বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

ফারমার্স ব্যাংক কেলেঙ্কারির হোতা ম খা আলমগীর ও বাবুল চিশতী

  • নিজস্ব প্রতিবেদক   
  • ১৬ আগস্ট, ২০২৪ ২৩:০২

ফারমার্স ব্যাংকের যাত্রার শুরু থেকেই অবৈধ নিয়োগ-বাণিজ্য, নিয়মবহির্ভূত ঋণ বিতরণ ও ঋণের টাকা অন্যত্র সরিয়ে নেয়াসহ নানা অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন ব্যাংকটির তৎকালীন চেয়ারম্যান মহীউদ্দীন খান আলমগীর এবং ইসি কমিটির চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক ওরফে বাবুল চিশতী। সংশ্লিষ্টদের অভিমত, আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক মন্ত্রী ম খা আলমগীরকে আইনের আওতায় আনা উচিত।

চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংক হিসেবে ২০১৩ সালে অনুমোদন পায় সাবেক ফারমার্স ব্যাংক। অনুমোদন পাওয়ার পর পরই ব্যাংকটি নানা অনিয়মে জড়িয়ে পড়ে। ফলে প্রতিষ্ঠার মাত্র তিন বছর পরই বেঁচে থাকার চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয় ব্যাংকটি।

ফারমার্স ব্যাংক যাত্রার শুরু থেকেই অবৈধ নিয়োগ-বাণিজ্য, নিয়মবহির্ভূত ঋণ মঞ্জুর, ঋণ বিতরণ এবং ঋণের টাকা অন্যত্র সরিয়ে নেয়াসহ নানা অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন ব্যাংকটির তৎকালীন চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর এবং ইসি কমিটির চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক ওরফে বাবুল চিশতী।

ঋণ বিতরণে অনিয়ম, জালিয়াতি ও লুটপাটে অতীতের যেকোনো ব্যাংক কেলেঙ্কারি-অনিয়মকে ছাড়িয়ে যায় এই ব্যাংক। এখানেই থেমে থাকেননি ম খা আলমগীর ও বাবুল চিশতী। গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট থেকে পে-অর্ডারের মাধ্যমে নিজেদের অ্যাকাউন্টে অর্থ সরিয়ে নেয়ার মতো গুরুতর অপরাধ করতেও পিছপা হননি তারা।

পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের যোগসাজশে আমানতকারীদের অর্থ লোপাটে অস্তিত্ব সংকটে পড়া ব্যাংকটির বড় লেনদেনে অনিয়মের তদন্ত করতে গিয়ে জঘন্য অপরাধটি খুঁজে পেয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এ কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ম খা আলমগীর ও চিশতীর নৈতিক স্খলন ঘটেছে।

অর্থনীতির চালিকাশক্তি ব্যাংকের প্রাণ হচ্ছে গ্রাহক। কিন্তু একটি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও ইসি কমিটির চেয়ারম্যান রক্ষক হয়েও ভক্ষকের ভূমিকা নিয়ে গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট থেকে অর্থ সরিয়ে নেয়ার মতো অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়েছিলেন। এ দুজন বিভিন্ন উপায়ে অনিয়ম করে ব্যাংকটিকে পঙ্গু করে দেন এবং আমানতকারীদের পথে বসিয়ে দেন।

এক পর্যায়ে গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে ব্যর্থ হন তারা। ব্যাংকটির শাখাগুলোতে প্রতিদিন ভিড় করেও টাকা ফেরত পাচ্ছিলেন না আমানতকারীরা। শুধু তা-ই নয়, সরকারের জমা রাখা জলবায়ু তহবিলের টাকাও ফেরত দিতে অপারগতা প্রকাশ করেছিল ব্যাংকটি।

পরিস্থিতির চরম অবনতি হওয়ায় ২০১৭ সালে আওয়ামী লীগের সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ম খা আলমগীরকে চেয়ারম্যান পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে ব্যাংকটির পর্ষদে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হয়। তখন ফারমার্স ব্যাংককে আর্থিক মন্দা থেকে উদ্ধার করতে সরকার একটি আর্থিক লাইফলাইন নিয়ে পদক্ষেপ নেয়। ফারমার্স ব্যাংকের নাম বদলে করা হয় পদ্মা ব্যাংক।

