রাজধানীর মিরপুরের একটি বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে এসেছেন রশিদ মিয়া। বয়সের ভারের চেয়ে তার কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজটা বেশি। রিকশা চালিয়ে কোনোমতে ৪৫০ টাকা নিয়ে এসেছেন বাজারে।
আধা ঘণ্টা ধরে বাজারে ঘুরে ঘুরে কিছুই কিনতে পারেননি বলে এ প্রতিবেদককে জানান রশিদ। কেন পারেননি জানতে চাইলে কিছুক্ষণ চুপ থেকে তিনি জানান, পাঁচজনের সংসারে প্রতিদিনের খাবারের জন্য যে ব্যয় হয়, তার চেয়ে আয় কম তার।
এত বেশি চিন্তিত কেন জানতে চাইলে রশিদ মিয়ার পাল্টা প্রশ্ন, ‘আপনি বলেন কী কিনমু ভাই? মাংস খাওয়া বাদ দিছি অনেক আগে। পুরা বাজার ঘুইরা কোনো মাছ কিনতে পারলাম না। আগে ডিম কিনতে পারতাম, এখন শুনি ডিমের ডরজন কিনতে প্রায় ২০০ টাহা লাগে।’
রশিদ মিয়ার মতো এই আক্ষেপ এখন নিম্ন আয়ের মানুষদের। অপেক্ষাকৃত কম মূল্যের আমিষ ডিমের দাম হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় চরম অস্বস্তিতে তারা।
দাম গত কয়েক দিনে দফায় দফায় বেড়েছে ডিমের দাম। বর্তমানে রাজধানীর বাজারগুলোতে খামারের ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৭০ থেকে ১৮০ টাকা ডজন। আর দেশি মুরগির ডিম ডজনপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ২৫০ থেকে ২৬০ টাকা।
মুরগির ডিমের পাশাপাশি বেড়েছে হাঁসের ডিমের দামও। প্রতি ডজন হাঁসের ডিম বিক্রি হচ্ছে ২৩০ থেকে ২৪০ টাকায়।
হঠাৎ দাম বেড়ে যাওয়ার কারণ জিজ্ঞাসা করা হলে রোববার খুচরা ডিম বিক্রেতা হানিফ মিয়া বলেন, ‘দাম বাড়ানো বলেন আর কমানো বলেন, কোনো ক্ষমতাই আমাগো হাতে নাই। আমরা যেই দামে কিনি তার চেয়ে দুই-চার টাকা বেশি হলেই বিক্রি করে দিই।’
দাম বাড়াচ্ছে কারা জানতে চাইলে হানিফ মিয়ার উত্তর, ‘বড় যারা হেগো ধরেন। হেইডা তো কেউ পারে না।
‘কাস্টমার খালি আমাগো লগে চিল্লাপাল্লা করে। মনে হয় ডিম বেচাই বন্ধ কইরা দিই।’
ক্রেতা-বিক্রেতাদের এমন আক্ষেপের মধ্যে ডিমের দাম বাড়ার কারণ অনুসন্ধানে মাঠে নেমেছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন বাজারে অভিযান চালিয়ে জরিমানাও করা হচ্ছে।
সংস্থার পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার রোববার নিউজবাংলাকে জানান, ডিমের দামে কারসাজি বন্ধে দেশব্যাপী তাদের অভিযান চলমান রয়েছে।
তিনি বলেন, ‘আমাদের ৪০টির মতো টিম মাঠে রয়েছে। যারা কারসাজি করবে, কোনো ছাড় নেই তাদের। ‘গতকালও আমরা ৮৬টি জায়গায় অভিযান চালিয়ে ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা জরিমানা করেছি।’
বাজার স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত অভিযান চলবে বলেও জানান এ কর্মকর্তা।
ডিমের দামের কেন এমন ঊর্ধ্বগতি কিংবা কী করে বাজার স্বাভাবিক করা যায়, তা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে রোববার সচিবালয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম সাংবাদিকদের বলেন, ‘প্রতিটি ডিম উৎপাদনে খরচ পড়ছে ১০ টাকা। ১২ টাকায় বিক্রি হলেও সব পক্ষ লাভবান হয়। কোনো মতেই ডিমের দাম ১২ টাকার বেশি হওয়া উচিত নয়।’
ওই সময় মন্ত্রী হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, কেউ অতিরিক্ত লাভ করলে কিংবা সুযোগ নিতে চাইলে ছাড় দেয়া হবে না।
একই দিনে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে আগস্ট মাস উপলক্ষে টিসিবির পণ্য বিক্রি কার্যক্রম উদ্বোধন করতে এসে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি ডিমের বাজার স্বাভাবিক করতে প্রয়োজনে আমদানির কথা বলেন।
তিনি বলেন, ‘প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সিগন্যাল দিলে ডিম আমদানি শুরু করবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।’ একই সঙ্গে দাম নির্ধারণ করে দিলে ডিম ও মুরগির বাজার তদারকি করা হবে বলেও জানান তিনি।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী অবশ্য এখনই আমদানির পক্ষে নেই।
সচিবালয়ে তিনি আরও বলেন, ডিমের যা উৎপাদন হচ্ছে তাতে আমদানির প্রয়োজন নেই। তদারকি ঠিকভাবে করা হলে কয়েক দিনের মধ্যেই দাম নিয়ন্ত্রণে আসবে।
পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের হিসাবে বর্তমানে দৈনিক ডিমের চাহিদা রয়েছে ৪ কোটি ৭০ লাখ। বিপরীতে প্রতিদিন ডিম উৎপাদন হচ্ছে ৪ কোটি ৩৫ লাখ। সে ক্ষেত্রে ঘাটতি থাকছে প্রায় ৩৫ লাখ ডিম।
তাদের হিসাব বলছে, পোলট্রি খাবারের দাম বৃদ্ধিসহ নানা কারণে অনেক খামার বন্ধ হয়ে গেছে, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বাজারের ওপর।