২০১৪ সালের দিকে প্রতিবেশী দেশ ভারত গরু রপ্তানি বন্ধ করার পর থেকেই বাংলাদেশে ক্রমশই বাড়তে থাকে গরুর বাণিজ্যিক খামার। বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগও হচ্ছে এই খাতে। এর পেছনে অবশ্য বড় ভূমিকা রাখছে দেশের অভ্যন্তরে গরুর মাংসের ব্যাপক চাহিদা। এ ছাড়া ঈদুল আজহায় রয়েছে কোরবানির পশুর বিশাল বাজার। ভারত থেকে আমদানি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর হু হু করে বাড়তে দেখা যায় গরুর মাংসের দাম। তাই অনেক উদ্যোক্তা খামারে বিনিয়োগ করতে উৎসাহি হয়ে উঠেন। পাশাপাশি গরুর দুধের বিপুল চাহিদার কারণেও দিনে দিনে বাড়ছে খামারের সংখ্যা। ফলে বিগত কয়েক বছরে ক্রমবর্ধমান মাংস ও কোরবানির পশুর চাহিদাও পূরণ হয়েছে দেশের অভ্যন্তরীণ নিজস্ব খামার থেকেই।
এভাবেই গরুর খামারের জন্য একটি আদর্শ গ্রাম হয়ে উঠেছে সাতক্ষীরার তালা উপজেলার জিয়ালা গ্রাম। সরেজমিনে দেখা যায়, এই গ্রামের মানুষের প্রধান পেশাই এখন গরুর খামার। স্থানীয়দের দেয়া তথ্য মতে, গ্রামটিতে গড়ে উঠেছে প্রায় ১ হাজার ২ শ ছোট বড় খামার। শুধু তাই নয় পুরো তালা উপজেলায় রয়েছে প্রায় সাড়ে তিন হাজার খামারি যারা এক লাখের অধিক গরু পালন করে পুরো জেলার অর্থনীতি পরিবর্তনে ভূমিকা রাখছে। অবশ্য জিয়ালা গ্রামের গরু পালন নতুন কিছু নয়। কয়েক প্রজন্ম ধরে এখানে গরু পালন চলে আসছে বলে জানালেন স্থানীয়রা। তবে অপরিকল্পিত হওয়ায় যেখানে সেখানে আবর্জনা ও গোবর পড়ে থাকতে দেখা যেতো। তারা আরও বলেন, এক সময় জিয়ালা গ্রামের মানুষের সাথে অন্য গ্রামের কেউ মিশতে চাইতো না। তাদের সাথে মেয়ের বিয়ে পর্যন্ত দিতে চাইতো না।
তবে ২০১৯ সাল থেকে পাল্টে যেতে থাকে সেই প্রেক্ষাপট। সে বছর বিশ্বব্যাংক ও পল্লি কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন-পিকেএসএফের যৌথ উদ্যোগে সাসটেইনেবল এন্টারপ্রাইস প্রজেক্ট বা এসইপি মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন শুরু হয়। মোট ১৩ কোটি মার্কিন ডলারের প্রকল্পটির অধিনে উপপ্রকল্প নিয়ে কাজ শুরু করে স্থানীয় এনজিও উন্নয়ন প্রচেষ্টা। যাদের হাত ধরেই পাল্টে যেতে থাকে খামারিদের ভাগ্য।
যেভাবে বদলে গেছে জিয়ালা গ্রাম
একদিকে গ্রামের মানুষের অক্লান্ত পরিশ্রম অন্যদিকে এসইপি প্রকল্পের গাইডলাইন, সব মিলে জিয়ালা হয়ে উঠেছে খামারের জন্য এক মডেল গ্রাম। উন্নয়ন প্রচেষ্টার কর্মীরা জানান, প্রথমেই খামারিদের শৃঙ্খলার মধ্যে আনার চেষ্টা করেছেন তারা। খামার পরিস্কার রাখা, অর্গানিক দুধ ও মাংস উৎপাদন বাড়ানো, গোবর সংরক্ষণ ও সেটাকে লাভজনক করে তুলতে সমন্বিত উদ্যোগ নেয় এনজিও টি। এসইপি প্রকল্প থেকে সহায়তা বাবদ গড়ে তোলা হয় গোবর ডাম্পিং সেন্টার। সেখানে আবার প্রত্যেক খামারির নামে আলাদা জায়গা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এর ফলে নোংরা পরিবেশ থেকে পুরো গ্রাম রক্ষা পেয়েছে বলে জানান উন্নয়ন প্রচেষ্টার ফোকাল পার্সন শাহনেওয়াজ কবীর। তিনি বলেন, যে গোবর একসময় পরিবেশ নোংরা করতো সে গোবর বিক্রি করে এখন ভালো আয় করছেন খামারিরা। শুধু তাই নয় তিনি জানান, নোংরা পানি যাতে পরিবেশের ক্ষতি না করতে পারে সে জন্যও ড্রেনেজ ব্যবস্থা করেছে তারা।