সরকারের সিদ্ধান্তে ব্যাংকটির মালিকানায় যুক্ত হয় সোনালী, রূপালী, অগ্রণী ও জনতা ব্যাংক এবং ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অফ বাংলাদেশ (আইসিবি)। ব্যাংকটির প্রায় ৭০ শতাংশ শেয়ার সরকারি এসব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের হাতে থাকে।

২০১৮ সালে প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিনিধি হিসেবে পুনর্গঠিত পদ্মা ব্যাংকের নতুন পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন দেশের বিশিষ্ট শিল্পোদ্যোক্তা ও শীর্ষ ব্যবসায়ী ড. চৌধুরী নাফিজ সরাফাত। তার সুদক্ষ নেতৃত্বে ব্যাংকটি অনেক ক্ষেত্রেই সফলতা অর্জন করে। এ সময় ৯০০ কোটি টাকা নগদ আদায় ও ৪৫০০ কোটি টাকা আমানত সংগ্রহ করা হয়। পাশাপাশি ব্যক্তি এবং করপোরেট অ্যাকাউন্টের বিপরীতে ৪১০০ কোটি টাকা প্রদান করা হয় এবং স্বতন্ত্র ও ক্ষুদ্র আমানত ধরে রাখার হার ছিল ন্যূনতম ৫০ শতাংশ।

এ ছাড়া ড. চৌধুরী নাফিজ সরাফাতের নেতৃত্বে ব্যাংকটির কার্যক্রম পরিচালনায় বেশ কিছু যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে- ক্রেডিট অ্যাডমিনসহ লেনদেনের কেন্দ্রীয়করণ, তিনটি নতুন শাখা এবং ১৪টি উপশাখা চালু করা, ইসলামী ব্যাংকিং সিস্টেম প্রবর্তন করা, বাংলাদেশ অটোমেটেড ক্লিয়ারিং হাউস (বিএসিএইচ) এবং রিয়েল-টাইম গ্রস সেটেলমেন্টের (আরটিজিএস) মাধ্যমে লেনদেন নিষ্পত্তিকরণ এবং কিউআর কোড, পদ্মা ওয়ালেট, ই-চালান ইত্যাদি চালু করা।

জানা যায়, ফারমার্স ব্যাংকের গ্রাহকদের ঋণের ভাগ নিয়েছেন ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান মহীউদ্দীন খান আলমগীর ও ইসি কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতী। এর মাধ্যমে দুজনের নৈতিক স্খলন ঘটেছে এবং তারা জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন। ওই সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে উঠে এসেছিল ব্যাংকটির জনবল নিয়োগ হয়েছে মূলত এ দুজনের সুপারিশেই। আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে তারা বিভিন্ন পদে জনবল নিয়োগ দিয়েছেন।

ভুয়া ও সাইনবোর্ড-সর্বস্ব প্রতিষ্ঠানকে ঋণ পাইয়ে দিতেন ফারমার্স ব্যাংকের সাবেক ইসি কমিটির চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতী ওরফে বাবুল চিশতী। ব্যাংকের শেয়ার দেয়ার কথা বলে নিতেন কোটি কোটি টাকা। ব্যাংকের আমানতকারীদের অর্থ লুট করে মালিক হয়েছেন কয়েক হাজার কোটি টাকার সম্পদের।

ঋণ কেলেঙ্কারির কারণে তিনি ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে ১২টি মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

