গ্রাহকের আস্থায় দেশের ব্যাংকগুলোর মধ্যে শীর্ষে থাকা সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. আফজাল করিম বলেছেন, সেবায়ও সবার ওপরে থাকতে চায় আর্থিক প্রতিষ্ঠানটি।
দেশের সর্ববৃহৎ ব্যাংকের এমডি মনে করেন, স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে স্মার্ট ব্যাংকিং সেবা নিশ্চিত করতে হবে।
এক সাক্ষাৎকারে সোনালী ব্যাংকের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন দেশের শীর্ষ এ ব্যাংক কর্মকর্তা।
২০২৩ সালে সোনালী ব্যাংক পিএলসি পরিচালন মুনাফা করে ৩ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা। এ তথ্য অনেকেরই জানা।
দেশের সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রীয় ব্যাংক মুনাফা করবে সেটাকেও অনেকে স্বাভাবিক ভাবতে পারেন, তবে শেষ হওয়া বছরে সোনালী ব্যাংকের উন্নতির গল্পটা ছিল অবাক করার মতো।
পরিচালন মুনাফা যেখানে আগের বছর ছিল ২ হাজার ৩৮২ কোটি টাকা, বছরের ব্যবধানে তা বেড়েছে ১ হাজার ৩৪৫ কোটি টাকা, শতকরা হিসাবে যা ৫৬ শতাংশেরও বেশি।
শুধু এই একটি অর্জনই নয়, গত বছর শেষে রাষ্ট্রীয় ব্যাংকটির ঋণ বিতরণ ছাড়ায় এক লাখ কোটি টাকার ঘর, যেখানে প্রবৃদ্ধি ১৯ শতাংশ।
এ বছর প্রথম ব্যাংক হিসেবে সোনালী ব্যাংক নিজের দখলে নিয়েছে দেড় লাখ কোটি টাকার আমানত।
যার নেতৃত্বে একের পর এক এমন অভাবনীয় অর্জন সম্ভব হয়েছে, তিনি ব্যাংকটির বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আফজাল করিম। ২০২২ সালের আগস্টে সোনালী ব্যাংকের দায়িত্ব পাওয়ার আগে তিনি ছিলেন বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। ব্যবস্থাপনা দক্ষতা ও সেবার মানোন্নয়নের মাধ্যমে ব্যাংকিং কর্মকাণ্ড আরও গতিশীল করতে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি।
দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে সোনালী ব্যাংক ব্যাপকভাবে কাজ করছে জানিয়ে তিনি বলেন, জনসাধারণকে সঞ্চয়ে উদ্বুদ্ধকরণে বিভিন্ন ধরনের আমানত প্রোডাক্ট প্রবর্তন করা হয়েছে। দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নয়ন ঘটিয়ে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে শিল্প প্রকল্প ঋণ, আমদানি-রপ্তানি ঋণ, কৃষিঋণ, ক্ষুদ্র ব্যবসা ঋণ, এসএমই ঋণসহ বিভিন্ন ঋণ স্কিমের মাধ্যমে তাদের সহায়তা প্রদান করে আসছে ব্যাংকটি।
বিচক্ষণ এ ব্যাংকার মনে করেন, সম্ভাবনাময় খাতে ঋণ বিতরণ আর পুরোনো খেলাপি ঋণ উদ্ধার হলেই কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে যাওয়া সহজ হবে। এ জন্য তারা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন সিএসএমই খাতে।
গ্রাহককে সবচেয়ে আধুনিক সেবা দিতে পুরো টিম কাজ করছে জানিয়ে আফজাল করিম বলেন, এরই মধ্যে অ্যাপ ব্যবহারের মাধ্যমে ঘরে বসেই গ্রাহক প্রায় সব ধরনের ব্যাংকিং সেবা পাচ্ছেন, যার পরিসর আরও বাড়ানো হবে।
তিনি বলেন, ‘আমরা ডিজিটালাইজড সেবা দিতে কোনোভাবেই পিছিয়ে নেই। সার্ভিস যদি অটোমেটেড হয়, সার্ভিস যদি ডিজিটালাইজড হয়, সেখানে গ্রাহক হয়রানি ও ভোগান্তি থাকে না। গ্রাহক যদি লম্বা লাইনে না দাঁড়িয়ে ঘরে বসেই সেবা পায়, তাহলে সে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবে।’
ই-সেবা
সোনালী ই-ওয়ালেট, ই-সেবার মাধ্যমে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রাহকদেরও আধুনিক সেবা দেয়া হচ্ছে জানিয়ে সোনালী ব্যাংকের এমডি বলেন, ই-ওয়ালেট এখন পর্যন্ত এক লাখের বেশি ডাউনলোড হয়েছে।
