রাজধানীর বনানী কাঁচাবাজারে শনিবার সকালে ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে চলছিল তুমুল বাগবিতণ্ডা। ক্রেতার অভিযোগ, আগের দিন বিক্রেতা যে পেঁয়াজ বিক্রি করেছে ১৩০ টাকা কেজি দরে, তা এখন চাইছেন ২৫০ টাকা। অন্যদিকে বিক্রেতা বলছেন, আড়তে পেঁয়াজের দাম দ্বিগুণ হয়েছে। তাই তাদের কিছুই করার নেই।
ক্রেতা আনিস রহমানকে সাংবাদিক পরিচয় দিতেই সংবাদমাধ্যমের ওপর ক্ষোভ ঝেড়ে বলেন, ‘আপনারা সত্য কথা কেন তুলে ধরেন না? এইটা কোনো দেশের বাাজার পরিস্থিতি হতে পারে? এ দেশে বাজার দেখার জন্য কি সত্যি কেউ নাই?’
অভ্যন্তরীণ বাজারে মূল্য সহনীয় রাখতে বৃহস্পতিবার পেঁয়াজ রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ভারত, যেটি কার্যকর হয় শুক্রবার। এ নিষেধাজ্ঞার পরও মূল্য পরিশোধ হয়ে যাওয়া পেঁয়াজের চালান সীমান্ত দিয়ে ঢুকেছে বাংলাদেশে।
ভারতের ঘোষণার ব্যাপক প্রভাব দেখা যায় বাংলাদেশের বাজারে। সীমান্তবর্তী জেলাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে শনিবার চড়া দামে বিক্রি হয় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যটি।
পেঁয়াজের আকস্মিক এ মূল্যবৃদ্ধিতে আক্ষেপ ঝরল বনানী কাঁচাবাজারের আরেক ক্রেতা অবসরপ্রাপ্ত চাকরিজীবী আনিসের কণ্ঠেও।
তিনি বলেন, ‘এক দিনে আগে যে জিনিস ১২০ থেকে ১৩০ টাকায় বিক্রি হয়েছে, তা শুধু ঘোষণায় দ্বিগুণ হয়ে যাওয়া কোনোভাবেই মানা যায় না।
‘আমি শিউর, এসব ব্যবসায়ী নতুন করে পেঁয়াজ কেনেননি, তবে দাম ঠিকই দ্বিগুণ করে দিয়েছেন।’
মিরপুরের একটি বাজারেও শনিবার একই চিত্র দেখা যায়। দোকানদারদের সঙ্গে কথা-কাটাকাটি হয় ক্রেতাদের।
অনেকেই বলেন, ভারত শুধু রপ্তানি বন্ধ করে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এখন দোকানে যেসব পেঁয়াজ রয়েছে তা আগেই কেনা। এমন পরিস্থিতিতে দাম বাড়ার কোনো কারণ নেই।
বাজারে মধ্যবয়সী আবদুল জলিল মিয়া জানান, খবর শোনার পর কিছু পেঁয়াজ কিনে রাখার জন্য বাজারে এসেছেন। ভেবেছেন ভারত থেকে আমদানি বন্ধ হলে দাম বাড়তে পারে পেঁয়াজের, তবে তিনি আসার আগেই পণ্যটির দাম বেড়ে যায়।
আবদুল জলিল বলেন, ‘আমাদের চেয়ে ব্যবসায়ীরা অনেক বেশি চালাক। আমরা ভেবেছি আর তারা তার আগেই দাম বাড়িয়ে বসে আছে।’
মিরপুরের বাজারগুলোতে শনিবার দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হতে দেখা যায় ২২০ থেকে ২৩০ টাকা কেজি দরে। অবশ্য ভারতীয় পেঁয়াজ ১৮০ থেকে ২০০ টাকার মধ্যে বিক্রি হয়।
এক দিনের ব্যবধানে কেন পেঁয়াজের দাম দ্বিগুণ হয়ে গেল, এমন প্রশ্নের জবাবে বিক্রেতা কামাল হোসেন বলেন, ‘আমরা কিনে আনি আড়ত থেকে। আপনারা তাদেরকে ধরেন। আমরা ভাই ছোট ব্যবসায়ী। আমরা এগুলা বলতে পারি না।
‘আমরা কিনে আনি যে দামে তার চেয়ে ১০/২০ টাকা লাভে বিক্রি করে দিই।’
