জাতীয় সংসদে বৃহস্পতিবার উপস্থাপন করা ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের বাজেটে বিভিন্ন ধরনের পণ্যে শুল্ক ও কর বৃদ্ধির প্রস্তাব করা রয়েছে।
রাজস্ব আহরণ ত্বরান্বিত করতে ও দেশীয় শিল্প সুরক্ষার কথা বিবেচনায় নিয়ে শুল্ক-কর বৃদ্ধির এই প্রস্তাব রয়েছে বাজেটে। এর ফলে সংশ্লিষ্ট অনেক পণ্যের দাম বাড়তে পারে।
বৃহস্পতিবার বিকেলে জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেটের মূল স্লোগান- সুখী, সমৃদ্ধ, উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অঙ্গীকার।
শুল্ক-কর বৃদ্ধির প্রস্তাব বিবেচনা নিলে যেসব পণ্যের দাম বাড়তে পারে-
সিগারেট
প্রতি বছরের মতো এবারের প্রস্তাবিত বাজেটেও সিগারেট উৎপাদন পর্যায়ে সম্পূরক শুল্ক ও মূল্য স্তর বাড়ানো হচ্ছে। তিন স্তরের সিগারেটে সম্পূরক শুল্ক ৬৫ দশমিক ৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর ফলে সব ধরনের সিগারেটের দাম বাড়বে।
প্রতি ১০ গ্রাম জর্দার সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ৪৮ টাকা এবং একই পরিমাণ গুলের মূল্য ২৫ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। যাদের পান-জর্দা খাওয়ার অভ্যাস তাদের ব্যয় বাড়বে। একইসঙ্গে সিগারেট-বিড়ি পেপারের স্থানীয় উৎপাদন পর্যায়ে ভ্যাট সাড়ে ৭ থেকে ১৫ শতাংশ করার প্রস্তাব রয়েছে প্রস্তাবিত বাজেটে।
মোবাইল ফোন সিমকার্ড
মোবাইল অপারেটরদের সিমকার্ড বিক্রির ওপর কর ২০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০০ টাকা হতে পারে। ফলে বাড়তি দামে সিমকার্ড কিনতে হতে পারে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীদের।
মোবাইলে কথা বলতে বাড়তি খরচ
রাজস্ব আদায়ের আওতা বৃদ্ধি করতে মোবাইলে কথা বলতে আরও বাড়তি অর্থ গুনতে হবে এর ব্যবহারকারীদের। বর্তমানে একজন ভোক্তা মোবাইলে ১০০ টাকা রিচার্জ করলে ৭৩ টাকার কথা বলতে পারেন। বাকি ২৭ টাকা ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক হিসেবে কেটে নেয় মোবাইল অপারেটররা।
উপস্থাপিত বাজেটে মোবাইল সেবার সম্পূরক শুল্ক আরও ৫ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। সেক্ষেত্রে ব্যবহারকারী একশ’ টাকা রিচার্জ করে কথা বলতে পারবেন ৬৯ টাকা ৩৫ পয়সার।
আইসক্রিম
আইসক্রিমে সম্পূরক শুল্ক দ্বিগুণ করার প্রস্তাব করা হয়েছে বাজেটে। সে অনুযায়ী সম্পূরক শুল্ক ৫ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি করে ১০ শতাংশ করার কথা বলা হয়েছে। এর ফলে আইসক্রিমের দাম বাড়বে।
বৈদ্যুতিক মিটার
প্রস্তাবিত বাজেটে বলা হয়েছে, আমদানিকৃত সাধারণ কিলোওয়াট মিটার এবং প্রি-পেইড কিলোওয়াট আওয়ার মিটারের মাঝে মোট করভারে পার্থক্য রয়েছে; যা সমান হওয়া যৌক্তিক। সে বিবেচনায় প্রি-পেইড কিলোওয়াট আওয়ার মিটার ও অন্যান্য ইলেক্ট্রিক মিটারের আমদানি শুল্ক ১৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
প্রি-পেইড কিলোওয়াট মিটার পার্টস ও অন্যান্য ইলেক্ট্রনিক মিটারের পার্টসের আমদানি শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি করে ১৫ শতাংশ ধার্য করার সুপারিশ করা হয়েছে।
