দৃষ্টিসীমাজুড়ে নৈসর্গিক দৃশ্য। নদ-নদী, পাহাড়, বন-জঙ্গলের মনোরম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের কারণে সারা বিশ্বের পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় গন্তব্যে পরিণত হয়েছে চীন।
বলা হয়ে থাকে চীনের বিভিন্ন প্রদেশে এক পাহাড়েই একসময়ে চার ঋতুর সমাহার ঘটে ও প্রতি পাঁচ কিলোমিটার পরপর আবহাওয়ার পরিবর্তন দেখা যায়। দেশটির অর্থনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে এ পর্যটন শিল্প।
পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের একটি চীনের গ্রেট ওয়াল বা মহাপ্রাচীর। চীনের সবচেয়ে উঁচু টাওয়ার ও বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ টাওয়ার হলো সাংহাই টাওয়ার। এর বাইরে প্রাকৃতিক পরিবেশ ও বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি, খাবার পর্যটকদের সহজেই আকৃষ্ট করে।
পর্যটকদের আকৃষ্ট করার সব উপাদানই রয়েছে চীনে। এ কারণে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনেও বড় ভূমিকা রাখছে পর্যটন শিল্প।
চায়না ট্যুরিজম অ্যাকাডেমির তথ্য অনুযায়ী, কোভিড-১৯-এর আগে ২০১৯ সালে পর্যটন খাত থেকে চীনের অভ্যন্তরীণ আয় ছিল ৬ দশমিক ৬৩ ট্রিলিয়ন ইউয়ান। এর মধ্যে বিদেশিদের চীনে ভ্রমণ থেকে আয় ৫ দশমিক ৭৩ ট্রিলিয়ন ইউয়ান, যা ১৩১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারের সমান।
২০২২ সালে চীনের পর্যটন থেকে আয় ছিল প্রায় দুই ট্রিলিয়ন ইউয়ান। ২০২০, ২০২১ ও ২০২২ সালে চীনের রাজস্ব প্রায় সম্পূর্ণরূপে অভ্যন্তরীণ পর্যটন থেকেই হবে বলে অনুমান করা হয়েছিল, কিন্তু ২০২০ সালে কোভিড এর কারণে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা দেয় তারা।
গত ১০ বছরের ডেটা বিশ্লেষেণে জানা যায়, ২০১২ সালে পর্যটন খাত থেকে চীনের রাজস্ব আয় হয়েছিল ২ হাজার ৫৯০ বিলিয়ন ইউয়ান। ২০১৪ সালে সেটা ৩ হাজারের ঘর অতিক্রম করে আয় হয় ৩ হাজার ৭৩০ বিলিয়ন ইউয়ান। এরপর প্রতি বছরে এ আয় বেড়েছে, তবে ২০১৯ সালে সেটা ৬ হাজার বিলিয়ন ছাড়িযে যায়। এরপর ২০২০, ২০২১ ও ২০২২ সালে কোভিডের কারণে বিদেশি পর্যটকে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে তারা। ওই সময় অভ্যন্তরীণ আয় হয় যথাক্রমে ২ হাজার ২৩০ বিলিয়ন ইউয়ান, ২ হাজার ৯১৯ বিলিয়ন ও ২ হাজার ৪৪ বিলিয়ন ইউয়ান।
বিশ্ব পর্যটন শিল্পে চীন
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীন বিশ্বব্যাপী পর্যটন শিল্পের জিডিপিতে বার্ষিক পাঁচ থেকে ১০ বিলিয়ন ডলার যোগ করেছে।
জীবনযাত্রার ক্রমবর্ধমান মানসহ চীনের পর্যটন শিল্প গত এক দশকে উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। কোভিড-১৯ মহামারির ঠিক আগে চীনা পর্যটন শিল্প ২০১৯ সালে প্রায় ৫ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ইউয়ান আয় করে ১১ দশমিক ৭ শতাংশ রাজস্ব বৃদ্ধি করেছে। চীনের পর্যটন শিল্প দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যটন নিয়ে গঠিত। বেইজিং, সাংহাই ও গুয়াংজু চীনা পর্যটকদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় অভ্যন্তরীণ গন্তব্য। ২০১৯ সালে চীনে আসা বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা ছিল ৩ কোটি ২০ লাখের কাছাকাছি।
