জাতীয় সংসদে প্রস্তাবিত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটকে গণবিরোধী ও বাস্তবায়ন অযোগ্য বলে উল্লেখ করেছে বিএনপি। দলটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ‘এই বাজেট সরকারের দুর্নীতির ধারাবাহিকতার ঘোষণাপত্র। এটি স্রেফ দুর্নীতিবাজ বর্তমান সরকারের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার লুটের লক্ষ্যে প্রণীত অর্থ লুটেরাদের বাজেট।’
রাজধানীর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে বুধবার আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে দলের পক্ষে এমন বক্তব্য তুলে ধরেন মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম।
প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে বিএনপির আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানাতে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘বাজেটে চলমান অর্থনৈতিক সংকট, ক্রমবর্ধমান আয়-বৈষম্য, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তলানিতে যাওয়া, বেপরোয়া অর্থপাচার, জনগণের কাঁধে রাষ্ট্রীয় ঋণের বোঝা একবারের জন্যও স্বীকার করা হয়নি। পরিত্রাণের উপায়ও বলা হয়নি। তেমনিভাবে সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে সুশাসন ও ন্যায়বিচারের ধারণাকে।’
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘এই বাজেট পরিচালনা ব্যয় ধরা হয়েছে ৬৩ দশমিক ৪ শতাংশ এবং উন্নয়ন ব্যয় ৩৬ দশমিক ৪ শতাংশ। এই অর্থের সংস্থান হবে ৫ লাখ ৩ হাজার ৯০০ কোটি টাকা আয় থেকে। আর ঘাটতি ২ লাখ ৫৭ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা আসবে ঋণ থেকে।
‘রাজস্ব আয়ের ৩২ দশমিক ৮ শতাংশ পরোক্ষ কর (ভ্যাট) এবং ৩০ দশমিক ৭ শতাংশ প্রত্যক্ষ কর। এরই সঙ্গে সরকার জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৫ শতাংশ এবং মুদ্রাস্ফীতির হার ৬ শতাংশের মধ্যে রাখার প্রত্যাশা করছে। এই বাজেট জনকল্যাণের নয়। এটি বাস্তবতা বিবর্জিত, প্রতারণামূলক, লোক দেখানো বাজেট।’
তিনি বলেন, ‘বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি ও বিনিয়োগসহ সামষ্টিক অর্থনীতির যেসব প্রক্ষেপণ করা হয়েছে তা অর্জনযোগ্য নয়। জিডিপি প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করলেও তা কীভাবে অর্জন হবে তার সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা বাজেটে নেই।
‘চলতি অর্থবছরেও ঢাকঢোল পিটিয়ে ঘোষণা করা হয়েছে যে প্রবৃদ্ধি হবে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। সংশোধনী বাজেটে তা পরে ৬ দশমিক ৩ শতাংশ পুনঃনির্ধারণ করা হয়। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এবারও এই প্রবৃদ্ধির টার্গেট অর্জন সম্ভব হবে না। কেননা অর্থনীতি এমনিতেই চাপে আছে।’
মূল্যস্ফীতি কমাতে বাজেটে কার্যকর পদক্ষেপ নেই বলে মন্তব্য করেন মির্জা ফখরুল। বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে অর্থনীতি ও সাধারণ মানুষের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ উচ্চ মূল্যস্ফীতি। গত মে মাসে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ, যা গত ১১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
‘অর্থনীতিবিদরা মনে করেন বাস্তবে এই মূল্যস্ফীতি ১৮ থেকে ২০ শতাংশের উপরে হবে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি, পরিবহন এবং খাদ্যের পাশাপাশি তেল, চাল, আদা, চিনি, ডিম, মুরগিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্য অনেক আগেই মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে।’