গাড়ি
বর্তমানে সংসদ সদস্যরা শুল্কমুক্ত সুবিধায় গাড়ি আমদানি করতে পারেন। বৈষম্য হ্রাসে বাজেটে এই সুবিধা বাতিল করে প্রস্তাবিত বাজেটে গাড়ি আমদানি করতে হলে সংসদ সদস্যদের ২৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক ও ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপের প্রস্তাব রয়েছে।
অন্যদিকে বিলাসবহুল গাড়িতে শুল্ক ফাঁকি রোধে হাইব্রিড ও নন-হাইব্রিড টাইপের গাড়ি ছাড় করতে কিছু সুনির্দিষ্ট শর্ত যোগ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। ফলে বিলাসবহুল গাড়ির দাম বাড়তে পারে।
কোমল পানীয় ও এনার্জি ড্রিংকস
কোমল পানীয়, কার্বোনেটেড বেভারেজ, এনার্জি ড্রিংকস, আমসত্বের ওপর ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হতে পারে। এ ছাড়া কার্বোনেটেড বেভারেজের ওপর ন্যূনতম কর আরও ২ শতাংশ বাড়িয়ে ৫ শতাংশ করা হতে পারে। ফলে বেশি দামে কিনতে হবে এসব পণ্য।
কাজুবাদাম
দেশে কাজুবাদাম চাষকে সুরক্ষা দেয়ার অংশ হিসেবে খোসা ছাড়ানো কাজুবাদাম আমদানিতে শুল্ক ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে কাজুবাদামের দাম বাড়তে পারে।
এসি
গরমে স্বস্তি পেতে অনেকে এয়ারকন্ডিশন বা এসি কিনছেন। আগামী বাজেটে এসিকে বিলাসী পণ্য বিবেচনা করে দেশে এসি উৎপাদনে ব্যবহৃত কম্প্রেসার ও সব ধরনের উপকরণের ভ্যাট ৫ থেকে বৃদ্ধি করে সাড়ে ৭ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে বাজেটে। এই প্রস্তাব বাস্তবায়ন হলে এসির দাম বাড়বে।
ফ্রিজ উৎপাদনে ব্যয় বাড়বে
বেশ কয়েক বছর ধরে দেশের ইলেক্ট্রনিক্স পণ্য খাতকে সরকার ভ্যাট অব্যাহতি দিয়ে আসছে। আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত ফ্রিজ উৎপাদনে ভ্যাট অব্যাহতি রয়েছে। তা আর বৃদ্ধি করা হবে না বলে জানা গেছে। সে ক্ষেত্রে নতুন অর্থবছরে ৫ শতাংশ ভ্যাটের হার বৃদ্ধি করে ৭ শতাংশ করা হতে পারে।
পানির ফিল্টার
বাসাবাড়িতে ব্যবহৃত পানির ফিল্টার আমদানিতে শুল্ক বাড়ানোর প্রস্তাব রয়েছে। দেশে উৎপাদন হওয়ায় পানির ফিল্টার আমদানিতে শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হচ্ছে। তাই গৃহস্থালিতে ব্যবহৃত পানির ফিল্টারের দাম বাড়তে পারে।
এলইডি বাল্ব
বিদ্যুৎ বিল সাশ্রয়ে অনেকে এলইডি বাল্ব ব্যবহার করেন। নিকট-ভবিষ্যতে এলইডি বাল্বের দাম বাড়তে পারে। কারণ বাজেটে এলইডি বাল্ব এবং এনার্জি সেভিং বাল্ব উৎপাদনের উপকরণ আমদানিতে শুল্ক ১০ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
সিএনজি-এলপিজিতে কনভার্সন ব্যয়
জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় ব্যক্তিগত সিএনজি-এলপিজিতে কনভার্সন বেড়ে যাওয়ায় রাজস্ব আদায় বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দিয়েছে এনবিআর। গাড়ি সিএনজি-এলপিজিতে কনভার্সনে ব্যবহৃত কিট, সিলিন্ডারসহ অন্যান্য যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ আমদানিতে শুল্ক ৩ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫ শতাংশ করার প্রস্তাব দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। এ কারণে গাড়ি কনভার্সন ব্যয় বাড়তে পারে।
