বিএনপি ও আওয়ামী লীগের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি ছিল শুক্রবার। শনিবার ঢাকার প্রবেশ পথগুলোতে বিএনপির অবস্থান এবং সংঘর্ষ। পরদিন ‘বিএনপির জ্বালাও-পোড়াও’-এর প্রতিবাদে আওয়ামী লীগের প্রতিবাদ কর্মসূচি। এখানেই শেষ নয়, নেতা-কর্মীদের ধরপাকড়ের প্রতিবাদে সোমবার সারা দেশে আবারও বিএনপির বিক্ষোভ কর্মসূচি।
দেশের প্রধান দুই দলের এমন ধারাবাহিক ও পাল্টাপাল্টি কর্মসূচিতে অনিশ্চয়তা বাড়ছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। একই সঙ্গে দুশ্চিন্তা বাড়ছে সাধারণ মানুষের। বিশেষত চিন্তার ভাঁজ পড়েছে ব্যবসায়ীদের কপালে। তাদের শঙ্কা- এভাবে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি কিংবা জ্বালাও-পোড়াও হলে বড় অংকের ব্যবসায়িক ক্ষতির মুখে পড়তে হবে।
করোনা মহামারির পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের খাঁড়ায় পড়েছে দেশের ছোট-বড় বহু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। বিশ্বব্যাপী কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ায় দেশের বাজারে অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে বেশ কয়েকটি পণ্যের দাম। তবে দাম বেড়েছে প্রায় সব ধরনের পণ্যের।
এমন অবস্থায় দেশে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ব্যবসায়ীদের ওপর ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দেখা দেবে বলে মনে করছেন ছোট-বড় অনেক ব্যবসায়ী। আর এর প্রভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্যের দামও আরেক দফা বাড়ার শঙ্কা তাদের।
এসএমই উদ্যোক্তা হিসেবে ইতোমধ্যে দেশে পরিচিতি পেয়েছেন কাজী সাজেদুর রহমান। পেপার কাপ বানিয়ে সারাদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পাইকারি বিক্রি করেন তিনি।
এই উদ্যোক্তা জানালেন, গত কয়েকদিন ধরে চলা রাজনৈতিক কর্মসূচির প্রভাব পড়েছে ব্যবসায়। দুই দিন কোনো পণ্য ডেলিভারি হয়নি তার। তাতে খুব বড় কোনো আর্থিক ক্ষতি এখন বোঝা না গেলেও ভবিষ্যতের দিনগুলো নিয়ে আতঙ্কে আছেন তিনি।
সাজেদুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সমস্যা বেশি হয় যখন দুই দল আন্দোলন ডাকে। এমন হলে শ্রমিক, ডেলিভারি ম্যান সবাই ভয়ে থাকে।
‘গণতান্ত্রিক দেশে রাজনৈতিক কর্মসূচি থাকবে। তবে এদেশে যা হয় তাতে দিন শেষে ব্যবসায়ীরাই ক্ষতিগ্রস্ত হন।
‘এখনও এলসি সংকটের কোনো সমাধান করতে পারলো না বাংলাদেশ ব্যাংক। তার ওপর এমন রাজনৈতিক কর্মসূচি চললে আমরা যাবো কোথায়?’