তার ভাষ্য, গ্রাহকের আস্থার দিক থেকে যেহেতু সোনালী ব্যাংক সবার চেয়ে এগিয়ে, তাই আধুনিক ব্যাংকিং সেবা দিয়ে তাদের আস্থার মূল্য দিতে চায় ব্যাংকটি।
স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে স্মার্ট ব্যাংকিং সেবা নিশ্চিত করতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, শুধু বেসরকারি ব্যাংকেই আধুনিক সেবা পাওয়া যায়, সাধারণ মানুষের এই ধারণা বদলে দিতে কাজ করছেন।
শিক্ষাগত জীবনে প্রকৌশলী হিসেবে ব্যাকিং সেক্টরে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তিগত চিন্তা এবং এর সর্বোচ্চ প্রয়োগ ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে তিনি অন্যদের থেকে এগিয়ে রয়েছেন। তিনি বলেন, ‘বেসরকারি ব্যাংক স্মার্ট সেবাতে এগিয়ে রয়েছে, আমরা পিছিয়ে রয়েছি, এটা বলার সুযোগ নেই।’
আফজাল করিম বলেন, ‘ইসলামী ব্যাংকের মতো বৃহৎ ব্যাংকও আমাদের সোনালী ই-সেবা পেমেন্ট গেটওয়ে সার্ভিস নিয়েছে। বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয় এখন আমাদের ই-সেবা নিচ্ছে।
‘শিক্ষার্থীরা ঘরে বসেই তাদের টিউশন ফি দিতে পারছে। বেসরকারি খাতের বেশ কয়েকটি ব্যাংক আমাদের সঙ্গে চুক্তি করে আমাদের সার্ভিস নিচ্ছে।’
ঋণ বিতরণ নিয়ে এ কর্মকর্তা বলেন, ‘আমি যখন আসি, তখন মোট ঋণ ছিল ৬৯ হাজার কোটি টাকা। সেখানে সিএসএমই খাত ছিল মাত্র ৭ শতাংশ। সেটা বর্তমানে হয়েছে ১৫ শতাংশ।’
তিনি বলেন, ‘সরকারের সঙ্গে আমরাও মনে করি, এসএমই ঋণ দিলে পুরো অর্থনীতি পরিবর্তন হবে। এ খাতে রিকভারিও যথেষ্ট ভালো। খেলাপির প্রবণতা খুব কম।’
মূলধন ঘাটতি শূন্যে নামানোর আশা
ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি শূন্যে নামানোর আশাবাদ ব্যক্ত করে মেধাবী এ ব্যাংকার বলেন, ‘বর্তমানে সোনালী ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি কমে দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৭৯৯ কোটি টাকা, যা কয়েক বছরের মধ্যে শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনতে চেষ্টা চলছে। এ ছাড়া ব্যাংকটির নেট ইন্টারেস্ট আয় গত বছর হয়েছে ৮২৬ কোটি টাকা, যেখানে প্রায় ৩০০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে, তবে অর্জনে সন্তুষ্ট না হয়ে পুরোনো খেলাপি কমিয়ে আনা ও নতুন খেলাপি রোধ করতেই সবচেয়ে বেশি নজর দেয়া হচ্ছে।’
সোনালী ব্যাংক দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে জানিয়ে ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত বাংলাদেশিদের বিনা খরচে, দ্রুততম সময়ে ও নিরাপদভাবে রেমিট্যান্স পাঠাতে ‘সোনালী এক্সচেঞ্জ মোবাইল অ্যাপ’ চালু করেছে ব্যাংকটি।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ডলার-সংকট বিশ্বের অনেক দেশের অর্থনীতির ওপর চাপ তৈরি করছে, বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। তবে দেশে যেভাবে রেমিট্যান্স আসছে, তা অব্যাহত থাকলে এ সংকট দ্রুত কেটে যাবে।
রেমিট্যান্স টানতে কোনো কোনো ব্যাংক ডলারের বাড়তি দাম দিচ্ছে, যা মোটেও কাম্য নয় বলে মনে করেন তিনি।
মূল্যস্ফীতি কমাতে ব্যাংকগুলোর ভূমিকা জোরদারের কথাও বলেন মো. আফজাল করিম। তার মতে, ডলারের দর বাড়লে তাতে আমদানি খরচ বাড়বে, যার প্রভাবে বাড়বে মূল্যস্ফীতি। এ জন্য ডলারের দরে ব্যালেন্স রাখতে নানা পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।