জেনারেটর
লোডশেডিং মোকাবিলায় বাসাবাড়ি বা শিল্পে জেনারেটরের ব্যবহার বাড়ছে। সেখানেও নজর দিয়েছে এনবিআর। জেনারেটর সংযোজন ও উৎপাদনে ব্যবহৃত উপকরণ বা যন্ত্রাংশ আমদানিতে এক শতাংশ শুল্ক আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে বাজেটে। শুল্ক বাড়লে দেশের বাজারে জেনারেটরের দাম বাড়তে পারে।
আমদানি করা ম্যাকরেল মাছ
বিদেশ থেকে ম্যাকরেল মাছ আমদানিতে ১৫ শতাংশ ভ্যাট ও ৫ শতাংশ অগ্রিম আয়কর যোগ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। তাতে করে পণ্যটির দাম বাড়তে পারে।
প্রি-ফেব্রিকেটেড বিল্ডিং নির্মাণ ব্যয়
প্রি-ফেব্রিকেটেড বিল্ডিং তৈরিতে ব্যবহৃত কম্পোনেন্টের ওপর ৫ শতাংশ শুল্ক ধার্য ছিল। আগামী অর্থবছরের বাজেটে তা বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করার কথা বলা হয়েছে। ফলে প্রি-ফেব্রিকেটেড বিল্ডিং তৈরিতে খরচ বাড়বে।
ইট
নির্মাণকাজে ব্যবহৃত ইটের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট করের পরিমাণ ৫ থেকে ১০ শতাংশ করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে বাজেটে। ফলে বাড়বে ইটের দাম।
নিরাপত্তা সেবা
রাজধানী ঢাকাসহ বড় বড় শহরে বাসাবাড়ি, অফিস, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন স্থানে নিরাপত্তা সেবা প্রায় অপরিহার্য। এ ধরনের নিরাপত্তা সেবায় ১০ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট বিদ্যমান। প্রস্তাবিত বাজেটে তা বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করার কথা বলা হয়েছে।
হাটবাজারের ইজারা
সংসদে উপস্থাপিত বাজেটে কর ব্যতীত প্রাপ্তি (নন-ট্যাক্স রেভিনিউ) বাড়াতে জেলা, উপজেলা, এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়ের হাটবাজারের ইজারা মূল্য কিছুটা বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। সে সঙ্গে জমির নামজারির মাশুলও (ফি) বৃদ্ধি পেতে পারে।
চিকিৎসা সরঞ্জাম আমদানি
কিছু শর্ত প্রতিপালন সাপেক্ষে রেফারেল বা বিশেষায়িত হাসপাতালে শুল্ক ছাড় সুবিধায় ১ শতাংশ শুল্কে মেডিক্যাল যন্ত্র ও সরঞ্জাম আমদানির সুযোগ রয়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে দুশটিরও বেশি মেডিক্যাল যন্ত্র ও সরঞ্জাম আমদানির ক্ষেত্রে তা বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করার কথা বলা হয়েছে। তাতে করে রোগীদের চিকিৎসা ব্যয় আরও বাড়তে পারে।
পাশাপাশি অর্থনৈতিক অঞ্চল উন্নয়নে ডেভেলপারের আনা ব্যবহৃত সামগ্রীতে এক শতাংশ শুল্ক আরোপ এবং অর্থনৈতিক অঞ্চলে অবস্থিত প্রতিষ্ঠানের শুল্কমুক্ত সুবিধায় গাড়ি আমদানির সুযোগ বাতিলের প্রস্তাব করা হয়েছে। ফলে অর্থনৈতিক অঞ্চলে শিল্প স্থাপনকারী প্রতিষ্ঠানকে শুল্ক ছাড়া অন্যান্য শুল্ক-কর (ভ্যাট, সম্পূরক শুল্ক, রেগুলেটরি শুল্ক) পরিশোধ করতে হবে।