‘দেশের অর্থনীতি মহাবিপর্যয়ে’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ প্রায় তলানিতে এসে ঠেকেছে উল্লেখ করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘দেশের অর্থনীতি মহাবিপর্যয়ে রয়েছে। ডলারের সংকট প্রকট। পণ্য আমদানির জন্য ঋণপত্র (এলসি) খুলতে গেলে প্রায় সব ব্যাংক ফিরিয়ে দিচ্ছে। সরকারি হিসাব মতে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২৯ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে গেছে। আইএমএফের হিসাব বলছে, প্রকৃত রিজার্ভ দাঁড়ায় ২১ বিলিয়ন ডলারের ঘরে।’
ফখরুল বলেন, ‘২০০৯ সালে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার কোটি টাকা। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। পুনঃতফসিলকৃত ঋণ যোগ করলে প্রকৃত খেলাপি ঋণ ৪ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। গত বছরের প্রথম ৯ মাসেই খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩৩ হাজার কোটি টাকা। আর গত ৩ মাসেই খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১১ হাজার কোটি টাকা। দেশে এভাবে খেলাপি ঋণ বাড়ার প্রধান কারণ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা।’
তিনি বলেন, ‘গত ৬ বছরে বিদেশি ঋণ পরিশোধের পরিমাণ বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। চীন ও রাশিয়া থেকে নেয়া কঠিন শর্তের ঋণ শোধ করা শুরু হলে ২০২৪ সাল থেকেই বর্তমানের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যাবে। সে সময় পরিস্থিতি সামাল দেয়া কঠিন হয়ে পড়বে।’
‘মধ্যবিত্তের ওপর জুলুম চলছে’
বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘করযোগ্য আয় না থাকা মানুষেরও ৪৪ ধরনের সেবা নিতে কর বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এটা মধ্যবিত্তের ওপর জুলুম। প্রশ্ন হলো, যার আয় কম তিনি কি ওইসব রাষ্ট্রীয় সেবা পাবেন না?
‘একদিকে ন্যূনতম আয়কর সীমা বাড়িয়ে সাড়ে তিন লাখ টাকা প্রস্তাব করেছে, অপরদিকে আয় না থাকলেও ন্যূনতম ২ হাজার টাকা আয়কর ধার্য করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এটা সাংঘর্ষিক, ন্যায়নীতি বর্জিত এবং আয়ের ওপর করনীতির পরিপন্থি।’
পুঁজিবাজারে ক্ষতিগ্রস্ত লাখ লাখ বিনিয়োগকারীর জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে কোনো আশার আলো নেই উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘শেয়ার বাজারে সর্বস্বান্ত হাজার হাজার মানুষের আহাজারি সরকারের কানে পৌঁছায় না। এই সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে শেয়ার বাজারের সংকট দূর হবে বলে কেউ বিশ্বাসও করে না। শেয়ার বাজার বিপর্যয়ের ওপরে গঠিত তদন্ত রিপোর্ট আজও প্রকাশিত হয়নি।’
‘সম্পদ লুটের পাকা বন্দোবস্ত’
বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘স্মার্ট বাংলাদেশে এবার সরকার স্মার্ট লুটপাটের বাজেট দিয়েছে। তারা চুরিতে স্মার্ট। ভোট চুরি, ব্যাংক চুরি, অর্থপাচার- এসব কিছুতেই। স্মার্টলি লাখ লাখ কোটি টাকার দুর্নীতি, ব্যাংক লুটপাট, সিন্ডিকেট পরিচালনা, জনগণের সম্পদ লুটের পাকা বন্দোবস্ত করা হয়েছে এই বাজেটে।’
তিনি বলেন, ‘দেশে চলমান অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকট দেশের প্রধান জাতীয় সংকটে পরিণত হয়েছে। গণতান্ত্রিক সরকার না থাকলে সরকারের জাবাবদিহিতা থাকে না। দেশের অর্থনীতির জন্য কল্যাণকর বাজেট প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। এই জাতীয় সংকট থেকে মুক্তি পেতে জবাবদিহি ও দায়বদ্ধমূলক নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।’
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ইসমাইল হোসেন জবিউল্লাহ।