তিন দিক থেকে ঘিরে প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের রয়েছে বেশকিছু স্থল বন্দর। সিলেটের মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার চাতলাপুর স্থল শুল্ক স্টেশন ও অভিবাসন কেন্দ্র তার একটি।
দেশ স্বাধীন হওয়ার বহু আগে থেকেই চাতলাপুর স্থল শুল্ক স্টেশন ও অভিবাসন কেন্দ্রের কার্যক্রম চলে আসছে। এই শুল্ক স্টেশন দিয়ে মূলত ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালিত হয়।চাতলাপুর সীমান্তের ওপারে রয়েছে ভারতের কৈলাশহর হয়ে আগরতলা। প্রথমে এই সীমান্ত হয়ে বৈধ পথে দুই দেশে লোকজন পারাপার শুরু হয়। পরে শুরু হয় পণ্য আমদানি-রপ্তানি।
বিভিন্ন ধরনের প্লাস্টিক পণ্য, মাছ, শুঁটকি, সিমেন্টসহ বেশ কিছু পণ্য ভারতে রপ্তানি হয় এই স্থল বন্দর দিয়ে। অপরদিকে ভারত থেকে বাংলাদেশে আসে সাতকরা, আদাসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যদ্রব্য।
সিলেটে যে কয়টি সীমান্ত চেকপোস্ট রয়েছে তার মধ্যে চাতলাপুর স্থল শুল্ক স্টেশন অন্যতম। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ব্যবসায়িক সম্পর্ক ভালো থাকায় এই স্থল বন্দরে কর্মব্যস্ততা দিনে দিনে বাড়ছে। তাতে যেমন ব্যবসায়ীরা লাভমান হচ্ছেন, তেমনই বাংলাদেশ সরকারেরও লাখ লাখ টাকার রাজস্ব পাচ্ছে।
চাতলাপুর শুল্ক স্টেশন দিয়ে যেসব পণ্য রপ্তানি হয় তার মধ্যে অন্যতম হলো মাছ। এ দেশের বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ভারতের ত্রিপুরাসহ বিভিন্ন রাজ্যে রপ্তানি করা হয়। প্রতিদিন ৫৫ থেকে ৬০ লাখ টাকার মাছ এই পথে ভারতে যায়। এই কাঁচা পণ্য রপ্তানি আরও বিপুল পরিমাণে বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে।
কিন্তু এই সম্ভাবনার পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘উড়ো ফোন‘। বৈধ পণ্যের আড়ালে চালানে অবৈধ পণ্যও বহন করা হচ্ছে- এমন অজ্ঞাত টেলিফোন আসছে শুল্ক স্টেশনের দায়িত্বশীলদের কাছে। আর তাতে ‘অতিমাত্রার‘ তল্লাশি তৎপরতায় বাধাগ্রস্ত হচ্ছে রপ্তানি কার্যক্রম। নষ্ট হচ্ছে সময়। পচে যাচ্ছে কাঁচামাল, বিশেষ করে মাছ।
মাছসহ অন্যান্য পণ্য রপ্তানি করতে গিয়ে আরও বেশকিছু বাধা ও হয়রানির শিকার হচ্ছেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। অহেতুক এসব হয়রানি থেকে মুক্তি পেতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কার্যকর পদক্ষেপ চেয়েছেন ক্ষতিগ্রস্ত রপ্তানিকারকরা।
চাতলাপুর স্থল শুল্ক স্টেশনের লেবার সর্দার আলমগীর হোসেন বলেন, ‘এই চেকপোস্ট দিয়ে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকার পণ্য আমদানি ও রপ্তানি হয়ে থাকে। মালামাল লোড-আনলোড করা নিয়ে আমাদের সার্বক্ষণিক ব্যস্ততা থাকে। কিন্তু কিছুদিন ধরে ব্যবসায়ীরা অযথা এক ধরনের হয়রানির শিকার হচ্ছেন। কারণ একবার মাল লোড করার পর আবার কর্তৃপক্ষ আনলোড করেন। এতে করে ব্যবসায়ীদের মাছগুলো নষ্টের পর্যায়ে চলে যায়। আর মাছ কিছুটা নরম হয়ে যাওয়ায় ভারতের বাজারে সেসবের সঠিক দাম পাচ্ছেন না এখানকার ব্যবসায়ীরা।
‘আমাদেরও বাড়তি কষ্ট করতে হয় একাধিকবার মাল লোড-আনলোড করতে।’
বাংলাদেশের রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান মেসার্স ফামিন এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী তাজদিক হোসেন ইমরান বলেন, ‘দীর্ঘ ১০ বছর ধরে কুলাউড়ার চাতলাপুর স্থল শুল্ক স্টেশন দিয়ে ভারতে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ রপ্তানি করে আসছি। সে সুবাদে দেশে বৈদেশিক মুদ্রা আসছে। পাশাপাশি অনেকের কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ছে। কিন্তু এই মাছ রপ্তানি করতে গিয়ে বর্তমানে হয়রানির সম্মুখীন হতে হচ্ছে।’
‘কে বা কারা কাস্টমস কর্তৃপক্ষ ও মৎস্য বিভাগকে ফোন দিয়ে জানাচ্ছে যে বৈধ পণ্য মাছের সঙ্গে অবৈধ কিছু পাচার করা হচ্ছে। আর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কোনো বাছবিচার না করেই ট্রাকে লোড করা পণ্য পুনরায় পরীক্ষার নির্দেশ দেয়। এ অবস্থায় রপ্তানির জন্য ব্যবহৃত গাড়ির মাল আনলোড করে আবার লোড করতে হয়।’
তিনি বলেন, ‘গাড়ির পণ্য লোডের পর আবার আনলোড করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে পুনরায় লোড করার এই তৎপরতায় প্রচুর সময় ব্যয় হয়। রপ্তানির মাছ নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছতে বাড়তি সময় লেগে যায়। এর ফলে আমরা বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা তো বটেই, ভারতের আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানও ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।
‘ভুয়া টেলিফোন কলে পাওয়া অভিযোগের ওপর ভিত্তি করে এভাবে হয়রানি থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করছি। উধ্বর্তন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ আশা করছেন।’
রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান সামী অ্যান্ড সাবিত এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী সাইফুল ইসলাম ও রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান মেসার্স জারা এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী মশিক মোল্লা জানান, ব্যবসায়ীরা দীর্ঘদিন ধরে চাতলাপুর স্থল শুল্ক বন্দর দিয়ে বৈধভাবে ব্যবসা করে আসছেন। পণ্য রপ্তানি করতে এসে বর্ডারে এসে তাদেরকে যেন এভাবে হয়রানির শিকার হতে না হয় সেজন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি।
তারা বলেন, ‘টেলিফোনে অজ্ঞাত ব্যক্তির দেয়া তথ্যের ওপর ভিত্তি করে পণ্য রপ্তানি সময়ক্ষেপণে ভারতের আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আমদানি-রপ্তানির মাধ্যমে বাংলাদেশ ও ভারতের পারস্পরিক সম্পর্ক অটুট থাকুক- আমরা এমনটাই প্রত্যাশা করি সব সময়।’
চাতলাপুর স্থল শুল্ক স্টেশনের কাস্টমস সুপারিনটেনডেন্ট রেজাউল হক বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা এই স্থল বন্দর দিয়ে ব্যবসা করতে গিয়ে কোনো ধরনের হয়রানির শিকার যেন না হয় সেদিকে আমাদের নজর আছে। ভবিষ্যতেও তা বজায় থাকবে।’