এরপর শুরু হয় খামারিদের ঋণ প্রদান। জিয়ালা গ্রামের তেমনি একজন খামারি গৃহবধু চায়না ঘোষ। সংসারের অন্যান্য চাপ সামাল দিয়েও সমানতালে পালন করছেন বেশ কয়েকটি গরু। ঢাকা থেকে গিয়ে সরেজমিনে দেখা যায়, চারটি গরু থেকে তিনি প্রতিদিন দুধ পাচ্ছেন প্রায় ৪০ লিটার। যা থেকে তার মাসে আয় হচ্ছে ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা। জানান, খামারের আয় দিয়ে তার দুই ছেলেকে পড়ালেখা করাচ্ছেন তিনি। শুধু তাই নয় সংসার খরচের বড় যোগানও আসছে খামার থেকে। পাশাপাশি পাকা বাড়িও গড়ে তুলেছেন খামারের আয় দিয়ে।
শুধু তিনিই নন তার মতো খামার করে এখন সংসার চালাচ্ছেন গ্রামের বেশিরভাগ পরিবার। পরিকল্পিত খামারে দিন দিন আগ্রহ বাড়ছে বাসিন্দাদের। তবে স্থানীয় খামারিরা জানান, সরকারি তেমন কোন পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছেন না তারা। গরুর খাবারের দাম বেড়ে যাওয়া নিয়েও হতাশার কথা জানালেন রেনুকা ঘোষ। বলেন, ‘আমাদের লাভের বেশিরভাগ চলে যাচ্ছে গো-খাদ্য কিনতে, এই হানে সরকার সহায়তা করলে আরোও বড় খামার করত পারতাম।’
গ্রামটির খামারগুলো অবশ্য অন্য জায়গার মতো আবদ্ধ নয়। রাস্তার পাশেই ছোট ছোট খামারে খোলামেলা পরিবেশেই রাখা হয়েছে গরু ও বাছুর। অবাক ব্যাপার সেখানে নেই কোন গরু চুরির কোন আতংক। চায়না ঘোষ অনেকটা আত্নতৃপ্তি নিয়ে বললেন, ‘আমাগো গ্রামে কারো চুরি করার সময় নাই, সবাই ব্যস্থ নিজেগো গরু পালতে। আগে টুকটাক হইতো, এখন চুরি নাই। সবার সম্মান হইছে, টাকা পয়সা বেড়েছে, কর্ম করে খায়।’ তবে এত গরু পালনের পরও সরকারি কোন পশু ডাক্তারের দেখা তারা পান না বলে অভিযোগ রয়েছে খামারিদের।
খামারিরা জানালেন, পরিকল্পিত ডাম্পিং সেন্টারে রাখা গোবর কিনে নেন জৈব সার নিয়ে কাজ করা উদ্যোক্তারা। তাদের কাছে প্রতি বস্তা গোবর ১০ থেকে ২০ টাকায় বিক্রি হয় বলেও জানালেন তারা। এসইপি ডেইরি প্রকল্পের পরিচালক গিয়াস উদ্দিন জানান, পরিবেশ রক্ষাই তাদের প্রথম অগ্রাধিকার। বলেন, একটা সময় ছিলো খামারিরা পরিবেশ নিয়ে মোটেই ভাবতো না তবে এখন তারা এ ব্যাপারে বেশ সচেতন। কোন উদ্যোক্তার খামার পরিবেশ দূষন করলে তাদেরকে ঋণ দেয়া হয় না বলেও জানান তিনি।
পাশাপাশি দুধ বাজারজাত করনেও সহায়তা দিচ্ছে স্থানীয় এনজিও টি। কর্মকর্তারা জানান, একটা সময় খামারিরা দুধের ভালো দাম পেতো না। তবে এখন সেই সিন্ডিকেট ভাঙ্গতে তারা প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। দেশের স্বনামধন্য বেশ কয়েকটি ডেইরি কোম্পানি তাদের কাছ থেকে প্রতিদিন দুধ কিনে নিচ্ছেন বলেও জানালেন খামারিরা।
গোবর থেকে হচ্ছে জৈব সার
জিয়ালা গ্রামের খামার থেকেই প্রতিদিন উৎপন্ন হয় প্রায় ২০ টন গোবর। সেই গোবর কিনে নিতে জৈব সার উদ্যোক্তাদের ঋণ দেয়া হচ্ছে এসইপি প্রকল্প থেকে। মাঠ পর্যায়ে গিয়ে দেখা যায় এমন উদ্যোক্তার সংখ্যাও বাড়ছে তালা উপজেলায়। তেমনি এক উদ্যোক্তা আবদুল মালেক। শিবপুর ইউনিয়নে তার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, গোবর দিয়ে ভার্মি কম্পোস্ট বা কেঁচো সার তৈরি করতে নেয়া হয়েছে বড় উদ্যোগ। বাড়ির বিভিন্ন জায়গাজুড়ে কয়েক