চীন বাংলাদেশের অবকাঠামো প্রকল্পে অর্থায়নের অন্যতম প্রধান উৎস ও চতুর্থ বৃহত্তম ঋণদাতা। প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ২০১৬ সালে বাংলাদেশ সফরকালে দেয়া ঋণ সহায়তার প্রতিশ্রুতির পর বেড়েছে চীনা ঋণ, যা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বার্ষিক এক বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চীনের দেয়া ঋণের সুদের হার ২ শতাংশ থেকে ২ দশমিক ১৫ শতাংশের মধ্যে ধরা হয়। আর তা পরিশোধের সময় মাত্র ১০ থেকে ১৫ বছর। অন্যদিকে বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) মতো ঐতিহ্যবাহী ঋণদাতারা ৩০ থেকে ৪০ বছর সময় দেয়।
বার্তা সংস্থা ইউএনবি জানায়, ঋণ পরিশোধের এই সময়কাল নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা মনে করছেন, এতে দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের আর্থিক অবস্থার ওপর চাপ পড়তে পারে।
এছাড়াও এসব ঋণের সঙ্গে যুক্ত প্রকল্পে সীমিত ঠিকাদার বাছাই প্রক্রিয়ার বিষয়টিও তুলে ধরেন অর্থনীতিবিদরা, যা প্রকল্পের স্বচ্ছতা ও ব্যয়-কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, বড় অঙ্কের ঋণ পরিশোধের ফলে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যেতে পারে। আর তার ফলে বড় ধরনের ঋণের বোঝা চেপে বসতে পারে।
গত চার অর্থবছরে চীন প্রায় তিন বিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে, যা ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশকে দেয়া তাদের মোট ঋণের প্রায় ৪০ শতাংশ। ঋণের এই প্রবাহ সত্ত্বেও এখনও ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে চীনের চেয়ে এগিয়ে জাপান, বিশ্বব্যাংক ও এডিবি।
বর্তমানে বাংলাদেশের মোট বার্ষিক ঋণের প্রায় ১০ শতাংশ চীন থেকে আসে। গত দুই বছরে বছরপ্রতি অন্তত এক বিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে দেশটি।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর চীনা ঋণের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতার ঝুঁকির বিষয়ে সতর্ক করেছেন। তিনি শ্রীলংকার অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করেন, যেখানে অবকাঠামো প্রকল্পের জন্য চীনের কাছ থেকে বড় ঋণ নেয়ার ফলে ঋণ পরিশোধের মারাত্মক চাপ সৃষ্টি হয়।
ড. মনসুর বলেন, ‘চীনা ঋণ ডলারে পরিশোধ করা হয়, যা ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রার নিম্নমানের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে চাপ বাড়ায়।’
বিশ্বব্যাংক, এডিবি বা জাপান থেকে ঋণ পরিশোধের সময়সীমা বাড়ানো হয়, যা চীনা ঋণকে কম জনপ্রিয় করে রাখে।
ড. মনসুর চীনা ঋণের একটি ইতিবাচক দিকও তুলে ধরেন। বলেন, ‘তাদের রাজনৈতিক সমঝোতার পরিবর্তে বাণিজ্য কৌশলের ক্ষেত্রে শ্রেণিবদ্ধ হওয়ার সুযোগ থাকছে।’
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯-২০ অর্থবছরে চীন ৬০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ দেয়, পরের বছর তা ২৪০ মিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। তবে ২০২১-২২ অর্থবছরে ঋণ দেয়ার পরিমাণ এক বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে পরের বছর তা ১ দশমিক ১২ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায়।
চীন গত চার অর্থবছরে বাংলাদেশকে ২ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে। এ নিয়ে ১৯৭৫ সাল থেকে চীনের দেয়া মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার।
গত অর্থবছরে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ঋণদাতা ছিল বিশ্বব্যাংক, ১ দশমিক ৯৩ বিলিয়ন ডলার; দ্বিতীয় স্থানে জাপান, ১ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার এবং তৃতীয় স্থানে এডিবি, ১ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন ডলার। আর ১ দশমিক ১২ বিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়ে চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে চীন। সব মিলিয়ে গত অর্থবছরে বিভিন্ন ঋণদাতার কাছ থেকে বাংলাদেশ পেয়েছে ৯ দশমিক ২৬ বিলিয়ন ডলার।
ইআরডির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, চীনের মতো সাশ্রয়ী শর্তে অন্যান্য উৎস থেকে ঋণ পাওয়া চ্যালেঞ্জিং। বাংলাদেশের প্রতি বছর প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক ঋণের প্রয়োজন হয়। সে ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও জাপানের মতো শীর্ষস্থানীয় বৈশ্বিক ঋণদাতারা প্রায় ৫ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার সরবরাহ করতে পারে।