অবকাঠামো যদি মানবসম্পদ উন্নয়নের সঙ্গে না মেলে, তাহলে এসব কঙ্কালে পরিণত হবে বলে মনে করেন প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। তিনি বলেন, ‘বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে প্রেস্টিজিয়াস প্রকল্পের চেয়ে নিম্ন মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের স্বস্তির জন্য কাজ করা জরুরি, যাতে এই শ্রেণির জনগণের জীবনমান বজায় থাকে। পাশাপাশি যেসব অবকাঠামো উন্নয়ন হচ্ছে, তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মানবসম্পদ উন্নয়নেও জোর দিতে হবে। মানবসম্পদের উন্নয়ন না হলে অবকাঠামোগুলো কঙ্কাল হয়ে থাকবে। কারণ, অবকাঠামোর রক্ত, মাংস হচ্ছে উন্নত মানবসম্পদ। অন্যদিকে মানবসম্পদের উন্নয়ন না হলে বাংলাদেশের নিম্ন-মধ্য আয়ের দেশের ফাঁদে আটকে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।’
শনিবার রাজধানীতে ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) আয়োজিত ‘কনভারসেশন উইথ প্রফেসর ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ’ শীর্ষক একক বক্তৃতা অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন। দুই ঘণ্টার বেশি সময় ধরে চলা এই কথোপকথনে অবকাঠামো, ডলার ও রিজার্ভ ব্যবস্থাপনা, পুঁজিপাচার, ব্যাংক খাত, মানবসম্পদ উন্নয়নসহ উঠে আসে নানা প্রসঙ্গ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই অধ্যাপক তার দীর্ঘ বক্তৃতায় দেশের অবকাঠামো উন্নয়ন, মুদ্রানীতি, রাজস্বনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবেশ, ভূ-রাজনৈতিক কৌশলসহ সামষ্টিক অর্থনীতির বিভিন্ন খাত নিয়ে তার বিশ্লেষণ তুলে ধরেন। উপস্থিত সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবও দেন তিনি।
অবকাঠামো এবং মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের নানা দিক নিয়ে উদ্বেগের কথা তুলে ধরে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘ঋণ করে অবকাঠামো নির্মাণ সক্ষমতার প্রমাণ নয়। আমরা একের পর এক বড় বড় অবকাঠামোগত প্রকল্প করে যাচ্ছি। এগুলো ঋণের মাধ্যমে করা হচ্ছে। এর মধ্যে অনেকটি আছে প্রয়োজনীয়, অনেকটি আবার এসময় প্রয়োজন ছিল না।’
তিনি বলেন, ‘গত ৩ বছরে আমাদের বৈদেশিক ঋণ ৫০ বিলিয়ন ডলার থেকে ১০০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। আগামী ২-৩ বছরের মধ্যে আমাদের ঋণ ফেরত দিতে হবে বছরে ৫ বিলিয়ন ডলার। আমরা যদি ভবিষ্যতে আরও ঋণ নিতে থাকি তাহলে ঋণ পরিশোধের পরিমাণ আরও বেড়ে যাবে। এ জন্য লাভ-ক্ষতি বিবেচনা করে আমাদের বড় অবকাঠামো প্রকল্প হাতে নিতে হবে।’
ডলার এবং রিজার্ভ ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতার বিভিন্ন দিক নিয়ে তার মত দেন এ অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, ‘রিজার্ভ ব্যবহারের জন্য নয়, এটি সক্ষমতার বার্তা দেয়। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ছিল। আমরা যত ইচ্ছা প্রকল্প নিচ্ছিলাম; আমাদের তো যথেষ্ট রিজার্ভ আছে; কোনো অসুবিধা নেই। কিন্তু ভবিষ্যতে যে হঠাৎ করে কোনো চাপ আসতে পারে, সেটা চিন্তায় ছিল না। এর মাধ্যমে সারা দুনিয়াকে জানানো হয়, আমাদের অর্থনীতি স্থিতিশীল আছে। যাতে এর ফলে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ে। ভালো করছি বলে আমরা বিনিময় হারগুলো সময়মতো সমন্বয় করিনি।’
তার মতে, রিজার্ভটা রাখা হয় এ কারণে যাতে বিদেশিদের আস্থা ও বিনিয়োগ বাড়ে। এটা কখনওই নিজেদের ব্যবহারের জন্য তৈরি করা হয় না। এটা যেন আপদের সময়ে কাজে লাগে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এই উপদেষ্টা বলেন, ‘রিজার্ভ ব্যবস্থাপনায় গলদ ছিল। তার মাশুল দিতে হচ্ছে। নতুন নতুন নানা কৌশলে পুঁজি পাচার হচ্ছে, কিন্তু বন্ধে সমন্বিত উদ্যোগ নেই। ব্যাংক খাত থেকেও হাজার হাজার কোটি টাকা চলে যাচ্ছে, ধরা যাচ্ছে না।’
আক্ষেপের সুরে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘অপ্রিয় সত্য কথা বললে তা পছন্দ করে না সরকার। আমরা কখনো সমন্বিত অর্থনৈতিক পরিকল্পনা অনুযায়ী চলিনি। আমাদের আত্মতুষ্টি এসে গিয়েছিল।’
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘বাংলাদেশের যে উৎপাদন শক্তি, তাতে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিবেচনায় চীনের ব্লকে যোগ দেয়া ঠিক হবে না। কারণ, চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যে ভারসাম্য নেই। বাংলাদেশের আমদানি নির্ভরতা চীন ও ভারতের ওপর। আবার উৎপাদিত পণ্য বিক্রির বাজার প্রধানত ইউরোপ, আমেরিকা। ফলে বাংলাদেশকে সব দেশের সঙ্গে ভারসাম্য রাখতে হবে। কোনো জোটে যাওয়ার সুযোগ নেই। চীন, ভারতের সঙ্গে আমদানির জন্য সম্পৃক্ত থাকতে হবে। আবার রপ্তানির জন্য পশ্চিমা দেশের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে হবে। সেখানেও রাজনীতি রয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন যদি মানবাধিকার ইস্যুতে জিএসপি প্লাস সুবিধা না দেয়, সেটা আমাদের জন্য ভালো হবে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘২০২৬ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণ করবে। ফলে তার পরে বিশ্ব বাণিজ্যে আমাদের অনেক সুবিধা থাকবে না। কিন্তু উত্তরণের বাংলাদেশের প্রস্তুতির ঘাটতি রয়েছে। বাণিজ্য চুক্তিগুলো রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। তাই এ বিষয়ে জাতীয় নীতি থাকা প্রয়োজন।’
ব্রিকস প্রসঙ্গে বলেন, ‘এটি নতুন ভূ-রাজনৈতিক জোট। কিন্তু এই জোট খুব সফল হবে বলে মনে হয় না। কারণ, ব্রাজিল, ভারতের মতো দেশ চীনের উদ্দেশ্য পূরণে সহায়ক হবে না। মানবাধিকার, গণতন্ত্র, ব্যক্তিস্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে যারা কথা বলছে, তারও নিজেদের স্বার্থেই তা বলছে বলে মনে করেন তিনি। কারণ এসব নিয়ে কাজ করা দেশগুলো তাদের নাগরিকদের কাছে দেখাতে চায় যে তারা কিছু করছে। এ রকম নতুন সমীকরণে ব্রিকস কতটা কার্যকর হবে তা দেখার বিষয়।’