ধাপে বসানো রয়েছে জৈব সার তৈরির নানা উপকরণ। তার এই কাজে প্রত্যক্ষ সহায়তা করছে তার এমএ পাশ মেয়ে শাহিনুর ইয়াসমিন। শাহিনুর জানান, আনুষঙ্গিক সব খরচ বাদ দিয়েও তাদের মাসে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা আয় হচ্ছে। ভালো জায়গায় বিয়ে হওয়ার পরও তিনি বাবার সাথে জৈব সার উৎপাদন করে পরিবারকে সহায়তা করছেন। আবদুল মালেক জানালেন, জৈব সার উৎপাদনের শুরুটা মোটেই সুখের ছিলো না তার জন্য। এলাকার মানুষ তার সাথে নানা ব্যঙ্গ করতো বলেও জানান তিনি। তবে নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে এখন তার প্রকল্পে কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে অনেকের।
একই গ্রামের বাসিন্দা আবদুল আজিজ বিশ্বাসের গল্পটাও অনেকটা এমনই। ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে যিনি কেঁচো আবাদ শুরু করেন। বর্তমানে এই সার বিক্রি করে মাসে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা আয় হচ্ছে বলে জানান তিনি। জৈব সারের আয় দিয়ে তিনি নতুন করে গরুর খামার গড়ে তুলতে চেষ্টা করছেন বলেও জানালেন তিনি।
পুরো এলাকায় যেসব জৈব সার তৈরি হচ্ছে তা বিক্রি করতে একটি ভ্যালু চেইন গড়ে তুলেছেন তারা স্থানীয় এনজিওটি। উৎপাদিত সার যথাসময়ে বিক্রি করতে প্রচেষ্ট রয়েছে তাদের। তবে সারের দাম নিয়ে অসন্তেুাষ জানান উদ্যোক্তারা। শাহিনুর বলেন, পরিবেশ সম্মত চাষাবাদে জৈব সার ব্যবহার বাড়লেও কাঙ্ক্ষিত দাম পাচ্ছেন না তারা। দাবি তুলেন রাসায়নিক সারের মতো সরকারি ভর্তুকি পেলে তাদের উদ্যোগ ছড়িয়ে যাবে দেশের বিভিন্ন জায়গায়।
উন্নয়ন প্রচেষ্টার শাহনেওয়াজ কবীর জানান, গোবর থেকে বর্তমানে সাড়ে তিন কোটি টাকার জৈব সার উৎপাদন হচ্ছে। তিনি বলেন, একদিকে পরিবেশ রক্ষা পাচ্ছে অন্যদিকে আয় বাড়ছে খামারিদের। মাছের ঘের, রুপটপ বাগানে এই সারের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি বলে জানালেন তিনি। তবে তিনি বলেন, সরকারি সহায়তা পেলে রাসায়নিক সারের বিকল্প হয়ে উঠতে পারে পরিবেশ বান্ধব জৈব সার।
দেশের কৃষি উৎপাদনকে অর্গানিক করতে জৈব সার ব্যবহারে জোর দিয়েছেন প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ও পিকেএসএফর সাবেক চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ। দৈনিক বাংলাকে তিনি বলেন, জৈব ও রাসায়নিক সার সমান্তরাল ভাবে ব্যবহার করতে হবে কৃষি উৎপাদনে। বৈশ্বিক বিভিন্ন হিসেব তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘অনেকে মনে করেন জৈব সারে ফসল উৎপাদন কমে যায় বিষয়টি তা নয়।’ বলেন, দেশের বিভিন্ন জায়গায় এখন গরু ও ছাগলের খামার বাড়ছে। বড় পরিসরে উৎপাদন ধরে রাখতে সরকারি সহায়তা বাড়ানোর পরামর্শ দেন তিনি। বলেন, ‘সরকার ও এনজিও মিলে খামারিদের সহায়তা করতে পারলে গ্রামীণ অর্থনীতি পাল্টে যাবে।’ করোনা মহামারিতে খামারিরা ক্ষতির মুখে পড়েছে উল্লেখ্য করে তিনি বলেন, তাদের পাশে সকলকে থাকতে হবে। পশুর খাদ্য, চিকিৎসা ও পরিচ্ছন্না নিশ্চিত করতে সব পক্ষকে এক হয়ে কাজ করার পরামর্শ দেন এই বিশেষজ্ঞ। খামার দিয়ে গ্রামীণ অর্থনীতি পাল্টে ফেলা সম্ভব বলেও মত দেন ড. কাজী খলীকুজ্জমান।