করোনাভাইরাস মহামারি চীনের পর্যটনে বড় প্রভাব ফেলেছে। যদিও মাত্র কয়েকজন বিদেশি যাত্রীকে দেশে প্রবেশের অনুমতি দেয়া হয়েছিল। অভ্যন্তরীণ ভ্রমণকারীর সংখ্যাও ২০২০ সালে অর্ধেকেরও বেশি কমে গেছে। ২০২১ সালে ধীরে ধীরে আবার বাড়তে শুরু করেছে।
আন্তর্জাতিক পর্যটন সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, করোনাভাইরাস মহামারি শুরুর আগে ২০১৯ সালে চীনে ৬ কোটি ৫৭ লাখ বিদেশি দর্শনার্থী প্রবেশ করেন। মহামারি শুরুর পর নিজেদের আন্তর্জাতিক বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে চীন। পরে বিভিন্ন দেশ পর্যায়ক্রমে করোনার বিধিনিষেধ তুলে নিলেও চীন অনেক দিন ধরে তা বহাল রাখে।
এ নিয়ে চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিন পিংয়ের নীতির বিরুদ্ধে বিক্ষোভও করেছে দেশটির জনগণ। ২০২২ সালের শেষ থেকে বিধিনিষেধ প্রত্যাহার শুরু করে বেইজিং।
পর্যটন শিল্প: বাংলাদেশের চিত্র
অপার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর বাংলাদেশে রয়েছে বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত, ম্যানগ্রোভ বন বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন; আছে পাহাড়, পর্বত ও হাওর। এতকিছুর পরও এ দেশে দিন দিন কমছে বিদেশি পর্যটক। ফলে কমছে এ খাত থেকে আয়ও।
পাশের দেশগুলোতে জিডিপিতে পর্যটন খাতের অবদান ১০ শতাংশের ওপরে থাকলেও দেশে মাত্র ৪ দশমিক ৪ শতাংশ।
পাঁচ দশক পেরিয়ে গেলেও দেশের পর্যটন শিল্প কীভাবে এগিয়ে যাবে, তার কোনো মহাপরিকল্পনা এখনও হয়নি।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ পর্যটন শিল্পকে তাদের মূল চালিকাশক্তি হিসেবে রূপান্তর করেছে, কিন্তু বাংলাদেশ সেই তুলনায় অনেকটা পিছিয়ে রয়েছে।
পর্যটন সংশ্লিষ্টরা জানান, পর্যটন স্পটগুলোয় প্রতি বছর ভ্রমণ করেন প্রায় দেড় কোটি পর্যটক। এর মধ্যে বিদেশি পর্যটক ৩ থেকে ৫ শতাংশ।
ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টোয়াব) সভাপতি শিবলুল আজম কোরেশী জানান, দেশের পর্যটন সম্ভাবনা কাজে লাগাতে প্রচার দরকার। প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও বিজ্ঞাপন দিতে হবে।
বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালে দেশে বিদেশি নাগরিক এসেছেন ৫ লাখ ৬৬৫ জন। এ ছাড়া ২০১৮ সালে ৫ লাখ ৫২ হাজার ৭৩০ জন আসেন। ২০১৯ সালে সর্বোচ্চ বিদেশি নাগরিক দেশে আসেন। এ সংখ্যা ৬ লাখ ২১ হাজার ১৩১।
করোনার সময় ২০২০ সালে বাংলাদেশে এসেছেন ১ লাখ ৮১ হাজার ৫১৮ জন। ২০২১ সালে ১ লাখ ৩৫ হাজার ১৮৬ জন আর ২০২২ সালে দেড় লাখ বিদেশি আসেন। ২০২৩ সালের আগস্ট পর্যন্ত তা হয়েছে ২ লাখ ১৪ হাজার।