রাজধানীর কারওয়ান বাজার, মৌলভীবাজার, শ্যামবাজার পাইকারি আড়তগুলোতেও পেঁয়াজের দামের ঊর্ধ্বমুখী চিত্র দেখা যায়।
কারওয়ান বাজারে পেঁয়াজ কিনতে আসা এক ক্রেতা জানান, দাম দেখে না কিনেই চলে যাচ্ছেন তিনি। আরেক ক্রেতা জানান, দাম বাড়তে পারে ভেবে ২০ কেজি পেঁয়াজ কেনার চিন্তা করে বাজারে এসেছেন, তবে দাম দেখে দুই কেজি কিনেই চলে যাবেন তিনি।
ক্ষোভ জানিয়ে তিনি বলেন ‘এ আর নতুন কী? আমাদের ভাগ্যই এমন। কোথা থেকে আমদানি বন্ধের ঘোষণা দিল আর সাথে সাথে আমাদের বাজারে দাম বাড়া শুরু হলো।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজধানীর বৃহৎ পাইকারি বাজারগুলোতে আমদানি করা ভারতীয় পেঁয়াজের দাম বেড়ে কেজিপ্রতি ছিল ১৬০ থেকে ১৮০ টাকা। এ ছাড়া নতুন দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয় ১৪০ থেকে ১৫০ টাকা কেজি দরে, তবে পুরোনো দেশি পেঁয়াজ পাইকারি বাজারেই বিক্রি হয় ২০০ টাকা কেজি দরে।
কেন এক দিনের ব্যবধানে দামের এই উল্লম্ফন, তার সদুত্তর দিতে পারেননি কোনো পাইকারি ব্যবসায়ী।
শ্যামবাজারের এক পাইকারি ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘যখন অন্যরা দাম বাড়িয়েছে, তখন আমাদেরও বাড়াতে হয়েছে। সবাই দাম বাড়ালে আমার একার কী দোষ, বলেন?’
তিনি জানান, পুরো বাজার যে নিয়মে চলছে তারাও সেই নিয়মেই দাম বাড়িয়েছেন, তবে সেই নিয়মটা কী, তা জানতে চাইলে বলেন, ‘চাহিদা বাড়লে দাম বাড়বে, আবার সরবরাহ কম থাকলে, দাম বাড়বে। এটাই নিয়ম।’
বাজারের এমন পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন করা হলে শ্যামবাজার পাইকারি ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুল মাজেদ নিউজবাংলাকে জানান, তাদের কথায় কর্ণপাত করেন না ব্যবসায়ীরা।
তিনি বলেন ‘এখানে আমাদের কী করার আছে বলেন? সরকার তাদেরকে ধরুক। আমরা চাই না কিছু অসৎ ব্যবসায়ীর জন্য আমাদের সবাইকে কথা শুনতে হোক।’
সরকারকে এ বিষয়ে সহযোগিতা করেন কি না, এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘সবসময় আমরা তা করতে পারি না। আমরা কিছু করলে ব্যবসায়ীরা বলে সে সরকারের দালাল’।
তিনি জানান, শনিবার সকালে ম্যাজিস্টেট এসে দোকানদারকে ১১০ টাকা কেজি দরে পেঁয়াজ বিক্রি করতে বাধ্য করেছেন। অন্য কোনো বছরই এমন সময় পেঁয়াজের দাম বাড়ার নজির নেই। শীত শুরু হওয়ায় দেশের যেসব জায়গায় পেঁয়াজের আবাদ হয়, সেসব জায়গা থেকে পেঁয়াজ উঠাতে শুরু করেছেন কৃষকরা।
অবশ্য আবদুল মাজেদ জানান, ১০ থেকে ১২ দিনের মধ্যে নতুন পেঁয়াজ আসা শুরু হবে। তখন দাম অনেকটাই কমে আসবে।
দাম বাড়াকে ইতিবাচক দিক হিসেবে উল্লেখ করে ব্যবসায়ী এ নেতা বলেন, ‘কৃষকরা এবার পেঁয়াজ চাষ করে লাভের মুখ দেখবেন। যেখানে ৩০ টাকা কেজি পেতে কষ্ট হয়, সেখানে আজকে ১০০ টাকা কেজি জমিতেই বিক্রি হচ্ছে। এটা কল্পনাও করতে পারেনি চাষিরা।’