এসএমই উদ্যোক্তা কাজী সাজেদুর রহমানের কারাখানা। ছবি: নিউজবাংলা
নানা বাস্তবতায় গত অর্থবছরের রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের লক্ষ্যমাত্রা ৫ হাজার ৮০০ কোটি ডলারের বিপরীতে অর্জন হয়েছে ৫ হাজার ৫৫৫ কোটি ডলার।
সংশ্লিষ্টরা যদিও বলছেন, আগের বছরের চেয়ে প্রবৃদ্ধি বেড়েছে তাতেই সন্তুষ্ট তারা। প্রধান রপ্তানি গন্তব্য ইউরোপে যুদ্ধের অস্থিরতা কাটছে না। আরেক গন্তব্য আমেরিকার সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পর্ক কিছুটা টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সব মিলে রপ্তানি নিয়ে দুশ্চিন্তার সময়ে নতুন করে উঁকি দিচ্ছে রাজনৈতিক সংকট।
অস্তিরতা চলমান থাকলে ইতোমধ্যে অর্ডার নেয়া পণ্য নির্ধারিত সময়ে ডেলিভারি দেয়া নিয়ে তৈরি হবে অনিশ্চয়তা।
তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ’র সহ-সভাপতি শহিদুল্লাহ আজিম বলেন, ‘বিদেশি বায়াররা পরিস্থিতি অবজার্ভ করছেন। এটা ভাবার কোনো কারণ নেই যে তারা কিছু জানেন না।
‘বাংলাদেশের পরিস্থিতি এমন দেখলে সামনের দিনগুলোতে তারা আর অর্ডার দেবেন না। সঠিক সময়ে পণ্য ডেলিভারি দেয়া সম্ভব হবে- এমনটা তাদেরকে আমরা বিশ্বাস করাতে পারব না।’
তৈরি পোশাক খাতের ব্যবসায়ীদের দাবি, রাজনৈতিক কারণে রপ্তানিতে যেন কোনোভাবেই নেতিবাচক প্রভাব না পড়ে। এতে দেশের পুরো অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে আশঙ্কা করছেন পোশাক খাতের শীর্ষ রপ্তানিকারকরা।
শহিদুল্লাহ আজিম বলেন, ‘যারা রাজনীতি করছেন তাদের উদ্দেশ্য দেশের কল্যাণ করা। তাদের বোঝা উচিত কী কী করলে দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’
অল্প কয়েক দিনের রাজনৈতিক কর্মসূচি হলেও ইতোমধ্যে দেশের পরিবহন খাতে বড় ক্ষতি হয়েছে বলে মনে করেন দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী চেম্বার এফবিসিসিআইয়ের সিনিয়র সহ-সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘রাজধানী ঢাকার সঙ্গে প্রায় সব জেলার সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়াটা কোনোভাবেই ছোট ক্ষতি নয়। পাশাপাশি রাজধানীর হোটেল-রেস্তোরাঁ ব্যবসাতেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।’
মোস্তফা আজাদ চৌধুরীর প্রত্যাশা, বড় রাজনৈতিক দলগুলো আলোচনার টেবিলে বসেই সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেবে। তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে আমরা গঠনমূলক কর্মসূচি আশা করি।’
কোনো শঙ্কা দেখেন কি না- এমন প্রশ্নে ব্যবসায়ীদের এই নেতা বলেন, ‘স্থিতিশীলতা না এলে আমরা অবশ্যই শঙ্কিত। তবে এখনও কারখানা কিংবা সার্ভিস সেক্টরে এর তেমন নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি। দেশের ছোট-বড় ব্যবসায়ীদের কথা চিন্তা করে কোন ধরনের আক্রমণাত্মক কর্মসূচি না দেয়ার আহ্বান জানাই আমরা।’
রাজনৈতিক কর্মসূচি কেমন হওয়া উচিত তা নিয়ে বেশ কয়েকটি পরামর্শ দিলেন অর্থনীতিবিদ ও পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘কর্মসূচিগুলো রাজধানীর বাইরে কোনো নির্দিষ্ট স্থানে হওয়া উচিত।’
শুধু তাই নয়, কোন ধরনের সংঘাত-সংঘর্ষ যাতে না হয় সেদিকেও সব দলকে খেয়াল রাখার পরামর্শও দেন এই বিশেষজ্ঞ।
আলোচনার মাধ্যমে সংকটের সমাধান না হলে এর মাশুল দেশকে বড় করে দিতে হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি। বলেন, ‘রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘিরে আমরা যেমন উদ্বিগ্ন, তেমনই যারা আমাদের দেশ থেকে পোশাকসহ অন্যান্য পণ্য কেনেন তারাও উদ্বিগ্ন। এ দেশে ঝামেলা দেখলে তারা অর্ডার সরিয়ে অন্য দেশে নিয়ে যাবে।’
নির্বাচন ঘিরে এমন হট্টগোল কোনোভাবেই কাম্য নয় বলে মন্তব্য করেন এই বিশ্লেষক। বলেন, ‘স্বাধীনতার ৫২ বছর পরও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কোনো সুনির্দিষ্ট রূপরেখা তৈরি করতে না পারাটাই আমাদের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা।’
রাজনৈতিক দলগুলোকে ফলপ্রসূ সমাধানের পথ বের করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সবাইকে ভাবতে হবে রাজনীতির মাধ্যমে দেশকে আমরা কী দিচ্ছি।’