রতিষ্ঠানকে মোটা কমিশনের বিনিময়ে বড় অঙ্কের লোন দিতেও কার্পণ্য করত না এই চক্র। ব্যাংকের শেয়ার দেওয়ার কথা বলেও কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে এই দুজনের বিরুদ্ধে। আমানতকারীদের অর্থ লুট করার উদাহরণও তৈরি করেছিলেন তারা।

ঋণ কেলেঙ্কারির কারণে বাবুল চিশতী ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে ১২টি মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তবে ম খা আলমগীর তখন প্রভাবশালী থাকায় শুধু চেয়ারম্যান পদ থেকে সরিয়ে দিয়েই চুপ হয়ে যান নিয়ন্ত্রকরা। জানা গেছে, ম খা আলমগীর বর্তমানে সপরিবারে দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। তবে তাদের দ্রুত দেশে ফিরিয়ে এনে বিচার করার দাবি করছেন ব্যাংক খাত-সংশ্লিষ্টরা। ব্যাংক খাতে যেন আর কখনোই এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয়, সেজন্য তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার দাবিও তুলছেন ব্যাংক খাত সংশ্লিষ্টরা।

এ বিভাগের আরো খবর