প্রসঙ্গত, দুজন পরস্পর যোগসাজশে আর্থিক অপরাধগুলো করা সত্ত্বেও সরকারি দলের সংসদ সদস্য থাকার কারণে ম খা আলমগীর আইনি ব্যবস্থা থেকে রেহাই পেয়ে যান।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে স্ত্রী-সন্তানের সঙ্গে বিদেশে অবস্থান করছেন ম খা আলমগীর। তাকে আইনের আওতায় এনে বিচার করা উচিত বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৭ সালের ১২ এপ্রিল তনুজ করপোরেশন ঋণের জন্য ফারমার্স ব্যাংকে আবেদন করে। কিন্তু ঋণ আবেদনটি নিষ্পত্তি হওয়ার আগে ওইদিনই তনুজ করপোরেশনের ব্যাংক হিসাবে জমা হয় ৫০ লাখ টাকা। পরে কোম্পানিটি সেই টাকা তাদেরই অন্য এক হিসাবে স্থানান্তর করে। অর্থাৎ ঋণ অনুমোদনের আগেই গ্রাহককে ঋণ সুবিধা দেয়া হয়, যার সঙ্গে জড়িত ছিলেন ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান মহীউদ্দীন খান আলমগীর ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে এম শামীম।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, তনুজ করপোরেশনের ব্যাংক হিসাব থেকে গত বছরের ১৯ জুলাই এক কোটি ২২ লাখ টাকা ফারমার্স ব্যাংকে খোলা তাদেরই অন্য এক ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তর করা হয়। তা থেকে ওইদিন ৪২ লাখ টাকা নগদে তোলা হয়। আর ৮০ লাখ টাকার একটি পে-অর্ডার ইস্যু করে তনুজ করপোরেশন। যদিও পরে পে-অর্ডারটি বাতিল করা হয়। পরে মহীউদ্দীন খান আলমগীরের নামে ১৮ লাখ ও মাহবুবুল হক চিশতীর নামে ১৬ লাখ ৫০ হাজার টাকার পে-অর্ডার ইস্যু করা হয়। অবশিষ্ট ৪৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা নগদে তুলে নেয়ার সুযোগ করে দেয়া হয় জাকির হোসেন নামে এক ব্যক্তিকে।

এদিকে জাহান ট্রেডার্স নামে অপর একটি ঋণ হিসাব থেকে এক কোটি ৪০ লাখ টাকা কোম্পানিটিরই আরেকটি হিসাবে পাঠানো হয়। ওই ঋণও দেয়া হয় মহীউদ্দীন খান আলমগীরের একক সুপারিশে। তনুজ করপোরেশন ও জাহান ট্রেডার্স উভয় কোম্পানিই নির্মাণ ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হলেও পুরো টাকা তুলেছেন নগদে। এর ফলে ঋণের টাকা প্রকৃত খাতে ব্যবহার হয়নি।

এ ছাড়া মাহবুবুল হক চিশতীর ছেলে রাশেদুল হক চিশতীর মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান আরসিএল প্লাস্টিকের সঙ্গে ব্যাংকের গ্রাহকদের অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্যও বেরিয়ে এসেছে। প্রতিবেদনটি ফারমার্স ব্যাংকে পাঠিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

১৯৯৬ সালে জনতার মঞ্চে বিএনপি সরকার যখন কিছুটা বেকায়দায় পড়ে ঠিক তখনই কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেয় বিতর্কিত আমলা বলে খ্যাত ম খা আলমগীরের নেতৃত্বে জনতার মঞ্চে যোগ দেয়া সরকারি কর্মকর্তাদের মিছিল। সেই থেকে তিনি আওয়ামী লীগের সুনজরে আসেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তাকে প্রধানমন্ত্রীর সচিব করা হয়। পরে সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর ১৯৯৭ সালে তাকে প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব দেয়া হয়। সে সময় তিনি পর্যায়ক্রমে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান।

ওয়ান-ইলেভেনে সেনা সমর্থিত সরকারের সময় জেল খাটেন ম খা আলমগীর। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পান ২০১২ সালে। এক বছর তিনি এই দায়িত্ব পালনের সুযোগ পান। তার সময়কালেই ধসে পড়ে সাভারের রানা প্লাজা। সে সময় তার উক্তি ‘হরতালকারীদের ধাক্কাধাক্কিতে রানা প্লাজা ধসে পড়েছে’, ব্যাপক সমালোচিত হয়।

এ বিভাগের আরো খবর